“ঊষার সীমান্তে স্বচ্ছ গাঢ় নীলিমায়,
ফুটিয়া উঠিল ধীরে তব ‘আনোয়ারা’
ঝলমলি দশদিক অপূর্ব শোভায়
মোসলেম সাহিত্য নভে সে যে শুকতারা।
সতীরূপ জ্যোতি কত উজ্জ্বল মধুর,
দেখালে ধরিয়া তুলি, তুলনা তাহার
কোথা মিলে? সে যে ষড়রসে ভরপুর
হেরিয়া বিভোর সবে যে রূপ বাহার
নহে উপেক্ষিতা তব- ‘গঙ্গা বাহমনি’
আদর্শ প্রেমের ছবি সত্য সে আখ্যান,
‘-সমাধি’ নহে কাঞ্চনের খনি
মুগ্ধ বঙ্গবাসী তব পেয়ে প্রীতিদান।
হে প্রেমিক সাহিত্যিক! তোমার সাধনা
সার্থক, অব্যর্থ তব পুস্তক রচনা।”
মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্নের মৃত্যু ১৯২৩ সালের ১৮ অক্টোবর। খ্যাতনামা সাহিত্যিক শেখ মোহাম্মদ ইদরিস আলী ‘নজীব স্মৃতি’ নামে উপরের কবিতাটি লিখেছিলেন।
রাজ্যহারা মুসলমানদের তখন চরম দুর্দিন। ইংরেজ শাসনের নির্যাতন ও দমননীতি মুসলমানদের মেরুদÐ একেবারে ভেঙে দিয়েছে। ইংরেজি শিক্ষা বর্জনের ফলে বাংলার মুসলমানরা অনেক পশ্চাদপদ হয়ে পড়ে। অপরদিকে প্রতিবেশী সমাজ ইংরেজ তোষণের ফলে তাদের সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচিত হয়। প্রভুদের পদলেহন করে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং হিন্দু সমাজের সমস্ত বুদ্ধিজীবী ও কবি সাহিত্যিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কলঙ্ক কালিমা লেপন করে। বাংলা সাহিত্যকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
সময়ের এই প্রেক্ষাপটে আমাদের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, জাতীয় কবি শেখ মোহাম্মদ ইদরিস আলী, পন্ডিত রিয়াজউদ্দিন আল-মাশহাদী, মাওলানা আকরাম খাঁ, সাহিত্য রত্ন মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও আরো অনেকে শক্তিশালী ক্ষুরধার লেখনি ধারণ করেন এবং তাদের মিথ্যা ভণ্ডামিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
মুসলমান সমাজের এইে ক্রান্তিলগ্নে সাহিত্য রত্ন নজিবর রহমানের আবির্ভাব। তিনি তখন একজন দক্ষ উপন্যাসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৮৬০ সালের ২২ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুর উপজেলা, চর বেলতৈল গ্রামে জন্ম নেন নজিবর রহমান সাহিত্য রতœ। পিতা জয়েনউদ্দীন, মাতা সোনা বানু। পিতা মাতা উভয়েই অত্যন্ত ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। উভয়েই বিশেষ শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তবে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না।
নজিবর রহমানের শিক্ষার হাতে খড়ি হয় চাচা জয়েদউদ্দীনের নিকট। জয়েদউদ্দিন মসজিদের ইমাম ছিলেন। তিনি সাহিত্য রসিক ব্যক্তি ছিলেন। চাচা জয়েদউদ্দীন আহমদ ছোটবেলায়ই ভ্রাতুষ্পুত্র নজির রহমানের মধ্যে মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাকে পরম যত্নে স্নেহে বাংলা, আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় তালিম দেন। একটু বয়স হলে চাচা তাকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি করে দেন। শাহজাদপুর স্কুল থেকে ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইতিমধ্যে তার পিতৃ বিয়োগ ঘটে। চাচা তাকে ঢাকা নিয়ে এসে নবাব সলিমুল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যান। নবাবের সুপারিশে নজিবর রহমান ঢাকায় নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন। তিনি প্রথম শ্রেণিতে নর্মাল পাস করেন। সেকালে নর্মাল কোর্স ছিল তিন বছর মেয়াদী। নর্মাল পাসের পর তিনি আর উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পান নাই।
ড. গোলাম সাকলায়েন নজিবর রহমান সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করেন। নানা বিষয়ে তিনি তার তথ্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে অধ্যাপক মতিউর রহমান ও নজিবর রহমান সাহিত্য রতেœর ওপর ব্যাপক গবেষণা করে প্রচুর নিবন্ধ রচনা করেন। আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নানা তথ্য- উপাত্য লিখেছেন।
ড. সাকলায়েন নজিবর রহমানের স্কুল জীবনের শিক্ষা সম্পর্কে লেখেন:
“শাহাজাদপুর স্কুলে পড়াকালে নিজের একক প্রচেষ্টায় তিনি উত্তমরূপে বাংলা এবং কিছু সংস্কৃতিও শিক্ষা করেন। স্থানীয় স্কুলে আলেম ওস্তাদের নিকট তিনি আরবি এবং ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।”
শিক্ষাজীবন ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। নজিবর রহমান নর্মার পাস করে চাকরি গ্রহণ করেন এবং মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি স্বগ্রাম নিবাসী সুনসী মোহাম্মদ ইসমাঈল হোসেনের কন্যা শাহেরা বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু মাত্র সাত বছর পর তার স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। ১৯১২ সালে নজিবর রহমানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রী ইন্তেকাল করার পর রহিমা খাতুনকে চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। রহিমা খাতুন থেকে তিনি তার সাহিত্য চর্চায় বেশ প্রেরণা লাভ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি রহিমা খাতুনকে প্রধান শিক্ষিকা করে হাটিকুমরুলস্থ স্বীয় বসতবাড়িতে একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
নজিবর রহমান তার শেষাক্ত বিয়ে ও তার নাটকীয়তা নিয়ে ‘গরীবের মেয়ে’ নামক একটি উপন্যাস লেখেন। মূলত ‘গরীবের মেয়ে’ গ্রন্থটি আত্মজীবনীমূলক। এ উপন্যাসের নায়ক স্বয়ং তিনি, নায়িকা তার স্ত্রী রহিমা খাতুন। এতে লেখকের পক্ষপাতিত্ব চরিত্র-চিত্রন ও আখ্যান বর্ণনায় স্বভাবতই প্রতিফলিত হয়েছে।
স্কুল শিক্ষক হিসেবে নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষকতা করেই তিনি জীবিকানির্বাহ করতেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, আদর্শ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, তার শিক্ষক জীবন ছিল অতি প্রশংসনীয়। এক সময় তিনি পোস্ট মাস্টার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। অত:পর তিনি একটি সার্কেল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পরে পাবনা জেলার লালঙ্গা মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষকরূপে কাজ করেন।
নজিবর রহমান নিজকে শুধু শিক্ষকতার মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ আন্দোলনের পর নজিবর রহমান মুসলমানদের অবস্থাদর্শন করে ব্যথিত হন। তখন মুসলমানরা ইংরেজদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতার শিকার হন, এটা তার মনের মধ্যে দারুণভাবে নাড়া দেয়। তখন তিনি ‘বিলাতী বর্জন রহস্য’ একটি পুস্তক রচনা করেন। গ্রন্থটি প্রকাশের অল্পকাল পরেই বৃটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।
তিনি ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালে বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় ঐতিহ্য, স্বকীয়তা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি অক্ষুণœ রাখার জন্য নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকায় মুসলিম লীগের যে অধিবেশন হয়, তাতে নজিবর রহমান প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন।
অমর কথা শিল্পী নজিবর রহমান সাহিত্য রতœ শীর্ষক প্রবন্ধে বিশিষ্ট লেখক হামিদুর রহমান লেখেনÑ
“নজিবর রহমান একজন জাত সাহিত্যিক। সাহিত্য সাধনা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সাহিত্য সাধনার জন্য তিনি বাংলাদেশে চির অমর হয়ে আছেন। পল্লীর সাধারণ মানুষের প্রেম, ভালোবাসা, ব্যথা-বেদনা, ঈর্ষা, কুসংস্কার উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে তার উপন্যাসে। সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর প্রভাব পড়েছে তার সাহিত্য জীবন তিনি সিরাজীর প্রতি শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন।
নজিবর রহমান উপন্যাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে মোট বিশটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত তার সাহিত্য চর্চার তেমন কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে ১৯১১ সাল থেকে তার সাহিত্য চর্চা ব্যাপক ছিল।
তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে:
আনোয়ারা (১৯১৪), চাঁদ-তারা বা হাসান-গঙ্গা বাহমান (১৯১৭), প্রেমের সমাধি, পরিণাম, গরীবের মেয়ে (১৯২৩), মেহের-উন্নিসা (১৯২৩), নামাজের ফল, দুনিয়া আর চাই না, বেহেস্তের ফুল, দুনিয়া কেন চাই না (১৯২৩), রমণীর বেহেস্ত প্রভৃতি।
তিনি প্রবন্ধের বই সাহিত্য প্রসঙ্গ (১৯০৪), বিলাতী বর্জন রহস্য (১৯০৫) সালে লেখেন।
আনোয়ারা (১৯১৪) নজিবর রহমানের প্রথম সামাজিক ও পারিবারিক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক পঠিত ও বিক্রিত উপন্যাস এটি। সতী নারীর আদর্শ কেমন হওয়া উচিত, সেই সঙ্গে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা দেখিয়েছেন। এছাড়া পল্লী সমাজের কুটিলতা, পারিবারিক কোন্দল, নীতিবোধ ও শিক্ষার অভাব, হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক ইত্যাদি তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। আনোয়ারা উপন্যাস সম্পর্কে মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, ‘এ সমাজের নর-নারীর এমন টাইপিক্যাল চরিত্র নজিবর রহমানের মতো আজও কেউ চিত্রিত করতে পারেননি। এ কারণেই সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত এত অধিকসংখ্যক লোক এত আগ্রহের সঙ্গে এ বইটির রসোপলব্ধি করতে আসছে।”
‘নজিবর রহমান সাহিত্য রতœ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গবেষক ড. আনিসুজ্জামান মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন একাডেমিক কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৬ সালের পত্রিকায় প্রবন্ধের শেষে লেখেন-
‘নজিবর রহমানের শিক্ষা ও কল্পনাশক্তি পর্যাপ্ত ছিল না। ফলে ভাবধারা বা রচনা নৈপুণ্যের দিক দিয়ে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। তার রচনায় লোকপ্রিয় বিষয়বস্তু যেমন সতীত্বের জোর জটিলতামুক্ত রূপ লাভ করেছে ফলে অল্প শিক্ষিত পাঠকমহলে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছেন। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, ইংরেজি শিক্ষা ও স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাত করে তিনি সামাজিক প্রগতির সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু নজিবর রহমান যেকালে এসব বিষয় নিয়ে লিখেছেন, সেকালে মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষা ও স্ত্রীশিক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে; ফলে এখানেও তিনি সমাজকে নতুন করে পথ দেখাননি বা আঘাত করেননি।
এ ক্ষেত্রে ড. আনিসুজ্জামানের বক্তব্য পুরোপুরি সত্য নয়, আংশিক সত্য বলা যায়। তখনকার সমাজে মুসলিম সাহিত্য রচনা যদিও উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলমান গদ্য লেখক মীর মশারফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২), শ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী, কবি কায়কোবাদ (১৮৫৮-১৯৫১), কবি মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩), লেখক মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ (১৮৬১-১৯১৪), মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩), আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (১৮৬৯-১৯৫৩), মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০), মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৭৭-১৯৬৬), নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬), একরামউদ্দিন (১৮৮২-১৯৩৫), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছিলেন। নজিবর রহমান এদের সমকালে সাহিত্য চর্চায় ব্রতী হয়ে সর্বপ্রথম এবং সার্থক মুসলিম উপন্যাসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
লেখক নজিবর রহমানের প্রথম উপন্যাস ‘আনোয়ারা’ (১৯১৪) ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গ্রামীণ জীবনের পটভ‚মিকায় রচিত এ উপন্যাসে বাঙালি মুসলমান সমাজের পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত, প্রেম, বিরহ, দাম্পত্য জীবনের সঙ্কট ও সে সঙ্কট থেকে উত্তরণ এর আখ্যানবস্তু। ধর্ম ও সত্যের জয়, অধর্মের পরাজয় ও আনোয়ারার স্বামী নিষ্ঠা এ উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে কিছু অংশ দেখলে আমরা উপন্যাসের মূল বিষয় হৃদয়ে ধারণ করতে পারি। উপন্যাসিক বলেন-
“যুবক নৌকায় বসিয়া কোরআন পাঠ করিতেছেন। যুবকের দেহের বর্ণ ও গঠন সুন্দর, নবোদ্ভিন্ন ঘনকৃষ্ণ-গুল্ফ শ্মশ্রæ তাহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য আরো বাড়াইয়া তুলিয়াছে। যুবকের বয়স ত্রয়োবিংশ বৎসর। মাথায় রুমি টুপি, গায়ে সাদা সার্ট ও পরিধানে রেঙ্গুনের লুঙ্গি। এই অসাধারণ পরিচ্ছেদেও তাহাকে কোনো আমীরের বংশধর বলিয়া বোদ হইতেছে।”
১৯৫৮ সালে পাবনা জেলা তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর গোলাম সাকলাইন এবং ঐ সময় কলেজের আইএ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন থেকে অধ্যাপক, লেখক, ‘মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রতœ একাডেমি’র সভাপতি মুহম্মদ মতিউর রহমান নজিবর রহমান সাহিত্য রতœকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। নানা প্রবন্ধ লেখেন। জীবন, শিক্ষা, সাহিত্য, কর্মজীবন, সমাজসেবা, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে জাতিকে বেশ তথ্য-উপাত্য দিয়েছেন। আমরা অনেক জেনেছি। আগামী প্রজন্মও অনেক কিছু জানতে পারবে। তাদের উভয়ের নিকট আমরা সকলে ঋণী।
আজও নজিবর রহমানের সাহিত্য নিয়ে এত আলোচনা কেন? সকলে প্রশ্ন করতে পারেন। কি ছিল তার উপন্যাসে। আমিও ২০১৯ সালে আমার ছোট্ট প্রকাশনী ‘লেখালেখি’ থেকে নজিবর রহমান সাহিত্য কর্মের বিখ্যাত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস প্রথমবারের মতো প্রকাশ করি। ২২৮ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে ভ‚মিকা লেখার কথা ছিল সৈয়দ আবুল মকসুদের। নানা ব্যস্ততায় তিনি লিখতে পারেননি। আমি তাই হামিদুর রহমানের লেখা ভ‚মিকাটি উক্ত উপন্যাসের শুরুতে উল্লেখ করেছি। উক্ত ভ‚মিকায় হামিদুর রহমান প্রখ্যাত সাহিত্যিক গবেষক মুহম্মদ মতিউর রহমানের একটি বক্তব্য উল্লেখ করে নজিবর রহমানের উপন্যাসের কেন এত জনপ্রিয়তা তার কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। মতিউর রহমান বলেন –
‘নজিবর রহমান’ তার উপন্যাসে মুসলিম সমাজের বাস্তবচিত্র অতি বিশ^স্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙালি মুসলমানদের আশা আনন্দ, প্রেম, ভালোবাসা, দুঃখ-বেদনা, আচার-অনুষ্ঠান, কুটিলতা, দুর্বলতা সফলতা ব্যর্থতার এক জীবনধর্মী প্রাণবন্ত চিত্র এতে মনোরম রূপ লাভ করেছে। লেখক শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি একজন সমাজ হিতৈষী, সমাজের উন্নতি ও কল্যাণকামী আদর্শ মুসলিম। তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো সবই গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ। তাদের জীবনে যেমন স্বপ্ন আছে আশা-আনন্দ প্রেম আছে, তেমনি আছে স্খলন, পতন, দুর্বলতা ও নানা রূপ সীমাবদ্ধতা। লেখক অতি বাস্তব ও সুষ্ঠু জীবনদৃষ্টির মাধ্যমে তা অবলোকন করেছেন ও কুশলী শিল্পীর ন্যায় তার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। এ শিল্পরূপ দানের ক্ষেত্রে তিনি তার বিশ্বাস, শাশ্বত জীবনবোধ ও আদর্শ জীবন চেতনায় সর্বদা উদ্বুদ্ধ থেকেছেন। ফলে তার সবগুলো উপন্যাসের নায়ক-নায়িকাই হয়েছে তার এ বিশ্বাস, জীবনবোধ, আদর্শ চেতনা ও স্বকীয় স্বপ্ন কল্পনার বিশ্বাস প্রতিভু।”
নজিবর রহমানের জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো তার অসাধারণ প্রাঞ্জল, সহজ-সরল অনবদ্য ভাষা। মুসলিম সামাজে নিত্য ব্যবহৃত অসংখ্য আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ তিনি অসংকোচে ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া নজিবর রহমানের উপন্যাসের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো তার সাম্প্রদায়িক, মানবিক, উদার দৃষ্টিভঙ্গি।
বাংলা কথা সাহিত্যে নজিবর রহমানের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে আছে। মুসলিম কথা সাহিত্যিকদের মধ্যে মীর মোশাররফ হোসেনের পরেই তার স্থান।
তার পরবর্তী বিভিন্ন কথা সাহিত্যিকরা এ দুইজন অমর কথাশিল্পীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলা কথা সাহিত্যকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। এদের বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহ হলো:
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ‘রায়-নন্দিনী’ (১৯১৫), বেগম রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ’ (১৯০), কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুল্লাহ, একরাম উদ্দিনের ‘কাচওমনি’ (১৯২৫), ডা. লুৎফর রহমানের ‘পথহারা’ (১৯২৬) ও প্রীতি উপহার (১৯৩৩), ইব্রাহীম খাঁ, ‘বৌ-বেগম’ (১৯৫৮), গোলাম মোস্তফার ‘রূপের নেশা’ (১৯২৬), আবুল মনসুর আহম্মদের ‘সত্যমিথ্যা’ (১৯৫৩), কাজি নজরুল ইসলামের ‘বাঁধন হারা’ (১৯২৭) ও মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০), আবুল ফজলের ‘চৌচির’ (১৯৩৪) ও রাঙাপ্রভাত, আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশ বনের কন্যা,’ শহিদুল্লা কায়সারের সারেং বউ (১৯৬২), আনোয়ার পাশার ‘নীড় সন্ধানী’ (১৯৬৮), কাজী আবুল হোসেনের ‘কালো বউ,’ বন্দে আলী মিয়ার ‘নীড়ভ্রষ্ট’, মৌলভী আবুল ফাত্তাহ কোরেশীর ‘সালেহা,’ শাহেদ আলীর ‘হৃদয়-নদী’ (১৯৮৫) ইত্যাদি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক বুলবুল ইসলাম এ দেশ, এ জাতি ও সমাজে নজিবর রহমান সম্পর্কে বিস্ময়কর উদাসীনতা, উপেক্ষা ও নীরবতা দেখে বলেছিলেন-
“ফ্রানৎস কাফকা তার সুহৃদ ম্যাক্সব্রড এর উদ্দেশ্যে মৃত্যুর আগে এক লিখিত অনুরোধ রেখে যান: ‘তার সকল রচনা, প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিত চিঠিপত্র ইত্যাদি যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন সেগুলো না পড়ে শুরু থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিতে হবে।’ অবশ্য ম্যাক্সব্রড তার প্রিয়তম বন্ধুর সেই অন্তিম অনুরোধ শুধু অগ্রাহ্যই করেননি বরং তার বিপরীতেই করেছিলেন। আমার প্রায় মনে হয় কাফকার মতো নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন (১৮৬০-১৯২৩) যেন তার সকল বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্তুতি বংশধর এবং দেশের সাহিত্যিক সমাজের কাছে এক অলিখিত ও অদৃশ্য অনুরোধ লিখে গিয়েছিলেন: তার জীবনের ইতিহাস যেন লিখিত না হয়- হারিয়ে যায় এবং তার রচনাবলী যেন ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়।”
সীমাহীন অবহেলা আর উপেক্ষার মধ্যেও নজিবর রহমান অত্যুজ্জ্বল এবং এখনও সাহিত্য রতœ। মৃত্যুর এক শতাব্দীর অধিক হলেও তার সাহিত্য পাঠকের হৃদয়ে রত্নের দ্যুতিতে উদ্ভাসিত। অনেক দেরি হলেও ২০০০ সালে তার সাহিত্যকর্মের ওপর গবেষণা (এমফিল) করেছেন কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। অভিসন্দর্ভের শিরোনাম- “মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন : জীবন ও সাহিত্যকর্ম।” তিনি আরও একটি কারণে অত্যুজ্জ্বল থাকবেন বাংলা সাহিত্যে। তাহলো তিনি নিজস্ব একটা আদর্শ প্রতিফলিত করে গেছেন তার সাহিত্যকর্মে, সমকালীন কারো দ্বারা প্রভাবিত হননি। বরং তাকে অনুসরণ করেছেন সমকালীন অনেক কবি-সাহিত্যিক। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনোয়ারা’ (১৯১৪) এর অনুসরণে লিখিত হয়েছে মোহাম্মদ ফোরকান আলীর ‘মনোয়ারা’ (১৯২৫), আবদুল ফাত্তাহ কোরেশীর ‘সালেহা’ (১৯২৬) এবং মোজাম্মেল হকের ‘জোহরা’ (১৯২৭)। শেখ ইদরীস আলীর ‘প্রেসের পথে’ গ্রন্থে সাহিত্য রত্নের ‘প্রেমের সমাধি’ রই প্রতিফলন ঘটেছে। এছাড়া ডা. লুৎফর রহমান ও কাজী ইমদাদুল হকের মতো সাহিত্যিকদের মধ্যেও নজিবর রহমানের প্রভাব লক্ষণীয়। এ মহান সাহিত্য রত্ন ১৯২৩ সালে ১৮ অক্টোবর আক্ষরিক অর্থে পরকালে গমন করলেও এখন পর্যন্ত ভক্ত পাঠকদের মনিকোঠায় জাগরুক হয়ে আছেন এবং থাকবেন চিরকাল।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।