Ahmed Sofa

আহমদ ছফা একজন প্রতিবাদী কথা সাহিত্যিক

“এই বাঙাল মুলুকে আমাদের স্থিতি হয়েছিল সেই কবে মোগল আমলে। মোগল আমল, নবাবী আমল, ইংরেজ আমল কতো কাল এলো গেলো। কতো রাজ্য কতো রাজা এসেছে আর গিয়েছে। কত যুদ্ধ বিগ্রহ, ধ্বংস সৃষ্টি, বিপ্লব উপবিপ্লব সব কিছুর আঘাত সহ্য করেও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পরিবার। কোন আকস্মিক বিপদ আপদই আমাদের পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। অখন্ড প্রতাপ খন্ড খন্ড হয়ে পড়েছে, বিশাল জমিদারি কোথায় বিলীন হয়েছে। তারপরও এক পুরুষের পর এক পুরুষ এসেছে। হৃদয় লালিত অহংকারে ভরিয়ে দিয়ে গেছে উত্তর পুরুষের বুক। বংশপঞ্চিত তাদের আশ্চর্য সব নাম পাঠ করে আর ততোধিক আশ্চর্য কীর্তি কাহিনী শ্রবণ করে আমি নিজেও কতোবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছি। এ সম্মোহনের মধুর স্বাদ কি করে কাটাই।


লেখক, লেখক শিল্পী, চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান বিদ্রোহী, অভিমানী লেখক আহমদ ছফার বিখ্যাত ছোট উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ এর কিছু অংশ।
লেখক অনেকেই হন, তবে মনীষী লেখক আমরা তাদেরকে বলি যাঁদের রচনায় একই সঙ্গে যুগ যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনা মূর্ত হয়ে উঠে। আহমদ ছফা ছিলেন আমাদের দেশের সে রকম এক বিরলদৃষ্ট জনপ্রিয়তাসম্পন্ন লেখক। লিপিকুশলতার সঙ্গে মনীষার এমন মানকাঞ্চন যোগ সচরাচর ঘটে না, সব লেখকের বেলায় তো নয়ই। আহমদ ছফার প্রজ্ঞা, মননশীলতা, অর্ন্তদৃষ্টি, ইতিহাসবোধ, ঐতিহ্য সচেতনতা, মানবপ্রীতি সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁকে সাহিত্যিক পরিচয়ের উর্ধ্বে আমাদের কালের এক চিন্তানায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।


আহমদ ছফা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ৩০শে জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। অবিবাহিত আহমদ ছফা জীবন পার করেন। কেন তা জানা নাই।


আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তার পিতার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। তিনি ১৯৫৭ সালে নিজ গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ পাশ করেন। তখন এসএসসি কে ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ বলা হতো। ছাত্র জীবন থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সুধাংশু বিমল দত্তের সাহচায্যে তিনি কৃষক সমিতি ন্যাপ বা তৎকালিন গোপন কমিনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্য সেনের আদর্শে অনুপ্রাািণত হয়ে তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম দোহাজারী রেল লাইন উপড়ে ফেলেন। কিছুদিন গ্রেফতার এড়াতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপনে থাকেন। ১৯৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেন। সেই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়া হয়নি। ১৯৬৭ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ডিগ্রী পাশ করেন। ১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেয়ার পূর্বে বাংলা একাডেমীর এক বৃত্তি পেয়ে পিএইচডির উদ্দেশ্যে তিন বছরের জন্য ফেলেশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনিত হন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের-জন্য জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন।


এদিকে ১৯৭১ সালে তিনি প্রাইভেটে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। তারপক্ষে পরে পিএইচডি শেষ করা সম্ভব হয় নাই। ১৯৭১ সালে লেখক সংগ্রাম শিবির গঠন করে নানা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘প্রতিরোধ’ প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে কলিকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘দাবানল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়েন।


১৯৮০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় ঢাকার কাঁটাবনের বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষা কেন্দ্র’ চালু করেন।


১৯৮৬ সালে এই লেখক জার্মান ভাষার উপর গ্রেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তী লেখক জীবনে গ্রেটের অমর সাহিত্য কম ‘ফাউস্ট’ অনুবাদ করা তার পক্ষে সহজ হয়ে পড়ে।


আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রতিটি স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনী মিলিয়ে প্রায় ত্রিশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। আহমদ ছফা রচনাবলী তার জীবিত থাকাকালিন প্রকাশিত হয়। নিয়মিত পত্র পত্রিকায় তিনি লিখতেন। তার সব চেয়ে জনপ্রিয় লেখা হচ্ছে আবদুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা ‘মদ্যপ আমার গুরু’।


স্বাধীনতার পর পর ১৯৭১ সালে আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ মুক্তধারা প্রকাশ করে। ১৯৭২ সালে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ এবং ১৯৭৯ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস’ ও ১৯৮১ সালে বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থ প্রকাশের পর দেশে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৯৭২ সালে দৈনিক গণকন্ঠ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ‘বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখার ফলে সরকারের রোষে পড়েন। সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিষ্ঠিত লেখকগণ প্রতি সপ্তাহের লেখা পড়ার জন্য আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতেন। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-দীর্ঘ এ কালখন্ডে বুদ্ধিজীবিরা কিভাবে আত্মবিত্তির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন, কিভাবে পুরস্কার, পদক পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য উপাত্তসহ জাতির সামনে লেখনির মাধ্যমে তোলে ধরেন।
লেখক আহমদ ছফার কথায়:-


“আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী ছিলেন,
বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। তখন
অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন-সেও ঠেলায় পড়ে।


দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির পক্ষে প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদ-এসব বিষয়কে আহমদ ছফা দেখেছেন লেখকের মেরুদন্ডহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসাবে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তে লেখক সমাজের নিস্ক্রিয়তা, যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগ বিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আহমদ ছফা উল্লেখ করেছেন তখনকার বুদ্ধিজীবী, লেখক সমাজ কতটা অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী ছিলেন।


আহমদ ছফার বিখ্যাত রচনা সমূহের মধ্যে প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, শিশু সাহিত্য, অনুবাদ, কবিতা বিশেষভাবে আলোচিত। যেমন: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), সন্ধ্যার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান পতন (১৯৮৮), অলাতচক্র (১৯৯৩), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬), মদ্যাপি আমার গুরু (১৯৯৮), ফাউস্ট (১৯৮৬), মরণ বিলাস (১৯৮৯), সূর্য তুমি সারথী (১৯৬৭), তানিয়া (১৯৬৭)।
কাব্য: জল্লাদ সময় (১৯৭০), দুঃখের দিনে দোহা (১৯৭৫), একজন প্রবীন বটের কাছে প্রার্থনা (১৯৭৭) লেলিন ঘুমাবে এবার (১৯৭৭), গল্প: নিহত নক্ষত্র (১৯৬৭)
কিশোর গল্পে: দোলা আমার কনকচাঁপা (১৯৬৮)
শিশুতোষ ছড়া: গো-হাকিম (১৯৭৭)
অনুবাদ: তানিয়া (১৯৬৭), সংশয়ী রচনা (১৯৮১)
আহমদ ছফা সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে কিছুদিন পদ্ধতিগত গবেষণা করেন। কিছুদিন পর তা ছেড়ে দিয়ে তিনি মৌলিক রচনা ও চিন্তাচর্চায় আত্মনিবেশ করেন। মাঝে মাঝে সাংবাদিকতা করেন। পত্রিকা প্রকাশ, প্রেস ব্যবসা, এনজিও কার্যক্রম পেশা হিসেবে নিলেও আজীবন লেখালেখিই ছিল তাঁর মুল কাজ। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থটি ছাত্রজীবনে লিখেছেন। কিন্তু তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাক্ষী।’
আহমদ ছফার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে।


“আমি জাতি হিসেবে বাঙালি মুসলমানের অপূর্ণতা, অক্ষমতা এবং অসহায়তার দিকটাই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। বাঙালি মুসলমানেরা এদেশের মাটির আসল সন্তান। তারা প্রভুত্বকামী আর্যদের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত নয়, তেমনি আগ্রাসী তুর্কি, তাতার, ইরানী, তুরানীদেরও কেউ নয়। শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমান একটা নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী।


‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানদের হীনমন্বতার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন এবং পাশাপাশি এর বাস্তব ও যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরেছেন। আহমদ ছফার মতে, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিতম উৎস।
তাঁর মতে বাঙালি মুসলমানের হীনম্মন্যতার শিকড় ও বর্ণাশ্রম প্রথাতে প্রেথিত আছে। আর শাসন শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বাঙালি মুসলমান স্বাধীন চিন্তাকে ভয় করে।”


আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যে তথা বিশ্ব সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক। আহমদ ছফা গল্প বলা খুবই অল্প বয়সে রপ্ত করেছিলেন। তাই পাঠকরা সহজে তার ডাকে সাড়া দেয়।


সূর্য তুমি সাক্ষী (১৯৬৭) গ্রন্থটি আহমদ ছফার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। উপন্যাসটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হৃদয়গ্রাহী উপখ্যান বলা হয়েছে। যদিও ‘বরুমতির আঁকে বাঁকে নামক একটি গ্রন্থও তাঁর প্রথম গ্রন্থ বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন।
আহমদ ছফা চারটি বা পাঁচটি কাব্য গ্রন্থ রচনা করেন। তা পূর্বে উল্লেখ করেছি। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধের পাশাপাশি কবিতা চর্চায় তিনি দক্ষ হাতের মাঝি ছিলেন।


“খড়গ্ হচ্ছে নৃত্য কর জল্লাদ সময়
তোমার সুস্থির হওয়া বড় প্রয়োজন
সকলে বিশদ জ্ঞানে তবু হয় অন্ধকারে খুন
অস্ত্রহীন তাই কেহ বিনা খুনে দায়ভাগী হয়।
কেন্দ্রহীন হে সময় ছিন্ন ডানা রাক্ষসীর মত
শরীরে গড়িয়ে চল একটানা নীতিহীন বলে
তোমার রবের চাকা ঠেকে দেখ কোন রসাতলে।
মূল্যের বৃক্ষের মূলে অহরহ হানছ আঘাত।”
-জলাদ সময়


আহমদ ছফার উপন্যাস ওঙ্কার বেশ কিছু লেখা ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ওঙ্কার উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। তার পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরান উপন্যাসটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ হয়। তিনি বেশ কিছু গানও লিখেছেন। গ্যোটের ফাউস্ট কাব্যনাট্যের বঙ্গানুবাদ তাঁর এক অমর কীর্তি।
নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ও প্রতিবাদী বক্তব্যের জন্য আজীবন তিনি ছিলেন আলোচ্য ও বিতর্কের কেন্দ্র। পাশাপাশি নতুন প্রতিভা আবিষ্কার ও তার লালন এ নবীনদের মধ্যে চিন্তা উসকে দেয়ার ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না।


বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আহমদ ছফা একজন ছিলেন। তবে তিনি এই সংগঠনের দেয়া পুরস্কারও তিনি গ্রহণ করে নাই।
সমাজের বঞ্চিত শিশুদের জন্য তিনি সুলতান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম কীর্তি।


আহমদ ছফা সম্পর্কে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসের ভুমিকায় বলেন, “আহমদ ছফা সাহিত্য চর্চা শুরু করেন উপন্যাস দিয়ে। বেশ কয়েকটি ছোট গল্প লিখে হাত মসকো করার প্রচলিত নিয়ম তিনি মানেননি, তাঁর প্রকাশিত প্রথম বইটিও একটি উপন্যাস। ছফার উপন্যাস আকারে ছোট হলেও কোনোটাই কিন্তু ছোটো গল্পের সম্প্রসারণ নয়, এগুলো একেবারেই উপন্যাস। চেনা জানা জীবনের ভেতরের ব্যাপারটা নানা দিক থেকে ব্যাথার দায়িত্ব নিয়ে সমাজ ও রাজনীতির ভাঙাচোরায় কাজ করছে কোন রহস্য, তারই অনুসন্ধানে ছফা নিয়োজিত। মুখ ও স্বস্তি জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি কাজ করেন এমন সব পরিবেশ নিয়ে যা বেশীর ভাগ সময়ে তাঁর স্বভাবের মনখুল নয়। পাঠককে তিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন যাদের সঙ্গে বেশীর ভাগ সময়েই তিনি নিজে বা তাঁর পাঠকেরা তাদের পছন্দ করেন না; অন্তত তাদের অনেকে কান্ডকীর্তিতে সায় দেয়া মুশকিল। সেই খুচরো খাচরা ও টুটাফোটা মানুষের একেকটা আস্ত চেহারা তৈরি করতে ছফাকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয় এবং পাঠককে তিনি উস্কে দেন এ যুদ্ধে নেমে পড়তে।


আহমদ ছফার প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্পে বর্ণনা, কৌশল ,চরিত্র চিত্রন রীতি এবং অনুভুতি স্নিগ্ধ ও হৃদয়গ্রাহ্য ভাষাই মনকে গ্রাস করে। তাঁর রচনার অন্তর্গত সংবেদনশীলতাই বক্তব্যের গভীরে টেনে নেয়। মনে হয়, একটি মহাকাব্যের বিষয়কে যেন সনেটে বেঁধে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তার উপন্যাসে।


পশ্চিম বঙ্গের লেখক সিদ্ধার্থ ঘোষ ‘সাহিত্য ধারা’ পত্রিকায় লেখক আহমদ ছফা সম্পর্কে বলেন-
“ক্ষতিষ্ণু সমাজের প্রতিনিধি (বাবা বাংলা মার মুখে ভাষা ফোটাতে পারবে না, এ কাজ একমাত্র শক্তিমান সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব। এই কথা কটি যে কতখানি সত্য তা আমরা এখানে (পশ্চিম বাংলায়) সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারছি।”


আহমদ ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাজ্যিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনা শৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থ সামজিক সুক্ষাতিসু² অনুষজ্ঞসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনীকথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। অধ্যাপক আবুল ফজলের মতে স্বাধীনতা উত্তর আহমদ ছফার উপন্যাস স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ।


আহমদ ছফা ও তার রচনাকর্ম দেশের অনেক লেখক, শিল্পী, কবি চলচ্চিত্রকার ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ুন আহমদ, ফরহাদ মজহার, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ এবং সমিুল্লাহ খান। অনেকের মতে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন আহমদ ছফা।


বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধক ও উপন্যাসিক বলে বিবেচিত আহমদ ছফা ছিলেন ‘সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠা ও প্রগতিপন্থী একজন সংস্কৃতিকর্মী। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতে ‘ছফার রচনাবলী গুপ্ত ধনের খান এবং সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যে কোন পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।


কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদ, আহমদ ছফাকে ‘অসম্ভব শক্তিধর একজন লেখক বলে অভিহিত করেছেন। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতে ‘আহমদ ছফা চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক। জাফর ইকবাল আরও বলেন “আমাদের সৌভাগ্য তার মত একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।”


বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী, কবি ফরহাদ মজহার বলেছেন আহমদ ছফা গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি গ্রামের ছেলে। কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে সে যে উত্থাল পাথাল ধাক্কা দিয়ে গেল তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলি, সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বলি তার সঙ্গে খোদ একটা বোঝাপড়া না করে কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রসর হওয়া যাবে না।


এই অসাধারণ সাহিত্যিক আহমদ ছফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমদ শরীফ বলেন, “সুবিধাবাদীদের Life is a compromise তত্তে¡ ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।
সরকার ফজলুল করিম বলেছিলেন, “ছফা কেবল পাঠ করার বিষয় নয়, চর্চা করার বিষয়।” আহমদ ছফার সাহিত্য এক একটি যেন শব্দ যেন শিলাখন্ডের মত ভারী। তার মধ্যে রয়েছে গভীর ভালোবাসা, মমতা তার কোনো হিসাব নাই।অমর এই কথা শিল্পী ২০০১ সালে ২৮শে জুলাই, অতি অল্প বয়সে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments