যে জীবন মানুষকে অভিভুত করে। যে জীবন বিধাতার নিকট আত্মসমর্পণের একটি যৌক্তিক ও হার্দিক পরিচয় বহন করে এবং যে জীবন সকল মানবের কল্যাণে সর্বসময়ের জন্য নিয়োজিত সেই জীবনের একটি মনোজ্ঞ আলেখ্য আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)।
আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) সম্পর্কে বাংলা ভাষায় যে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তার মধ্যে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’ অত্যন্ত সুপাঠ্য। কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী রচনার অনেক বছর পরে সৈয়দ আলী আহসান ১৯৯৪ সালে ‘মহানবী’ নামে একটি গবেষণামূলক, তথ্যবহুল গ্রন্থ জাতিকে উপহার দেন। তাছাড়া মহানবী (সাঃ)-এর উপর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত অজস্র গ্রন্থ বিভিন্ন গুণী লেখক বাংলায় অনুবাদ করেন।
বিশ্বনবী গ্রন্থের ‘প্রতিশ্রুত পয়গম্বর’ শীর্ষক নিবন্ধে কবি গোলাম মোস্তফা উল্লেখ করেন-
“হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রতিশ্রুত পয়গম্ব (Promised prophet) অর্থাৎ আল্লাহ যে তাঁকে দুনিয়ায় পাঠাবেন, একথা পূর্বে নির্ধারিত হইয়াছিল। প্রত্যেক শিল্পবস্তুই প্রথমে শিল্পীর ধ্যানে জন্ম লাভ করে, তার অনেক পরে বাহিরে প্রকাশ পায়। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে একথা সত্য। তিনি ছিলেন সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু।
বিভিন্ন প্রাচীন কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘লাওলা খালাক্বা মুহাম্মাদান সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসলামা লামা খালাক্বতাল আফলাকা’- মুহাম্ম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসলামকে সৃষ্টি করা না হলে পৃথিবীর কোন কিছুই আল্লাহ্ সৃষ্টি করতেন না।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। আমিনা মাতা তখন তাঁর পিতৃব্যের গৃহে ছিলেন। যখন হযরতের পিতা আব্দুল্লাহর বয়স মাত্র কুড়ি বছর তখন তাঁর সঙ্গে বণি যোহরা গোত্রের আমিনার বিবাহ হয়। বিবাহের কিছুদিন পর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আব্দুল্লাহ সিরিয়া গমন করেন। প্রত্যাবর্তনের পথে মদীনায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি আর সুস্থ হননি। মদীনা শরীফে তাঁর মৃত্যু ঘটে। এ সময় মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) মাতা আমিনার গর্ভে।
মাতা হযরতের জন্মের শুভ সংবাদ তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিবের নিকট পাঠান। মুত্তালিব নবজাত শিশুকে বক্ষে ধারণ করে কাবা শরীফে আসেন এবং নবজাতকের জন্য আল্লাহ পাকের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ) জন্ম ৮ জুন, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার। মতান্তরে ৮ ও ৯ রবিউল আয়াল (আসাহ্হুস্সিয়ার, সীরাতে ইবনে হিশাম)। তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মদ এবং আহমদ। মুহাম্মদ শব্দের অর্থ হলো ‘পরম প্রশংসিত’ এবং আহমদ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পরম প্রশংসাকারী’। পবিত্র কোরআনে উভয় নামের উল্লেখ রয়েছে। সুরা আল ফাত্হর ২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে : “মুহম্মদ হচ্ছেন আল্লাহর বাণীবাহক রাসূল এবং যারা তার সঙ্গে আছে তাঁরা (সাহাবায়ে কেরাম) কাফির বা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে শক্তিমান। বিশ্বাসীগণ নিজেদের মধ্যে করুনাদ্রব এবং সহানুভুতিশীল। সূরা আল সাফ এর ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
“এবং স্মরণ কর মরিয়ম তনয় ঈসাকে যিনি বলেছিলেন, হে বণি ইসরাঈলগণ, আমি আল্লাহর রাসুল, আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে আমার পূর্বে যে সত্য প্রবর্তিত হয়েছিল তাকে সমর্থন করার জন্য এবং আমি শুভ সংবাদ দিতে এসেছি, আমার পরবর্তীতে যিনি আল্লাহর রাসুল হিসেবে আসবেন তার সম্পর্কে, তার নাম হবে আহমদ।”
রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছর বযসে নবুয়ত লাভ করেন। হেরা গুহায় তিনি ধ্যানরত অবস্থায় ছিলেন। এ সময় হযরত জিব্রাঈল (আঃ) এলেন প্রথম ‘ওহী’ তথা ঐশী বার্তা নিয়ে। জিব্রাঈল (আঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) কে বললেন, ‘বলনু ইকরা’। পাঠ করুন। মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন : ‘আমি পড়তে জানি না।’ ফেরেশতা পুনরায় তাঁহাকে বলিলেন : ‘পাঠ কররুন’। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবারও বললেন : ‘আমি পড়তে জানি না।’ জিব্রাঈল (আঃ) তখন মুহাম্মদ (সাঃ)কে আলিঙ্গন করিলেন। এইভাব তিন বার আলিঙ্গনের পর মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো :
“ইক্বরা বিস্মি রাব্বিকাল্লাযী খলাক্ব। “পাঠ কর তোমার সেই প্রভুর নামে, যিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। যিনি এক বিন্দু রক্ত থেকে মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন, পাঠ কর তোমার সেই মহিমাময় প্রভুর নামে, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিক্ষা দিয়াছেন, যিনি মানুষকে অনুগ্রহ করে অজ্ঞাতপূর্ব জ্ঞান দান করেছেন।”
মহান আল্লাহতায়ালার বাণী যে ভাষায় এবং উচ্চারণে মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ)এর নিকট এসেছিল আজও তা একই ভাষায়, একই উপস্থাপনা এবং সুষমায় বিদ্যমান রয়েছে। এর ফলে এর তাৎপর্যের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ইসলামের অলৌকিকতা এখানেই যে কোরআন শরীফের বাণী সর্বকালের সকল সময়ের জন্য আধুনিক, প্রাত্যহিক এবং প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতাকে ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন মহানবী তাঁর আচার আচরণ, জীবন যাপন, কর্ম ব্যবস্থাপনা এবং সুচিন্তিত ও পরিশীলিত নির্দেশনা দ্বারা। তাই তাঁর জীবনের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে পৃথিবীতে ব্যপক আলোচনা হয়েছে, তিনি সব সময় বিপুল মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তাঁর জীবন কথা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, নানারূপ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা হয়েছে, ঐতিহাসিক সত্য নির্ধারণের চেষ্টা হয়েছে, বিশ্লেষণ হয়েছে এবং অভিভূত মানুষের বিনয় প্রকাশ ঘটেছে। এ ধারা কখনও শেষ হবে না। চলতে থাকবে যতদিন বিশ্ব থাকবে।
ব্যবসা বাণিজ্য
এই নিবন্ধে মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ)৬৩ বছরের জীবনের সুবিশাল সীরাত বা জীবন চরিত থেকেএকটি ক্ষুদ্র বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ। সেটি হলো ব্যবসা বাণিজ্যের একটা অংশ বিশেষ। ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয় নবুয়তের পূর্বে ও পরে রসুল করিম (সাঃ) ব্যবসায়িক কার্যক্রম কিরূপ ছিল, কিভাবে তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন, কি কি নিয়মকে ব্যবসার ক্ষেত্র গুরুত্ব দিয়েছেন, আল্লাহ পাক তার পবিত্র মহাগ্রন্থে ব্যবসা সম্পর্কে কি বলেছেন, আর রসুলে করিম (সাঃ) ব্যবসা নিয়ে কি কি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন তা প্রবন্ধের মূল বিষয়।
দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ধন সম্পদের পরিমাণ জীবনের শেষের দিকে কমতে থাকে। মুত্তালিব মৃত্যুকালে যে সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন সে তেমন বেশি ছিল না। ছেলেদের মধ্যে সম্পদের বন্টনের পর আবু তালিব সামান্য সম্পদ লাভ করেন। এদিকে বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) এর রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব নেন চাচা আবু তালিব। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) চাচার মেষ পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মক্কার নিকটবর্তী পাহাড়ের পাদদেশে মুহাম্মাদ (সাঃ) ছাগল ও মেষ চড়াতেন। কখনও কখনও চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে দূরে পথে যেতেন।
যখন হযরতের বয়স মাত্র নয় বছর তখন চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করে। এটাই রসুলের জীবনে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সিরিয়া ভ্রমণ রসুলের জীবনে অনেক বড় ঘটনা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানা বিষয়ে জ্ঞান ও সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য তাঁর হৃদয়ে স্থান করে নেয়। আবু তালেবের কাফেলা সিরিয়ার এক প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র বসরা নামক স্থানে তাঁবু খাটায়। ঐ তাঁবুর নিকট ছিল একটি খ্রিস্টানদের মট। সেখানে ‘বহিরা’ নামক একজন জ্ঞানী পাদ্রী ছিলেন। সেই পাদ্রী ইহুদী ধর্মগ্রন্থ ‘তাওরাত’ এবং খ্রিস্টান ধর্ম গ্রন্থ ‘ইঞ্জীল’ থেকে শেষ নবীর লক্ষণ ও পরিচয় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত ছিলেন। পাদ্রী ‘বহিরা’ আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ থাকার কারণে বুঝতে পারলেন আবু তালিবের সফর সঙ্গী হিসাবে বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বশেষ নবী। তাই পাদ্রী আবু তালেবকে কসম দিয়ে বললেন, “এই বালককে যত সত্বর সম্ভব সাবধানে দেশে পৌছে দিতে যত্নবান হোন।”
আবু তালিব দ্রুত সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরলেন। বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) কে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। এটাই মুহাম্মাদ (সাঃ) জীবনের প্রথম ব্যবসায়িক সফর, এ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ।
যৌবনে উপনীত হয়ে তিনি ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। একজন ব্যবসায়ীর প্রধান গুণ হচ্ছে প্রতিশ্রæতি পূরণ করা এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে মহানবী (সাঃ) তাঁর সমকালের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন।
ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে, আরব দেশেও ছিল। ব্যবসায় তাঁর সঙ্গে যাদের প্রতিদ্ব›িদ্বতা ছিল তারাও তাঁর নানাবিধ সদগুণের প্রশংসা করেছে।
ব্যবসার ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন সকলের নিকট আস্থাভাজন এবং প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ বছর।
আরব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জ্ঞান গরিমায় অনেক সময় রমণীরা পুরুষের সমান ছিল। এ রকম একজন রমণী ছিলেন বিবি খাদিজা। সে সময় চর্তুদিকে সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য মুহাম্মাদ (সাঃ) এর খুব সুনাম ছিল। তিনি ছিলেন আল আমীন তথা দল মত নির্বিশেষে সবার কাছে অবিসংবাদিত বিশ্বস্ত রক্ষক। বিবি খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তাঁর ব্যবসায় নিযুক্ত করলেন এবং সিরিয়ায় পণ্য সামগ্রী নিয়ে যাবার জন্য মুহাম্মাদ (সাঃ) নিযুক্ত করলেন। এইভাবে রসুলে করিম (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে ব্যবসা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
নবুয়ত লাভের পর মুহাম্মাদ (সাঃ) পুরোদমে ইসলাম প্রচারে নিজকে নিয়োজিত করলেন। এরপর ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব বেশি সময় দিতে পারেননি। ইসলাম প্রচারের সর্বশক্তি নিয়োগের পর আল্লাহ পাকের নির্দেশে মদিনা রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে ইসলামের প্রথম ছোট্ট মডেল উপহার বিশ্ববাসীর নিকট রাখলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রসুল কারীম (সাঃ) এর মাধ্যমে পবিত্র কোরআনকে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে জীবনের সকল বিষয়ে মানব জাতির জন্য শিক্ষনীয় ও অনুকরণীয় করে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
পবিত্র কোরআনে ব্যবসা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা ক্রয় বিক্রয় ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করিয়াছেন, কিন্তু সুদ ও সুদভিত্তিক যাবতীয় কারবার হারাম বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। (সুরা বাক্বারা: ২৭৫)
অর্থ উপার্জনের মধ্যে সবচেয়ে সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্যান্য সকল উপায় অপেক্ষা ব্যবসা বাণিজ্য শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে অনেক উৎসাহ প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
“নামাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আল্লাহর অনুগ্রহ তথা ধন সম্পদ অনুসন্ধান কর।” (সূরা জুমু‘আ: ১০)
আল্লাহ নামাজ কায়েম করতে বলেছেন এবং নামাজ শেষে মসজিদে বসে না থেকে নিজের উপার্জনের জন্য কাজে ব্যস্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান, গবেষণা করতে বলেছেন। সম্পদ আহরণ করতে বলেছেন। সম্পদ উপার্জন করার তাগিদ দিয়েছেন। নামাজ পড়ে ঘরে বসে থাকতে বলেননি। তাই সকল নবী রসূলগণ আল্লাহ নির্দেশ অনুযাযী উপার্জনের জন্য ব্যবসাকে উপার্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছেন। (তিজারত ও মা‘ঈশাত)
আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) নবুয়তের পূর্ব থেকে ব্যবসাকে জীবিকা উপার্জনের প্রধান মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছেন এবং আমাদেরকে এভাবে জীবিকার মাধ্যম গ্রহণের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনে দিক নির্দেশনা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে মানব জাতির জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গিয়েছেন।
আমাদের প্রিয় নবী করিম (সাঃ) মানবজাতিকে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য বিশেষ উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও ন্যায়পন্থী ব্যবসায়ীদের বিশেষ মর্যাদার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন :
“সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী আম্বিয়া, সিদ্দীক ও শহীদ প্রভৃতি মহান ব্যক্তিগণ সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত হইবেন।” (আবূদাউদ, তিরমিযী ২য় খন্ড)।
ইসলামে ব্যবসা বাণিজ্যকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবসা অতি উত্তম ইবাদত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একজন সত্যবাদী, ন্যায়-পন্থী বিশ্বস্ত ও সৎ ব্যবসায়ীকে শহীদ, আম্বিয়া কিরাম (আঃ) এবং সিদ্দিকীনদের কাতারে শামিল করেছে। এরচেয়ে মর্যাদার আর কি হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ব্যবসায়ীদের কি নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি! আমাদের প্রিয় নবী, অন্যান্য নবী, আম্বিয়া (আঃ) নিজেদের উপার্জনের কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন, তা কি আমরা একাবরও ভেবে দেখছি।
ব্যবসার সব চেয়ে উত্তম বিষয় হচ্ছে প্রতিশ্রæতি পূর্ণ করা। সততার সঙ্গে ব্যবসা করা। সময়, কাজ, ইত্যাদিতে নিয়মানুবর্তিতা রক্ষা করা। আধুনিক ব্যবসায় আর্থিক সরাসরি লেনদেন ছাড়াও চুক্তিপত্রের মাধ্যমে তথা এলসির মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। নবীজী (সাঃ) এর সময় এলসি না থাকলেও তাদের মুখের কথা, মৌখিক প্রতিশ্রæতিই ছিল এলসি থেকে বিশ্বস্ত মাধ্যম। একজন ব্যবসায়ীর প্রধান গুণ হচ্ছে প্রতিস্রুতি পূরণ করা এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসাবে মহানবী (সাঃ) তাঁর সময়কালের এক সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করতেন। মানুষ তাঁর উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে পারতো। সুনানে আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত আছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই আল হামসা (রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) এর নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে তিনি রাসুল (সাঃ) এর সাথে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কাজ করছিলেন। দানের কিছু অংশ দেয়া হয়েছিল এবং কিছু অংশ বাকি ছিল। ইবনে উবাইআল হামসা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) -কে বললেন, “আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন আমি বাকি টাকা পরে নিয়ে আসছি। ঘটনা চক্রে ইবনে ওবাই আল হামসা (রাঃ) এ প্রতিশ্রæতির কথা ভুলে যান। তিন দিনের দিন হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল এবং তিনি বাকি টাকা নিয়ে প্রতিশ্রæত স্থানে উপস্থিত হয়ে রাসুলে (সাঃ)কে সেখানে দেখতে পেলেন। ইবনে ওবাই আল হামসা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর মধ্যে কোন বিরক্তির ভাব দেখলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো, আজ তিন দিন যাবত আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় বসি আছি।’
দেখুন কেমন দৃষ্টান্ত মহানবী (সাঃ) আমাদের জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে স্থাপন করে অনুকরণের জন্য রেখে গিয়েছেন। আমরা কি তাই করছি! আমরা কি মহানবীর ব্যবসায়িক জীবন থেকে নিজের জীবনে শিক্ষা গ্রহণ করছি! কেউ কেউ হয়তো কিছু কিছু করছি। কিন্তু অধিাকংশ ব্যবসায়ী তা করছি না। এটি অন্যায়। এই অভ্যাস আমাদের আগে ত্যাগ করতে হবে। কোরআন ও হাদীসের আলোকে ব্যবসায়ী হিসাবে নাজাত পেতে হলে আমাদের উল্লিখিত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। তবেই মুক্তি মিলবে।
সুদ ও ব্যবসা
স্যার জেমস স্টুয়ার্ট এর মতে, অর্থনীতি এমন এক শাস্ত্র যা এক ব্যক্তি সমাজের একজন হওয়ার দিক দিয়ে কিরূপ দূরদৃষ্টি ও মিতব্যায়িতার সাথে নিজ ঘরের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে তা আমাদেরকে বলে দেয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মার্শাল বলেন, অর্থনীতি মানুষের জীবনের সাধারণ কার্যাবলীর পর্যালোচনা মাত্র।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেয়ার্নক্রম-এর মতে, সমাজের সাধারণ মানুষের সর্ববিধ প্রয়োজন অনুসারে পণ্যের উৎপাদন, উৎপন্ন পণ্যের সুবিচারপূর্ণ বন্টন এবং উৎপাদনের উপায় ও এর সঠিক বন্টনের ন্যায়নীতি সম্পন্ন প্রণালী নির্ধারণ করাই হচ্ছে অর্থনীতির কাজ।
ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা এর চেয়ে ভিন্নতর এবং সর্ব দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ। মাওলানা হিফযুর রহমান (র:) বলেন, শরীয়তের পরিভাষায় যে বিদ্যা বা জ্ঞানের মাধ্যমে এমন সব উপায় সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া যায় যার দ্বারা ধন সমৃদ্ধ আহরণ ও ব্যয়ের উপযুক্ত ও সঠিক পন্থা এবং বিনষ্ট হওয়ার প্রকৃত কারণ নির্দেশ করা হয়, তাকে ইসলামী অর্থনীতি বলা হয়। (ইসলামী ইকতিসাদী নিযাম)
সুরা বাক্বারার ২৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “আল্লাহ তায়ালা ক্রয় বিক্রয় ব্যবসা বাণিজ্য হালাল করিয়াছেন কিন্তু সুদ ও সুদভিত্তিক যাবতীয় কারবার হারাম করেছেন।
আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, “মুসলমানগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে অসদুপায়ে পরস্পর পরস্পরের ধন সম্পদ ভক্ষণ করিও না। তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থের আদান প্রদান কর।” (সূরা নিসা: ২৯)
মহানবী (সাঃ) সুদ সম্পর্কে যে পবিত্র হাদীস বর্ণনা করেছেন, তা হচ্ছে-
“হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের চুক্তিপত্রের লেখক ও সাক্ষী সকলের উপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, এরা সকলে সমান অধিকারী (সহীহ বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী)
ইসলাম সুদকে নিষিদ্ধ করেছে ঠিক, কিন্তু এর বিকল্প ব্যবস্থার বিধানও দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে সুদমুক্ত হালাল উপার্জনের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতায়ালা সব ধরনের অবৈধ উপায়ে উপার্জনের পথ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা:) থেকে বর্ণিত, একবার হযরত বেলাল (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) এর নিকট ‘বর্নী’ (এক ধরনের) খুর্মা নিয়ে আসলেন। নবী করীম (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, এ ধরনের খুর্মা তুমি কোথায় থেকে পেলে? তিনি বললেন, আমার কাছে দুই সা (প্রায় আট কেজি) মন্দ খেজুর ছিল, আমি তা এই এক সা (প্রায় চার কেজি) খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করেছি। এটা শুনে রসুলে কারীম (সাঃ) (একাধিকবার) বললেন, আহ! এতো সুদী লেনদেন হয়েছে। আহ! এতো সুদী লেনদেন হয়েছে। এমন লেনদেন আর করো না। অধিক মন্দ খেজুর টাকার বিনিময়ে বিক্রি করবে, তারপর সে টাকায় উত্তম খেজুর ক্রয় করবে (বুখারী, মুসলিম)
এখানে মহানবী (সাঃ) সুদী লেনদেনকে চিহ্নিত করে তা হালাল লেনদেনে রূপান্তরের পদ্ধতি সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন।
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে কোরআন পাকের পরে রাসুল (সাঃ) কর্তৃক নানা হাদীস বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। নবুয়তের পূর্বে ও পরে মহানবী (সাঃ) নিজ জীবনের কর্মকাÐ দিয়ে দেখিয়েছেন কিভাবে লেনদেন করতে হবে, কিভাবে পণ্য বিনিময় করতে হবে, কিভাবে বান্দার হক যথাযথভাবে পালন করতে হবে। মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহানবী (সাঃ) ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য নমুনা স্থাপন করে গিয়েছেন। তা আজও আমাদের সকলের জন্য শিক্ষণীয় অনুকরণীয়।
ধন সম্পদ সঞ্চিত করে রাখা এবং তা অধিক জনকল্যাণের কাজে নিয়োগ না করা ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। ইসলামী সমাজের অর্থ সম্পদ কোন ক্রমেই এক হস্তে বা একটি গোষ্ঠীর মুষ্ঠিতে পুঞ্জীভুত হয়ে অব্যবস্থায় পড়ে থাকিতে পারে না। এমন কি, কোন ইয়াতীম শিশুর কোন নগদ অর্থ থাকলে তাও যে কোন লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন:
“সাবধান, তোমাদের কেউ ইয়াতীমের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত হলে এবং তাদের নগদ অর্থ থাকলে তা অবশ্যই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করবে। সেটা অলস ফেলিয়া রাখবে না। অন্যথায় বাৎসরিক যাকাত ও সাদকাহ তার মূলধন নিঃশেষ করে ফেলবে।” (ইবনে মাজাহ)
পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হয়েছে :
“ইসলামী সমাজের ধন সম্পদ যেন কেবল ধনীদের মধ্যেই কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভুত হইয়া থাকিতে না পারে।” (সূরা হাশর:৭)
ব্যবসায়ে ন্যায় নীতি
ইসলামী অর্থনীতিতে একচেটিয়া ব্যবসায় প্রথা সাধারণভাবে সমর্থন করে না। পণ্য দ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ের ব্যাপারে কোনরূপ ধোঁকা প্রতারণা বা শঠতা প্রশ্রয় দেওয়াকেও ইসলামী অর্থনীতি কখনই বরদাশত করে না। যে সব পন্থায় পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে লোকদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ বা মনোমালিণ্য সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অথবা যাতে এক পক্ষের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ইসলামে সেই ধরনের ব্যবসাকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
পণ্য দ্রব্য ক্রয় বিক্রয়ের ব্যাপারে সঠিক পরিমাণ না করাÑক্রেতাকে ওজনে কম দেয়া কিংবা নিজ হাতে বেশি ওজন করে রেখে দেয়া ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
“যাহারা ওজনে কম দেয়Ñ পরের জিনিস ওজন করে নিলে তখন পুরোপুরি গ্রহণ করে, কিন্তু অপরকে যখন ওজন করে দেয়, তখন তার পরিমাণ কম দেয়Ñ এরা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হবে।” (সূরা মুতাফফীন: ১-৪)
এই ‘ধ্বংস’ কেবল পারলৌকিই নয়, ইহকালীনও বটে এবং কেবল নৈতিকই নয়, নিজের এবং জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এসব অনৈতিকতা মারাত্মক ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন :
“পণ্য দ্রব্যের ওজন পূর্ণ কর, ওজন কম দানকারী হইও না। সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন কর, লোকদিগকে পরিমাণে কম বা নিকৃষ্ট ও দোষযুক্ত দ্রব্য দিও না, এটা উত্তম ও এর পরিণাম শুভ।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৫)
পণ্য মওজুদ সম্পর্কে ব্যবসা বাণিজ্যে ইসলামী শরীয়া সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীগণ অধিক লাভের আশায় খাদ্যদ্রব্যসহ যে কোন পণ্য অধিক ক্রয় করে দীর্ঘদিন মওজুত রাখে। তাতে পণ্যের স্বল্পতা সৃষ্টি হয়। পণ্যের মুল্য বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়ে। এই কাজ অত্যন্ত অন্যায়। ইসলামের দৃষ্টিতে এই ধরণের কাজ করা নিষেধ। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন : “পণ্যদ্রব্য মজুদ করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী নিঃসন্দেহে অপরাধী।” (ইবনে মাজাহ)
হযরত ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন : “যে ব্যক্তি অতিরিক্ত চড়া দামের আশায় চল্লিশ দিন যাবত খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় না করিয়া আটকাইয়া রাখিবে, আল্লাহর সঙ্গে তাহার সহিত আল্লাহর সম্পর্ক ছিন্ন হইয়া যাইবে।” (আল হিদায়াহ” ৩য় খন্ড)
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে আজ সুদের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে কিভাবে সুদ বর্জিত ব্যবসা করতে হবে তা প্রিয় নবীজী (সাঃ) আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন তার ব্যাপক বিস্তার ও বাস্তবায়ন করে আমাদের জন্য অনেক বড় মডেল স্থাপন করে গেছেন।
বর্তমান বিশ্বে খবঃঃবৎ ড়ভ ঈৎবফরঃ -এর মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য ক্রয় বিক্রয় হয়। তা ইসলাম সম্মত উপায়ে করা সম্ভব। ইসলামী অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী চালু করতে হলে আন্তর্জাতিক মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। এক দেশের মুদ্রার মান অন্য দেশের মুদ্রার মানের সমান হতে হবে। কেবল ক্রেডিট এক্সচেঞ্জই সুদ হয় না। নগদ আদান প্রদানের সময়ও যে ‘বাট্টা’ প্রথার আদান প্রদান হয় তা মূলত সুদই দিয়ে থাকে।
এ ক্ষেত্রে মহানবী (সাঃ) -এর এই বাণীটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় :
“একটি স্বর্ণ মুদ্রাকে দুইটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে এবং একটি ধাতব মুদ্রাকে দুইটি ধাতব মুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় বিক্রয় করিও না।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে : “স্বর্ণ মুদ্রা স্বর্ণ মুদ্রার সঙ্গে এবং ধাতব মুদ্রা ধাতব মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কোন ধরনের কম বেশি করা যাবে না।” (সুনানে নাসায়ী)
বিশ্ব নবীর এই চির সত্য বাণীর ভিত্তিতে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্র যদি নিজ নিজ স্বর্ণ বা রৌপ্য কিংবা মুদ্রার ওজন মান বিনিময় মান সমান করে নিতো এবং ‘বাট্টা’ দেয়া নেওয়ার প্রথা চিরতরে বন্ধ করে দিতো, তাহলে বিশ্ব অর্থ সমাজে নানাবিধ ধ্বংসাতœক অবস্থায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা পেতো, ব্যবসা বাণিজ্য বৈধ হতো, প্রাচুর্য ও দরিদ্রের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হতো। অনুরূপভাবে একটি সাম্যে পূর্ণ বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথও অনেকখানি উন্মুক্ত ও সুগম হতো।
যাকাত ব্যবস্থা
ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি যাকাত ব্যবস্থা। যাকাত কায়েমের মাধ্যমে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য যেমন দূর করা সম্ভব তেমনি পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের জন্য সহায়ক। পবিত্র কোরআনে যাকাত সম্পর্কে বেশ তাগাদা দেয়া হয়েছে। নামাজ কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে যাকাত আদায়কে বাধ্যতামূলক করা হযেছে। আল্লাহ বলছেন :
“ তোমরা নামাজ কায়েম কর যাকাত আদায় কর এবং রুকুকারীদের সাথে কর।” (সূরা বাক্বারা: ৪৩)
বস্তুত যাকাত আদায় করা ইসলাম ধর্মের মূল স্তম্ভের অন্যতম একটি। তাই পবিত্র কোরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে ঃ
যারা স্বর্ণ রূপা পঞ্জীভূত করে রাখে এবং আল্লাহর রাস্তায় (যাকাত আদায়ের মাধ্যমে) ব্যয় করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির দু:সংবাদ দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুন তাতে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ ও পেছন দিক দিয়ে দাগ দেয়া হবে এবং বলা হবে, এটা তার পরিণাম যা তোমরা নিজেদের জন্য পঞ্জীভূত করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা পঞ্জুভূত করেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন কর” (সূরা তাওবা: ৩৪-৩৫)
আল্লাহ তাআলা যাকাতের ব্যাপারে এমন বলিষ্ঠভাবে উল্লেখ করেছেন যে, যে যাকাত আদায় না করবে সে মুশরিক না কাফির হয়ে মরবে তা আমার জানার বিষয় নয়। সুরা সেজদায় বলা হয়েছে : “যারা যাকাত দেয় না এবং পরকালকে অস্বীকার করে, তাহারা কাফির।” (হামীম সিজদাহ্: ৭)
তাই যাকাত আদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে মহানবী (সাঃ) এবং পরবর্তী খলিফাগণ বিশ্বের মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন তরে তা সকলের জন্য অনুকরণীয় করে রেখে গিয়েছেন।
শেষ কথা
আমাদের দেশে সুদকে বর্জন করার প্রতিশ্রæতি নিয়ে শরীয়াহর ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যবসা বাণিজ্য শরীয়াহ্ মোতাবেক পরিচালিত করার জন্য ইসলামী ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবদান রেখে চলেছে। এর পাশাপাশি সুদভিত্তিক ব্যাংকিংও চালু রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকিং করার জন্য সংসদ কর্তৃক আইন তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশের বলে দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা দেশে চলমান হয়। অবশ্যই দ্রæত সংসদ কর্তৃক আইন প্রনয়নের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিংকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামী অর্থনীতির একটি আংশিক কার্যক্রম এই সকল ইসলামী ব্যাংকসমূহ করার চেষ্টা করছে। তাতে প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের সার্বিক কার্যক্রম ইসলামী ব্যাংকগুলোতে পরিচালিত হচ্ছে না। এমনকি এই সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যাকাত আদায় পর্যন্ত করতে পারে না। তাদের মতে যাকাত ব্যক্তিগতভাবে গ্রাহককে আদায় করার নিয়ম চালু রয়েছে। তাতে দেখা যায় সম্পদের প্রকৃত যাকাত দেশে আদায় হয় না। সরকার আইনের মাধ্যমে তার অগ্রিম কর আদায় করছে।
কিন্তু আইন প্রনয়নের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ইসলামের ফরজ বিধান যাকাত আদায় করার সুযোগ পেতে পারে। তখন এই যাকাত দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভুমিকা রাখবে। দারিদ্র্যদূরীকরণ ও ধনী দরিদ্রের দুরত্ব হ্রাসের জন্য এ বিধান খুবই জরুরি। এখন ব্যাংকসমূহ অর্থ উর্পাজন করছে। কিন্তু সমাজকে খুব বেশি কিছু দিতে পারছে না।
সমাজ ধনি দরিদ্র থাকবে। এইটি আল্লাহরর সৃষ্টি। তবে সেটার ব্যবধান খুব বেশি হবে না। একজন শত কোটির মালিক আরেকজন হাজার বা লাখ টাকারও না এধরনরে অর্থ ব্যবস্থা ইসলাম সমর্থন করে না। ধনী দরিদ্র নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। কিন্তু সমাজে, রাষ্ট্রে ন্যায্যতা থাকবে, প্রত্যেকের হক আদায় হবে, এটি ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদের সুরা যুখরুখে বলেন-
“আমি তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে।” (সূরা যুখরুফ: ৩২)
আসলে ধন সম্পত্তির পরিমাণের এই কম বেশি মানব সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিক আদান প্রদানের মূল কারণ। এটা না থাকলে, কোন সমাজই গড়ে উঠতে পারে না। মানুষের পক্ষে সামাজিক জীবন যাপন রক্ষা করাও কখনো সম্ভব হবে না।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য ব্যবসা বাণিজ্য করতে হবে। তবে তা হালাল পন্থায় করতে হবে, হারাম পদ্ধতিতে করা যাবে না। তাই রসুলে করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন :
“কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদেরকে পাপী হিসাবে উঠানো হবে। অবশ্য যারা পরহেজগারী, ন্যায় নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে ব্যবসা করেছে, তাদের কথা ভিন্ন।” (সুনানে ইবনে মাজাহ্)
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
খুব ভালো মননশীল আলোচনা
//// ভালো মননশীল আলোচনা ////