সন্দ্বীপ নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়েছে। দেশে বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তি যারা সন্দ্বীপে শৈশব কাটিয়েছেন, তাদের লেখা সব সময় আমাদেরকে মুগ্ধ করে। নানা বিষয নিয়ে সন্দ্বীপের লেখকদের লেখা। সন্দ্বীপের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও নানা সমস্যা নিয়ে যে সকল লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার মূল্যায়ন আমরা কখনও করতে পারি নাই। সমস্যার যে কোন সমাধান হয় নাই, তা নয়। অনেক সমস্যা সন্দ্বীপের সমাধান হযেছে। সন্দ্বীপ ও পুরো দেশের উন্নয়নের সঙ্গে তাল নিয়ে এগিয়ে চলেছে।আজকের এ নিবন্ধে সন্দ্বীপের সমস্যা নিয়ে আলোচনা তেমন করার ইচ্ছা নেই। মাত্র দু’তিনটি সমস্যার কথা প্রবন্ধের শেষে উল্লেখ করার ইচ্ছা রয়েছে। এই প্রবন্ধে সন্দ্বীপের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তোলে ধরা আমার উদ্দেশ্য।
এক নজরে সন্দ্বীপ
সীমানা : উত্তরে বামনী নদী এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী ও তৎপশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপ, পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
আয়তন : ৭৬২.৪২ বর্গ কিলোমিটার (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী) ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা : এর জনসংখ্যা মোট ২,৭৮,৬০৫ জন যেখানে পুরুষ ১,২৮,৬৫৬ জন ও মহিলা ১,৪৯,৯৪৯ জন। বাস্তবে এর লোকসংখ্যা আরো বেশি। ঘনত্ব ৩৬৫ জন (প্রতি বর্গকিলোমিটারে)। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ যদিও এর উল্লেখযোগ্য অংশ সন্দ্বীপের বাইরে অবস্থান করে। বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৪৮% (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী)। ব্যাপক অভিবাসনের ফলে এর মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক।
শিক্ষা : সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৫০টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ০৩টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সহপাঠ) ২৮টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় (বালিকা) ০৩টি। দাখিল মাদ্রাসা আবুল কাসেম হায়দার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেকান্দর সাফিয়া ইসলামিয়া দাথিল (বর্তমান নাম পূর্ব সন্দ্বীপ ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা) মাদ্রাসাসহ ১৪টি (এমপিও ০৯টি) ফাজিলা মাদ্রাসা ০৩টি। ১টি সরকারি কলেজ ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ ও একটি স্কুল এন্ড কলেজসহ মোট কলেজ ৬টি। বক্স স্কুল ৩১টি এবং কেজি স্কুল ১৯টি। কওমী মাদ্রাসা মাধ্যমিক পর্যায়ের ০৯টি এবং প্রাথমিক পর্যায়ের ১৮টি। শিক্ষার হার ৫১.৫% (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী) পুরুষ ৫০.৭% এবং মহিলা ৫২.১%।
স্বাস্থ্য : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ০১টি, ১০ শয্যার ১টি ও ২০ শয্যার ১টি হাসপাতাল যা আবুল কাসেম হায়দার কর্তৃক ইয়ূথ ফাউন্ডেশান নামে জমি ক্রয়কৃত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ০৬টি, বেডের সংখ্যা ৬০টি। ডাক্তারের মঞ্জুরীকৃত পদ সংখ্যা ২৫টি।
দ্বীপের প্রশাসনিক ইতিহাস (১) : সন্দ্বীপ কখনো আরাকান, কখনো পর্তুগীজ আবার কখনো বারো ভুইয়ার অন্তর্গত কেদার রায়ের অধীনে ছিলো। মুঘলদের আগে এখানে স্থায়ী কোনো শাসন কাঠামো গড়ে উঠেনি বা সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। মুসলিম শাসন (১৬৫৬), ফতেহ খাঁ (১৫৯০ পরবর্তী) এবং দিলাল রাজা (১৬১৬-১৬৬৫) সন্দ্বীপ প্রায় স্বাধীন ছিলো। এ সময়ে অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন ছিলো তা জানা যায় না। তবে উপরিউক্ত শাসকগণ যে সুশাসক ছিলেন তা ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য থেকে উপলব্ধি করা যায়।
মুঘল আমলঃ
দিলাল রাজাকে পরাজিত (১৬৬৫) করার পর ১৬৬৬ সালে মুঘলগণ সন্দ্বীপ, হাতিয়া, বামনী ও সাগরদিহী নিয়ে সন্দ্বীপ পরগণা গঠন করেন। হাতিয়া, বামনী ও সাগরদিহী তিনটি ‘চাকলা’য় বিভক্ত ছিলো। সমগ্র সন্দ্বীপে তিনটি ‘ডিহি’ বা বিভাগে বিভক্ত ছিলো। ডিহিগুলো তিনজন জমিদারের দখলে থাকতো। তখন সন্দ্বীপের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন ফৌজদার যার অধীনে সৈন্য থাকতো। দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচারের দায়িত্ব ফৌজদারের উপর রাজস্ব বিভাগের বিচারের দায়িত্ব ওয়াদাদার স্ব স্ব এলাকার জমিদারীর দেওয়ানী ও ফৌজদারী জমিদারের উপর সুতরাং একক নয়, যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হতো সন্দ্বীপে মুঘল শাসন।
সন্দ্বীপের প্রশাসনিক ইতিহাস (২) : বৃটিশ আমল : ১৭৬৩-৬৪ সালে বৃটিশ শাসনের শুরু। ১৭৬৫ সালে ফেওজদার পদ বিলুপ্ত করে প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব দারোগার উপর। এ ব্যবস্থায় সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে নায়েব-ওয়াদাদার উপর প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় মুল দায়িত্ব। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে আদালতে বসে দারোগা ও তার সহযোগীদের প্রস্তুতকৃত নথির আলোকে জমিদার, দারোগা ও কানুনগোর সহযোগিতায় বিচারকার্য সম্পাদন। ১৭৭০ দশক পর্যন্ত ঢাকার প্রাদেশিক পরিষদের অধেিন সন্দ্বীপ। ১৭৮০ সালের কৃষক বিদ্রোহ দমনের সুবিধার্থে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত। ১৮৮২ সালে নতুন ভুলুয়া (নোয়াখালী) জেলা গঠিত হলে সন্দ্বীপকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৭৮০ সালের ১১ এপ্রিল দেওয়ানী আদালত প্রতিষ্ঠা এবং দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচারালয়ের দায়িত্ব একজন মুন্সেফের উপর অর্পিত। ভুলুয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও সন্দ্বীপের ফৌজদারী ও দেওয়ানী উচ্চ আদালতের কার্যক্রম চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হতো। ১৮৩২ সালে সন্দ্বীপের ফেওজদারী ও ১৮৭৭ সালে দেওয়ানী আদালতের কার্যক্রম ভুলুয়াতে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৩ সালে সন্দ্বীপের সাব ডেপুটি কালেক্টরকে তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের মর্যাদা দিয়ে সন্দ্বীপের শাসনভার অর্পন। তখন থেকে দেওয়ানী আদালত-মুন্সেফ ফৌজদারী আদালত ম্যাজিস্ট্রেট ১৯২০-ম্যাজিস্ট্রেটকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীতকরণ ১৯৩৮-ম্যাজিস্ট্রেটকে ১ম শ্রেণিতে উন্নীতকরণ।
পাকিস্তান আমল : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সন্দ্বীপের অধিকাংশ লোকের দাবি ছিলো নোয়াখালী থেকে আবারো চট্টগ্রাম জেলার সাথে সংযুক্ত হওয়া। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের প্রধান ইস্যু ছিলো এটি। যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী এডভোকেট মোজাম্মেল হোসেনের বিজয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত হলেও সন্দ্বীপ ভূ-খণ্ডের বৃহৎ একটি অংশ নোয়াখালীর সাথে থেকে যায়। এটি সন্দ্বীপের জন্য স্থায়ী একটি ক্ষত।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির আগে পরে সরকারি কর্মকর্তাগণই থানা পর্যায়ে প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটই সন্দ্বীপের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন।
বাংলাদেশ আমল :
১৯৮৪ সালে সন্দ্বীপকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। এরপর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সন্দ্বীপের প্রশাসনিক প্রধান নিযুক্ত হন। উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তেকে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদের প্রধান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাচিবিক প্রধান। এ পর্যন্ত নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানগণ হলেন জনাব এ কে এম রফিক উল্যাহ চৌধুরী,জনাব মোস্তফা কামাল পাশা এবংজনাব মোহাম্মদ শাহাজাহন বি.এ (বর্তমান)।
সন্দ্বীপবাসীর কিছু স্বীকৃতিঃ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বীরত্ব ও দক্ষতার সাথে কর্মসম্পাদনের জন্য মোবারক আলী সেরাং (ইজ্জতপুর) ‘কাইসারে হিন্দ’ পদক, মুর্শিদ মিয়া সেরাং (মাইটভাঙ্গা) ‘ব্রিটিশ ওয়ার মেডেল রিবন, ‘মার্কেন্টাইল মেডেল রিবন’ পদক, ক্যাপ্টেন সেকান্দর হোসেন (মুছাপুর) এর নাম ও ফটোসহ লন্ডন গেজেটি ১৯৪৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। ওয়াহিদুল মাওলা চৌধুরী (গাছুয়া) ‘সম্মানিত তরবারি’ রূপার ওয়ার মেডেল ফিল্ড মার্শাল এ্যাচিনশন প্রদত্ত প্রশংসাপত্র অর্জন করেন। আবদুল বাতেন সওদাগার (রহমতপুর) সমাজসেবার জন্য ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রৌপ্যপদক ও সার্টিফিকেট অর্জন করেন। মাওলানা জিয়াউল হক (রুহিনী) ১৯৩৪ সালে ‘খান সাহেব’ এবং ১৯৪৩ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি লাভ, আমিন মিয়া (রুহিনী) : ১৯৪৩ সালে ‘খান সাহেব’, মাওলানা খবিরুল হক (মাইটভাঙ্গা) ১৯৪৪ সালে ‘খান বাহাদুর’ তবারক উল্লাহ সেরাং (গাছুয়া) ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘জজ মেডেল’, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ‘সিতারাই সুজাত’ উপাধি লাভ, মো. ওয়ালীউল্যাহ তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘যুগ বিচিত্রা’র জন্য ১৯৬৭ সালে ‘দাউদ পুরস্কার লাভ করেন। ২০২২
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শহীদ সুবেদার বেলায়েত হোসেন বীর উত্তম, ল্যান্স নায়েক আবদুল হক ‘বীর বিক্রম’। সমাজসেবার জন্য রাষ্ট্রপতির সাবেক মূখ্য সচিব কাজী মোশাররফ হোসেনকে ১৯৮২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে আবুল কাশেম সন্দ্বীপকে একুশে পদক, ২০১০ সালে বেলাল মোহাম্মদের স্বাধীনতা পদক ও ২০১১ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার অর্জন করেন। ২০২২ সালে কবি আসাদ মান্নান একুশে পদক লাভ করেন এবং কাজি হাবিবুল আউয়াল ২০২২ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হলেন।
সন্দ্বীপের নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ভিত্তিতে জনগণ নিজেদের নেতা নিজেরা নির্বাচনের অধিকার পায়। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সন্দ্বীপ-হাতিয়া আসনে কাটগড় নিবাসী জনাব সৈয়দ আবদুল মজিদ (মুসলিম লীগ) পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সন্দ্বীপ-হাতিয়া আসন থেকে হাতিয়ার মাওলানা আবদুল হাই (মুসলিম লীগ) নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন এডভোকেট মোজাম্মেল হোসেন (যুক্তফ্রন্ট) ১৯৬২ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদের এলাকা গঠিত হয়েছিলো সন্দ্বীপ, সীতাকু-, মীরসরাই ও ডবলমুরিং নিয়ে। আর প্রাদেশিক পরিষদ গঠিত হয়েছিলো সন্দ্বীপ ও সীতাকু- নিয়ে। জাতীয় পরিষদে সীতাকু-ের জনাব এম.আর. সিদ্দিকী (আওয়ামী লীগ) এবং প্রাদেশিক পরিষদে চট্টগ্রামের জনাব ইসলাম মিয়া বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন চট্টগ্রামের জনাব সুলতান আহমদ (কনভেনশন মুসলিম লীগ) এবং প্রাদেশিক পরিষদে জনাব এডিএম মোয়াহেদুল মাওলা জামসেদ মিয়া (স্বতন্ত্র)। পরে তিনি কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম নির্বাচন। এতে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন সীতাকু-ের জনাব এম.আর সিদ্দিকী (আওয়ামী লীগ) এবং প্রাদেশিক পরিষদে জনাব ওবায়দুল হক (আওয়ামী লীগ)।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জনাব ওবায়দুল হক (আওয়ামী লীগ) পুনঃনির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন জনাব এ. কে. এম রফিক উল্লাহ চৌধুরী (খেলাফতে রব্বানী)। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এডভোকেট একেএম শামসুল হুদা (জাতীয় পার্টি)। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন জনাব মুস্তাফিজুর রহমান (আওয়ামী লীগ)। ১৯৯৬ সালের স্বল্পকালীন সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন জনাব মোস্তফা কামাল পাশা (বিএনপি)। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হন জনাব মুস্তাফিজুর রহমান (আওয়ামী লীগ)। ২০০১ ও ২০০৯ সালে নির্বাচিত হন জনাব মোস্তফা কামাল পাশা (বিএনপি)। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচিত হন জনাব মাহফুজুর রহমান মিতা (আওয়ামী লীগ)।
সন্দ্বীপের কতিপয় কৃতী সন্তান
প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগ কবলিত সন্দ্বীপ।কিন্তু ইতিহাস, ঐতিহ্যে ও সৌন্দর্যে অপরূপ এ সন্দ্বীপ জন্ম দিয়েছে মাদ্রাসায়ে দেওবন্দে ‘জিনকা বাচ্চা’ খ্যাত মাওলানা আজিউল্লাহর মতে মেধাবী আলেম, কমরেড মুজফফর আহমদের মতো বিশ্বখ্যাত রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক রাজকুমার চক্রবর্তীর মতো দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ান ও শিক্ষাবিদ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামী আবু তোরাব চৌধুরীর মতো বীর যোদ্ধা, উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও শহীদে বালাকোট সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী (র) অন্যতম প্রধান শিষ্য মাওলানা ইমামুদ্দীন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাহসী সৈনিক ও চিকিৎসা শাস্ত্রের কৃতী ছাত্র লালমোহন সেন, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশের আলীয়া নেছাবের মাদ্রাসায় পৃথিকৃৎ খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক, অবিভক্ত বাংলার প্রথম গ্র্যাজুয়েট মৌলভী বছির উদ্দীন এর মতো গর্বিত সন্তান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় খেতাবসহ পুরস্কৃত হয়েছিরেন সন্দ্বীপের নাবিক মেবারক আলী সেরাং, মুর্শিদ মিয়া সেরাং, নুর আহমদ সুকানী, ক্যাপ্টেন সেকান্দর হোসেন, ওয়াহিদুল মাওলানা চৌধুরী ও তবারক উল্লাহ সেরাং। ছোট্ট একটি ভূখ-ে এতোজন বীর কৃতী সন্তানের সমাবেশ ইতিহাসে বিরল।
বাংলা ভাষা চর্চায়ও রয়েছে আমাদের অসামান্য ভূমিকা। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ রচয়িতাদের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন আমাদের মীননাথ, সপ্তদশ শতাব্দীতে মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন আমাদেরই একজন কবি আবদুল হাকিম। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ফ্রন্ট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ, বেতারের প্রথম কণ্ঠস্বর আবুল কাশেম সন্দ্বীপ এ মাটির গর্বিত সন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধে ছোট্ট এ দ্বীপের সহস্রাধিক সন্তান সম্মুখ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলেন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বেলায়েত হোসেন বীর উত্তম, আবদুল হক বীর বিক্রম, লে. দিদারূল আলম বীর প্রতীক আমাদের অহংকার। ইসলামী শিক্ষার মান ও গুণের কারণে সন্দ্বীপকে একসময় বলা হতো ‘বাংলার দেওবন্দ। বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য দায়িত্বশীল সন্দ্বীপ-সন্তান। দেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্স অর্জনেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ( সূত্রঃ সন্দ্বীপ মেডিকেল ক্যালেন্ডার-২০২০)
দুইটি সমস্যার কথা : বেশ কিছুদিন পূর্বে সন্দ্বীপে সরাসরি বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলোতে সন্দ্বীপবাসী এখন আলোচিত। শিল্প-বাণিজ্যে এই বিদ্যুত সংযোগের ফরে সন্দ্বীপে এগিয়ে যাওয়ার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার সন্দ্বীপে বিশেষ শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহন করেছেন। তা সন্দ্বীপবাসীর জন্য ইতিবাচক । সাবেক সচিব মনোয়ার হোসেন এর একান্ত প্রচেষ্টায় সন্দ্বীপে জাতীয় গ্রীড থেকে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে ২০২০ সালে বিদ্যুৎ সংযোগ লাভ করেন।
১) মাদক মহামারি ঃ সন্দ্বীপে মাদক এখন মহামারি আকারের রূপ নিয়েছে। ঘরে ঘরে যুব সমাজ মাদকে আক্রান্ত। স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের কিশোর, যুব সমাজে মাদকের বিষাক্ত ছোবলকে বাঁচাতে পারছে না। ধনি, দরিদ্র সকল ঘরের যুব সমাজে মাদকে আক্রান্ত। মাদক থেকে বাচার জন্য সন্দ্বীপে তেমন কোন বিশেষ উদ্যোগ নজরে আসছে না। সরকারীভাবে মাদক সন্দ্বীপে সরবরাহ, বিক্রি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা খুবই সহজ। সরকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলে মাদক থেকে সন্দ্বীপবাসীকে রক্ষা করা যাবে।
সন্দ্বীপে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সন্দ্বপি থেকে মাদক নির্মূল করার জন্য নানা প্রচারমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত। সমাজের মধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক একটি আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে। ঘরে ঘরে মাদক কে ‘না’ বলতে হবে। সকলকে একযোগে মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সন্দ্বীপে সকল স্কুল, করেজ, মাদ্রাসায় মাদক বিরোধী শিক্ষা, নিয়মিত চালু করতে হবে। প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে মাদক বিরোধী কিছু না কিছু কর্মসূচি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে চালু করতে হবে। উপজেলা প্রশাসন, একটি উপজেলা চেয়ারম্যান সকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণকে মাদক নির্মুরে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব।
২) যাতায়াত ব্যবস্থা : আজকের এই প্রবন্ধে দ্বিতীয় যে সমস্যাটি আলোচনা করা তা হচ্ছে যোগাযোগ। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, হাতিয়া, বরিশালসহ দেশের যে কোেন স্থানে যেতে হলে জলপথকে ব্যবহার করতে হয়। নৌকা, স্টিমার, স্প্রিড বোট প্রভৃতি হচ্ছে সন্দ্বীপবাসীর একমাত্র যাতায়াত বাহন। যুগ যুগ ধরে যাতায়াতের এই করুন অবস্থা সন্দ্বীপবাসী ভোগ করে আসছে। পাকিস্তান আমলে, পরবর্তীতে বাংলাদেশ সময় চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে স্টীমার সার্ভিস বেশ ভাল ছিল। বর্তমানে স্টিমার সার্ভিস খুবই খারাপ অবস্থা। নৌকা ও স্প্রিড বোট সন্দ্বীপবাসীকে যাতায়াত করতে হয়। তাও সন্দ্বীপে ও কুমিরা কোন দিকেই স্টিমারে উটানামার জন্য জেটী নাই। দুই দুইবার গুপ্তছড়া অংশে জেটী নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নিম্নমানের নির্মাণের ফলে জেটী ব্যবহারের পূর্বে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে তৃতীয়বারের মত জেটী নির্মাণ চলেছে। চট্টগ্রাম অংশে কুমিরা অংশে একটি জেটী কিছুটা ব্যবহার করা যায়। তাও জোয়ার সময় ছাড়া অন্য সময়এই জেটী নিয়ে উঠনামা করা যায় না। ভাটার সময় কয়েক মাইল কাদা মারিয়ে হেটে শিশু, নারী, বৃদ্ধ সকলকে স্টীমার, নৌকায় উঠতে হয়। রোগী, অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য এই যোগাযোগ একেবারেই অসম্ভব। অন্য দিকে প্রায় সময় নৌকা,বোট,স্পিড বোট সমুদ্রে দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে । ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এক স্পিড বোট দূর্ঘটনায় ১৪ জন সন্দ্বীপ বাসীর সলির সমাধি ঘটে।
সন্দ্বীপে নিয়মিত ভাল, নতুন তৈরী যাত্রীবাহী স্টীমার দেয়া প্রয়োজন। দেশে স্টীমার তৈরী হয়। আমরা সন্দ্বীপবাসী এক বছরের মধ্যে দেশে তৈরি যাত্রীবাহী স্টিমার পেতে পারি। নতুন স্টিমার পাওয়ার জন্য মাননীয় সংসদ সদস্যকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। আর বিদেশী ভাল কোম্পানী দিয়ে উন্নতমানের জেটী নির্মাণ করলে আমরা আমাদের প্রাণের জেটী পেতে পারি। এই বিষয়টি নিয়ে জনপ্রতিনিধিকে আরও বেশী সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
পড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অজানা তথ্য জানানোর জন্য ধন্যবাদ। তবে স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার দাবি ভবিষ্যতে জোরালো করার অনুরোধ রইলো।
১৯৫৪ সালে সন্দ্বীপকে নোয়াখালী থেকে বিচ্ছিন্ন করার সময় যে গনভোট হয়েছিল তার ফলাফলসহ উল্লেখ করলে প্রবন্ধটি পূর্ণতা পেত।