“মতিউর রহমান মূলত একজন সাহিত্যিক। দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থেকেও তিনি তার সাহিত্যকর্ম সর্বদা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে নিরলসভাবে গবেষণা ও লেখালেখি করে গিয়েছেন।”
কথাগুলো বলেছেন ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ তার লেখা প্রবন্ধ ‘ফররুখ গবেষক অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমানের জীবন ও কর্ম প্রবন্ধের মাঝে’।
অধ্যাপক মতিউর রহমান ছাত্র জীবন থেকে সাহিত্য নিয়ে তার বেড়ে ওঠা। স্কুল জীবন থেকে লেখালেখির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করা তার চরিত্র ও কর্ম। সাহিত্যকে তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। আমৃত্যু তাই তিনি সাহিত্য চর্চায় নিজকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সাহিত্যের মূল বিষয় চিন্তা ও গভীরতা তার নানা লেখায় ফুটে উঠেছে। তাই তার লেখায় তিনি বলেন-
“ভাব ও কল্পনার সংমিশ্রণে অনুভূতির জারক রসে জারিত হয়ে কোনো কিছু যখন সৌন্দর্যময়, ছন্দময়, আনন্দময় হয়ে ইন্দ্রিয়লোকে সাড়া জাগায়, তখন সেটাকে শিল্পরূপে গণ্য করা চলে। শিল্প এমন এক নান্দনিক বিষয় যা মানুষের সুপ্ত কামনা-বাসনা, স্বপ্ন-কল্পনা ও অনুভূতিকে জাগ্রত করে, আলোড়িত-উদ্বোধিত করে এবং মানুষের মানবিক সত্তাকে স্পন্দিত করে তোলে। সে কারণে প্রকৃত শিল্পকে কবিতা বা প্রকৃত কবিতাকে অনায়াসে শিল্প বলা যায়। তবে সব শিল্প যেমন কবিতা নয়, তেমনি সব কবিতাও শিল্প নয়। যদিও সব শিল্প বা কবিতায় শিল্পের মৌল স্বভাবের কিছু না কিছু প্রতিফলন ঘটে থাকে।’
মুহম্মদ মতিউর রহমান ১৯৩৭ সালে ১৮ ডিসেম্বর বাংলায় ৩ পৌষ, সোমবার ১৩৪৪ সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্গত শাহজাদপুর থানার চর বেলতৈল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু মুহম্মদ গোলাম রাব্বানী, মাতা মোছাম্মৎ আছুদা খাতুন। তার পূর্ব পুরুষ এলাকায় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সুখ্যাতি অর্জন করেন। সে সুবাদে তাদের বাড়িটি ‘প-িত বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। মতিউর রহমান পিতা মাতার তিন পুত্র ও নয় কন্যার মধ্যে ষষ্ঠ সন্তান। তার স্ত্রী বেগম খালেদা রহমান। তাদের দুই পুত্র ও দুই কন্যা রয়েছে।
মতিউর রহমান গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৫০ সালে নরিনা মধ্য ইংরেজি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৬ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫৮ সালে আইএ এবং ১৯৬০ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬২ সালে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৬২ সালের নভেম্বরে মতিউর রহমান ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী নৈশ কলেজে অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি উক্ত কলেজে অধ্যাপক, ভাইস প্রিন্সপাল এবং ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মাঝে ১৯৬৫ সালে চার মাসের জন্য করটিয়া সা’দত কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে থাকাকালীন ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ঢাকাস্থ আমেরিকান প্রকাশনা সংস্থার ‘ফ্রাংকলিন বুকস্ প্রোগ্রামস’ সহকারী সম্পাদক ও প্রথম বাংলা বিশ্বকোষ প্রকল্পের অন্যতম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি দুবাই চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ প্রকাশনা বিভাগে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মের সাথে সাথে তিনি সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে যান।
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এশিয়ান ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মতিউর রহমান সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। লিখেছেনও বেশ ভালো। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হচ্ছে:
সাহিত্য কথা (১৯৭০), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৭০), সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতি (১৯৭১), মহৎ যাদের জীবন কথা (১৯৮৯), ইবাদতের মূল ভিত্তি ও তার তাৎপর্য (১৯৯০), ফররুখ প্রতিভা (১৯৯১), বাংলা সাহিত্যের ধারা (১৯৯১), বাংলা ভাষা ও ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন (১৯৯২), ইবাদত (১৯৯৩), মহানবী (সঃ) ১৯৯৪, ছোটদের গল্প (১৯৯৭), ঋৎবফড়স ড়ভ ৎিরঃবৎ (১৯৯৭), বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য (২০০২), রবীন্দ্রনাথ (২০০৪), স্মৃতির সৈকতে (২০০৪), ফররুখ প্রতিফা (২০০৮), সংস্কৃতি (২০০৮), বাংলাদেশের সাহিত্য (২০০৮), ও সাহিত্য চিন্তা (২০০৯) প্রভৃতি।
অনুবাদ: ইরান (১৯৬৯), ইরাক (১৯৬৯), আমার সাক্ষ্য (১৯৭১)।
সম্পাদিত গ্রন্থ: প্রবাসীর কণ্ঠ (১৯৯৩), প্রবাস কণ্ঠ (১৯৯৪), ভাষা সৈনিক সংবর্ধনা স্মারক (২০০০)।
প্রকাশের পথে : কিশোর গল্প, নানা প্রসঙ্গ, সমকালীন বাংলা সাহিত্য, আরব উপসাগরের তীরে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আশির দশকের কবি ও কবিতা ইত্যাদি।
শুধু লেখনি নয় সংগঠক হিসেবে মতিউর রহমান ছিলেন সকলের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর। তার একক প্রচেষ্টায় তিনি গড়ে তুলে ছিলেন ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন। প্রকাশ করেছেন ‘ফররুখ একাডেমী পত্রিকা’। তিনি প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন মোহম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন একাডেমি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি দেশে- বিদেশে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ইংলিশ স্কুল’ দুবাই এর পক্ষ থেক স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়।
মতিউর রহমানের সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই তার মৌলিক গ্রন্থ ‘সংস্কৃতি’ সম্পর্কে না বলে পারা যাবে না। তিনি উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় যা উল্লেখ করেছেন, তা থেকে তার সাহিত্যের গভীরতার পরিমাপ করা যাবে। তিনি লিখেছেন,
‘সংস্কৃতি একটি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। এক কথায় এর অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন শব্দে এর অর্থ প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছেন। ইংরেজি Culture এর প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলায় সংস্কৃতি, কৃষ্টি, তমদ্দুন ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়ে আসছে। বিভিন্ন মনীষী এসব শব্দের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা প্রদান করে এর অর্থ বুঝাবার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটির অধুনা সর্বাধিক প্রচলিত ও ব্যবহৃত মনে হওয়ায় উক্ত শব্দটি এখানে গ্রহণ করা হলো।’
ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ তার এক প্রবন্ধে মতিউর রহমানের ‘সংস্কৃতি’ গ্রন্থ সম্পর্কে লিখেছেন,
“এ দিক বিবেচনা করে মুহম্মদ মতিউর রহমান বলেছেন, যে শব্দ জনগণের নিকট সহজবোধ্য ও দৈনন্দিন জীবনে কোনো বিশেষ এলাকার মানুষ যেসব শব্দ ব্যবহার করে থাকে সেটাই প্রকৃতপক্ষে সে এলাকার জনগণের নিজস্ব শব্দ। হতে পারে সে শব্দের মূল হয়ত বিদেশি ভাষার মধ্যে গ্রন্থিত থাকতে পারে। মতিউর রহমান সংস্কৃতি ও সভ্যতার (Culture and civilization) মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে নিরূপণ করেছেন। তাহজিব তমুদ্দুন প্রভৃতি শব্দের অর্থ বিশেষ করে সংস্কৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীর চিন্তাপ্রসূত ধ্যান-ধারণা ও জীবনানুশীলন কর্মে প্রযুক্ত ধ্যান ধারণা মোটামুটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার বিশ্বাস, সংস্কৃতি বলতে যেমন, সভ্যতা বলতেও তেমনি ভদ্রতা, শিষ্ঠতা, উৎকর্ষ, পরিমার্জন, সুরুচি, শিক্ষা, সাহিত্য, স্থাপত্য ইত্যাদি বুঝায়। তার কথায় পরিশ্রুত, পরিশীলিত, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন, সংস্কৃতিবান ব্যক্তিকেই সভ্য মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়।’
মতিউর রহমানের সর্বাধিক মূল্যবান গ্রন্থ হচ্ছে ‘ফররুখ প্রতিভা’। বাংলা সাহিত্যের অসামান্য মৌলিক প্রতিভাধর কবি ফররুখ আহম্মদ (১৯১৮-১৯৭৪)। তার সাথে মতিউর রহমানের সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তিনি কবি খুবই ভালোবাসতেন, তাই কবির সম্মতির উদ্দেশ্যে গঠন করেছিলেন ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন। দীর্ঘ তিন দশককাল মতিউর রহমান ফররুখ গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন। গবেষণা করেছেন। প্রচুর প্রবন্ধও লিখেছেন। নিয়মিত ফররুখ সাহিত্য পুরস্কারও দিয়ে গিয়েছেন। একবার ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। সালের কথা আমার ঠিক মনে নেই। সেই অনুষ্ঠান হয়েছিল মগবাজার কবি নজরুল একাডেমিতে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি এক প্রস্তাবের মাধ্যমে আমাকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করে আমাকে সম্মানিত করেন। আজও অবদি ২০২১ সালের এই দিন পর্যন্ত এই সংগঠনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিটি রয়েছে। তার মৃত্যু ৪ এপ্রিল ২০২১ সালে ৮৪ বছর বয়সে ঢাকায় হয়েছে। করোনার প্রেক্ষিতে মৃত্যুর পর ভার্সুয়ালি তার স্মরণ সভা আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হলো। আল্লাহপাক তাকে তার সকল সুকর্মের হাদিয়া দান করুক এ কামনা করি।
ফররুখ প্রতিভা গ্রন্থটি সম্পর্কে আলোচনা করলেই লেখক মতিউর রহমানের জ্ঞানের গভীরতা আমরা সহজে বুঝতে পারবো। তার রচিত ৪৩২ পৃষ্ঠার এ বিশাল গ্রন্থে ফররুখ আহমদ সম্পর্কে ২১টি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
‘ফররুখ কাব্য বৈচিত্র্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক মতিউর হমান ফররুখ আহমদ সম্পর্কে বলেন-
‘ফররুখ আহমদও বৈচিত্র্য প্রয়াসী। একজন শক্তিমান মৌলিক কবি হিসেবে তার বৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রয়াস অধিকমাত্রায় লক্ষ্যযোগ্য। সেজন্য সাধারণ কবিদের থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন বহুলাংশে স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল। তার সৃষ্টির মধ্যে তার নিজস্বতা বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে, তিনি হয়ে উঠেছেন এক অসাধারণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কবি প্রতিভা। তার কাব্যের বিষয়, ভাষা, শব্দ চয়ন কৌশল, উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের ব্যবহার ও সর্বোপরি কাব্যের আবহ ও আবেদন সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার যে স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে, সেটাই তাকে একজন মৌলিক কবির শিরোপা দান করেছে।’
অধ্যাপক মতিউর রহমান ফররুখ কাব্যের বৈচিত্র্য বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তুলনামূলকভাবে কবি কায়কোবাদ, কবি নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কিছু কিছু অবতারণা করেছেন। উক্ত প্রবন্ধে মতিউর রহমান লিখেছেন-
“রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বলতে গেলে, তার পূর্বসূরিদের থেকে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা। রবীন্দ্র যুগে জন্মগ্রহণ করে রবীন্দ্র বলয়ে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ থেকে তিনি ভিন্ন। বিষয়ের দিক থেকে তিনি ইসলামি আদর্শ ও ঐতিহ্যানুসারী, ভাবের দিক থেকে বিপ্লবী, স্বাদেশিক ও নিপীড়িত মানবতার সপক্ষে এবং কল্পনার দিক থেকে সম্পূর্ণ আধুনিক ও রোমান্টিক। তার সৃষ্টি বৈচিত্র্য অসাধারণ ও আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তার কাব্যে একদিকেও যেমন বিদ্রোহের রণতূর্য নিনাদিত, অন্যদিকে তেমনি সনাতন প্রেমের করুণ-বিধুর রস সঞ্চালিত। তার কাব্যের ভাব-ভাষা বিষয় ও আবেদন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র সুস্পষ্ট।”
“নজরুলের পরে বাংলা কাব্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবিদের অন্যতম ফররুখ আহমদ। নজরুলের সাথে ফররুখ আহমদের বহুদিক থেকে সাযুজ্য রয়েছে। বিষয়ের দিক থেকে ফররুখ ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্যের অনুসারী। ভাবের দিক থেকে আধ্যাত্মিক ও মানবতাবাদী, ভাষার দিক থেকে তিনি অনেকটা নজরুল অনুসারী, প্রকাশভঙ্গির ক্ষেত্রে আধুনিক এবং কল্পনার দিক থেকে তিনি সম্পূর্ণ রোমান্টিক ও পুনর্জাগরণ-প্রয়াসী। ফররুখ আহমদের বিভিন্ন রচনাবলী অধ্যায়ন করলে আমরা এর যথার্থতা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। এ বৈচিত্র্য প্রত্যেক কবি-স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য প্রত্যেক কবিকে তার সমহিমায় সমুদ্ভাসিত করে।”
বাংলা সাহিত্যে মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন (১৮৬০-১৯২৩) ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস ১৯১৪ সালে লিখে বাংলা সাহিত্য জগতে একটি শক্তিশালী আসন লাভ করেন। আনোয়ারা নজিবর রহমানের প্রথম সামাজিক ও পারিবারিক উপন্যাস।
আজ থেকে ১০৫ বছর পূর্বে ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস মুসলিম সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। নজিবর রহমান সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে মতিউর রহমান মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন একাডেমি গঠন করে তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও প্রকাশনা করেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে অমর কথা শিল্পী মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্নের ১৫৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি তার সম্পাদনায় একটি সংকলন প্রকাশ করেন।
উক্ত সংকলনে এক প্রবন্ধে অধ্যাপক মতিউর রহমান নজিবর রহমান সম্পর্কে বলেন –
“নজিবর রহমান বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক মুসলিম কথাশিল্পী যার লেখায় বাঙালি মুসলিমের ব্যক্তি পরিবার ও সমাজ জীবনের চিত্র, তাদের অধপতনের কারণ, উন্নতির সুব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত চিত্তাকর্ষকভাবে ফুটে উঠেছে। সরাসরি, নারী-পুরুষের আদর্শ প্রেম, মানবিক প্রেম-ভালোবাসা, মানুষে মানুষে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, উচ্চ নৈতিকতাবোধ, মহত্তম মানবিক গুণ ও উদার মানবিক রসে জারিত তার সাহিত্য। এ কারণে তার সাহিত্য এক চিরায়ত ধ্রুপদ বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে এবং লেখক বাংলা কথা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভে সমর্থ হয়েছেন।”
অধ্যাপক মতিউর রহমানের ‘সাহিত্য চিন্তা’ গ্রন্থ একটি আদর্শ গবেষণামূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে লেখক মোট দশটি প্রবন্ধে বইটি লেখা সমাপ্ত করেছেন। প্রবন্ধের শিরোনাম হচ্ছে:
সাহিত্য চিন্তা, সাহিত্যে সুনীতি, রোমান্টিকতার স্বরূপ, ইসলামি সাহিত্যের রূপ ও সংজ্ঞা, সাহিত্যের সৃষ্টিপোষকতায় মহানবী (সঃ), আমাদের ভাষা-চিন্তা, আমাদের ভাষার স্বাতন্ত্র্য, আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের পরিচয় সন্ধানে, আমাদের সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য, বাংলা কবিতার ঐতিহাসিক পেক্ষাপট।
উক্ত শিরোনাম দেখে গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি।
ইসলামি সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের সাহিত্য জগতে সাহিত্যিকদের তেমন কোনো ধারণা নাই। অনেকে ইসলামি সাহিত্য কি হতে পারে? এমন চিন্তাও করে থাকেন। তাকে অনেকে সাহিত্যের মর্যাদাও দিতে চান না। তাই অধিকাংশ মুসলিম কবি সহিত্যিকরা সাধারণ মানুষের মতো সাহিত্য চর্চা করে থাকেন। কিন্তু মুসলিম হিসেবে সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে ইসলামি ধ্যান ধারণা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই অবহিত হওয়া অত্যাবশ্যক। বিশেষত যারা তরুণ, তাদের সামনে সাহিত্য সম্পর্কে ইসলামের ধ্যান ধারণা তুলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব। মতিউর রহমান এ গুরুদায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালনের চেষ্টা করেছেন। আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে তিনি এক অসাধারণ কাজ আগাম দিয়েছেন। এই গ্রন্থখানি আমাদের সকলের পাঠ করা উচিত। বিশেষত কবি সাহিত্যিকদের জন্য এবং সাহিত্য নিয়ে যারা চিন্তা গবেষণা করেন, তাদের জন্য এই গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক মতিউর রহমান সত্যিকারের কবি ফররুখ ভক্ত ও অনুরাগী ছিলেন। ফররুখকে নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন, গবেষণা করতেন। প্রচুর প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। শৈশবকালে যে সকল কবির কথা পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন, ফররুখ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে ফররুখের সাথে মতিউর রহমানের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তার কাব্যের প্রতি অনুরাগের ফলে কবির শেষ জীবনে প্রতিটি সন্ধ্যাবেলা কেটেছে তার ইস্কাটনের সরকারি বাসভবনের ড্রইংরুমে। মতিউর রহমান ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিদেশে ছিলেন। বিদেশে থেকেই তিনি ফররুখ প্রতিভা (১৯৯১) নামে গ্রন্থটি রচনা করেন। সুদূর বিদেশে তিনি ফররুখ আহমেদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে প্রবাসীদের নিয়ে তিনি সভা-সেমিনার আয়োজন করেছেন।
ফররুখ চর্চাকে ব্যাপকতর করা এবং ফররুখ একাডেমী পত্রিকা মানসম্মতরূপে প্রকাশের উদ্দেশ্যে তিনি দেশের প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিক গবেষকদের শরণাপন্ন হন। তিনি নিয়মিতভাবে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের ফররুখের ওপর লেখা নিয়ে ‘ফররুখ একাডেমী পত্রিকা’ নিয়মিত প্রকাশ করে গিয়েছেন। ২০১৬ সালে নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন একাডেমী নামে পত্রিকা বের করে সাহিত্য অঙ্গনে নজিবর রহমানকে নতুন করে যুব সমাজের নিকট পরিচিত করে তোলেন।
মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন একাডেমীর সভাপতি হিসেবে প্রকাশিত পত্রিকার ভূমিকায় অধ্যাপক মতিউর রহমান আশাবাদ করে বলেন-
“আমার বিশ্বাস, একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃতি প্রায় অমর কথা সাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্নের জীবন ও সাহিত্যের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার সূত্রপাত হলো। এর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক সম্পর্কে লেখক, গবেষকদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। আমাদের আয়োজন ক্ষুদ্র, সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা সামান্য, তবে নিষ্ঠা এবং লক্ষ্যে পৌঁছাবার প্রত্যয় দৃঢ় মনোবল ঘাটতি নেই।”
আমরা আজ একজন নিবেদিত ফররুখ ও নজিবর রহমান গবেষককে হারিয়েছি। অক্লান্ত পরিশ্রম, নিবেদিত সাধনা দিয়ে মতিউর রহমান ফররুখ সাহিত্য চর্চা করে গিয়েছেন। রচনা করেছেন অনেক অনেক সাহিত্যকর্ম। তরুণ সমাজের জন্য রেখে গিয়েছেন অমূল্য রত্ন ভাণ্ডার। তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন একজন যোগ্য ফররুখ গবেষক হিসেবে। আরও বেঁচে থাকবেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন হিসেবে একমাত্র বাঙালি গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক ও সংগঠক হিসেবে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।