Shah Abdul Hannan

শাহ আবদুল হান্নান : আমাদের পথচলার আদর্শ

আর্থিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততার যে নজির শাহ আবদুল হান্নান রেখে গেছেন, তা বিরল। তিনি ছিলেন শুল্ক ও আবগারি বিভাগের কালেকটর, দুর্নীতি দমনব্যুরোর মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর, অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব।


শাহ আবদুল হান্নান ছিলেন একজন ইসলামি দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজসেবক। এছাড়াও তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।


শাহ আবদুল হান্নানের জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩৯ সাল কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ জেলায়। মৃত্যু ২ জুন ২০২১ সাল। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।


তার কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা পেশা দিয়ে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।


শাহ আবদুল হান্নান ছিলেন একজন লেখক, গবেষক, সমাজ সংস্কারক। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ইসলাম কিছু ধর্মীয় রীতিনীতির সমষ্টি নয়, বরং এর রয়েছে নিজস্ব পারিবারিক নীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় নীতি যা এই যুদ্ধবিধস্ত, অশান্ত পৃথিবীতে আবারো শান্তির বারতা আনতে সক্ষম। তাই তিনি তার এই চিন্তাধারাকে যথাসাধ্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

তার ক্ষুরদার লেখনি অথচ সংক্ষিপ্ত, সব সময় আমাকে আকর্ষণ করেছে। যখন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা চোখে পড়তো, তা নিমেষে পড়ে শেষ করতাম। তার জীবনের শেষের দিকে অতি সংক্ষিপ্ত, উপদেশমূলক, শিক্ষণীয়, পালনীয় লেখাটি আমার হৃদয়কে দারুণভাবে আলোড়িত করে। তিনি ‘আমার জীবনের উপলব্ধি’ শীর্ষক শিরোনামে লিখেছেন-


“আমি ৮০ বছর বয়স পার করছি। এই দীর্ঘ জীবনে নিজের অনেক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি হয়েছে। যেসব উপলব্ধি থেকে কিছু একটা পাঠকদেরকে অবহিত করছি; যাতে তারা চিন্তার খোরাক পেতে পারেন। সব সময় আমি সংযত চিন্তা করেছি। গভীরভাবে ভেবেছি।

কারণ সেই হিসেবে আমার উপলব্ধি হয়েছে যা পাঠকদের জন্য উপকারী হতে পারে। একে একে আমার পনেরোটি উপলব্ধি নিম্নে উপস্থাপন করছি।


১. কাউকে যোগ্য হতে হলে তার উচিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই পড়া। এসব বই হতে পারে ইসলামের ওপর বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের ওপর। গণ্যমান্য লেখকের বই বাছাই করা উচিত। কারণ সব লেখকের উপলব্ধি সমান হয় না। যারা সিনিয়র লেখক, তারা অনেক চিন্তা করে লিখে থাকেন।


২. ইসলামের জন্য কাজ করতে হলে পবিত্র কুরাআনের অর্থ প্রতি বছর অন্তত একবার পড়া উচিত। কুরআনের সাথে গভীর সংযোগ ছাড়া ইসলামের মহৎ কর্মী হওয়া সম্ভব নয়। কুরআন শরীফ অসাধারণ গ্রন্থ। এতে রয়েছে আল্লাহতায়ালা সম্পর্কে বা তওহিদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা, নৈতিকতা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা, শিরকের বিরুদ্ধে যুক্তি এবং অনৈতিকতার বিরুদ্ধে বড় শাস্তির ঘোষণা।


৩. ইসলামের জন্য যোগ্য লোক তৈরি করা জরুরি। এজন্য সিনিয়র লোকদের উচিত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ক্লাস করা। একেকটি ক্লাসে ১৫-২০ জন থাকতে পারে। এই কোর্স এক বা দুই বছরের জন্য হতে পারে। নিজে এ রকম ১০টি কোর্স করেছি। এসব কোর্স কুরআনভিত্তিক ও উন্নত ইসলামি সাহিত্যভিত্তিক হতে পারে।


৪. নারীদের সব সময় খুব গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া ইসলামের বা দেশের সত্যিকার কল্যাণ হতে পারে না। তাদের মর্যাদা ও অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।


৫. বর্তমানে যেসব ইসলামি সংগঠন রয়েছে সেগুলোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সংগঠন ছাড়া বড় কাজ করা যায় না। প্রত্যেকের উচিত তার পছন্দের ইসলামি সংগঠনে যোগদান করা।


৬. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি বইগুলো বেশি করে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। ইসলামি দাওয়াতের অগ্রগতি নির্ভর করে মানুষকে ইসলামি বই দেওয়ার ওপর। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি বই ভালো করে ছড়ানো হয়নি। এসব গুরুত্বপূর্ণ বই ছড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।


৭. সমাজসেবার মাধ্যমে প্রত্যেকের উচিত নিজের গ্রাম বা এলাকার দারিদ্র্য দূর করা। সব কিছুই সরকার করতে পারে না। সেজন্য ব্যক্তি উদ্যোগের প্রয়োজন অনেক।


৮. মধ্যপন্থাই উত্তম। আল্লাহতায়ালা কুরআনের মধ্যপন্থার কথা বলেছেন। মুসলিম জাতিকে তিনি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মত বলেছেন।


৯. হটকারিতা বা বাড়াবাড়ি ভালো নয়। কুরআনের বিভিন্ন জায়গাতে বাড়াবাড়ির নিন্দা করা হয়েছে। সূরা নাহলের ৯০ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।


১০. শ্রমিকরা আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা উপযুক্ত মজুরি পান না। বাধ্য হয়ে তাদেরকে অনেক আন্দোলন করতে হয়। অথচ শ্রমিকদের সমস্যা বোঝা আমাদের সবারই দায়িত্ব।


১১. গৃহকর্মী/গৃহে যারা কাজ করে, তাদেরকে খুবই কম মজুরি দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে দুই থেকে তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই মজুরি যা দেওয়া উচিত তার অর্ধেকও নয়।


১২. যারা অফিসে কাজ করেন তাদের উচিত সব সাক্ষাৎপ্রার্থীকে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া। এর ফল খুব ভালো হয়। এমনকি সুবিচার করতেও এটা সহায়ক হয়ে থাকে।


১৩. অফিসের কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়। কাজ ফেলে রাখলে পরে তা জটিলতা সৃষ্টি করে।


১৪. বিদেশ সফরে গেলে সে দেশের স্থানীয় মসজিদ ও স্থানীয় ইসলামি সংগঠনের অফিস পরিদর্শন করে আসা উচিত। এতে উম্মাহর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।


১৫. বিদেশ সফরে গেলে কিছু ইসলামি বই সাথে নিয়ে গেলে ভালো হয়। এতে বিদেশে ইসলামের দাওয়াত দিতে অনেক সুবিধা।


১৬. বিশে^র বড় শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুবিচারের নীতি অনুসরণ করে না। তারা নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী স্বার্থে কাজ করে। অনেক সময় শোষণ করে।


১৭. সবর (ধৈর্য) মহা ওষুধ। সবর সব সময় সব অবস্থায় মানুষকে সাহায্য করে।


১৮. যে রাগারাগি করে, তার ভুল করার সম্ভাবনা বেশি।


১৯. সাধ্যমতো দান করা উচিত। দান করলে কেবল অন্যের নয়, নিজেরও কল্যাণ হয়।


২০. মানব জাতির সংশোধনের জন্য সাধ্যমতো ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করা উচিত।
আমি নিজের উপলব্ধিগুলো বললাম। যদি এগুলো আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তবে আপনারা ও এগুলোকে আপনাদের কাজের ভিত্তি বানাতে পারেন।’


অসাধারণ এই লেখাটি আমাদের সকলের জীবনে পথচলার জন্য অমূল্য উপদেশ। সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য তিনি উক্ত প্রবন্ধে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।


শাহ আবদুল হান্নান ইসলামি অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন:
১. ইসলামি অর্থনীতিতে সরকারে ভ‚মিকা
২. ইসলামি অর্থনীতি দর্শন ও কর্মকৌশল
৩. নারী সমস্যা ও ইসলাম
৪. নারী ও বাস্তবতা
৫. সোস্যাল ল অব ইসলাম
৬. দেশ সমাজ ও রাজনীতি
৭. বিশ্বচিন্তা
৮. সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম
৯. উসুল আল ফিকহা
১০. ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি।


শাহ আবদুল হান্নান অনেক বড়মাফের মানুষ ছিলেন। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন নাই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছেন। সরকারি চাকরি শেষে অবসর জীবনে নিজেকে পরকালের জন্য তৈরি করেছেন। তিনি ছিলেন দ্বীনের প্রকৃত খাদেম। তাঁর চরিত্র, আমল আখলাক ছিল উঁচুমাপের মর্দে মোজাহিদের মতো।


আমার সঙ্গে শাহ আবদুল হান্নানের পরিচয় খুবই অল্প দিনের। তবে দীর্ঘ জীবন তাকে দেখেছি। তার কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করেছি। তার লেখনি সব সময় পড়েছি। নীরব সমাজকর্মী ছিলেন তিনি। কখনো কারো সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে শুনি নাই। সব সময় ‘পজেটিভ’ চিন্তা তার ছিল। জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার চিন্তা-চেতনা নিয়ে তিনি চলতেন।
আমার ব্যবসা জীবন শুরুতে ১৯৮২ সালে প্রথম তার সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়। সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ব্যবসা শুরুর উদ্যোগ নিয়ে। তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে আমার ব্যবসার যাত্রা। ১৯৮৩ সালে আমরা চার বন্ধু মিলে তৈরি পোশাক শিল্প স্থাপনের জন্য ইয়ূথ গার্মেন্ট লিঃ নামে কোম্পানি করে ঢাকায় ২৯ এয়ারপোর্ট রোডে কাজ শুরু করি। ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে সবেমাত্র তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু হয়েছে। এজন্য বন্ডেড ওয়্যার হাউজ লাইসেন্স নিতে হয়। প্রথম দিকে নানা জটিলতা ছিল এই লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে। অবশ্য পরে ধীরে সহজ হয়ে পড়ে। আমি আমার কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মরহুম ফিরোজ আলমসহ শাহ আবদুল হান্নান সাহের সরকারি অফিসে দেখা করি। বললাম আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বন্ডেড ওয়্যার হাউজ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছি। আপনি একটু বলে দিলে হয়তো দ্রুত লাইসেন্সটা পেয়ে যাবো। তিনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে টেলিফোন করলেন। বললেন, আমার স্নেহের ছোট ভাই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। একটু দেখবেন কি করা যায়। এটুকু বলা শেষ বলা। বেশি কিছু বললেন না। তাই দ্রæত আমরা লাইসেন্স পেয়ে গেলাম। তারপর আর তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই বললে চলে। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন সভায়, সেমিনারে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সব সময় ভালো ভালো পরামর্শ দিতেন।


সর্বশেষ শাহ আবদুল হান্নানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয় জাতীয় শরিয়া কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় অফিসে। আমি তখন ইসলামিক ফাইনেন্স এন্ড ইনভেস্টমেন্টের (IFIL) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। তা ২০১৮ সালের কথা।
শাহ আবদুল হান্নানের মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সম্পর্কে ব্যাপক লেখালেখি শুরু হয়েছে। ৩ জুন ’২১ দেনিক প্রথম আলো পত্রিকায় সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ‘উত্তর গোড়ান নিবাসী সচিবের কথা’ শিরোনামে একটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। লেখার শেষ অংশে ফাওজুল কবির খান বলেন-


“আর্থিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সততার যে নজির শাহ আবদুর হান্নান রেখে গেছেন, তা বিরল। আমি ক্ষণজন্মা এই মানুষটির আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাদের সন্তান ইমু ও ফয়সালের প্রতি সমবেদনা। তাদের বলি, এমন একজন মানুষকে পিতা হিসেবে পাওয়া যে কোনো সন্তানের জন্য একটি বিরল সম্মান। আর নিজেদের বলি, এমন একজন সরকারি কর্মকর্তা পাওয়া জাতির জন্য ভাগ্যের বিষয়।’


আমরা আজ শাহ আবদুল হান্নানের মতো একজন দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে হারিয়েছি। আমি ছাত্র জীবন থেকে তাকে চিনতাম, জানতাম। কিন্তু তার অনেক লুকায়িত গুণের কথা আজ শুনছি। মানুষের চরিত্রের এমন সুন্দর গুণ লুকায়িত আছে যেনে আজ অবাক হচ্ছি। আমরা জানি সরকারি চাকরি করলে সরকারি প্লট পাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। শুধু সরকারি কর্মকর্তা কেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা পর্যন্ত সরকারি প্লটের মালিক হয়েছেন। কিন্তু তিনি গোড়ানে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে বলে সরকারি প্লটের জন্য আবেদনও করেন নাই। কেন মিথ্যা বলবেন যে ঢাকায় তার কোনো জমিজমা নাই। কেমন সততা। এক অপূর্ব নজির। এমন কি সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ সরকারি কর্তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু তিনি সরকারি খরচে বিদেশ যেতেও রাজি ছিলেন না। এটিকে তিনি নিজের আমানতের খেয়ানত মনে করতেন।


তার অফিস ছিল সকলের জন্য উন্মুক্ত, তিনি ছিলেন ছোট-বড় সকলের নিকট সহজলভ্য। এটাও ছিল তার বিশেষ গুণ। ভ্যাট আইন প্রবর্তনের তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে আসল ব্যক্তি। আজ দেশ উপকৃত ভ্যাট আইনের মাধ্যমে। রাত দিন পরিশ্রম করে তিনি যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তখন ভ্যাট আইন প্রণয়ন ও কার্যকরী করার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আজ আমরা তার পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছি।


একজন আদর্শ মানুষের সকল গুণের অধিকারী ছিলেন শাহ আবদুল হান্নান। ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে যে সততা, নিষ্ঠা, আদর্শের পরিচয় দিয়েছেন তা এ সমাজে খুবই বিরল। অপূর্ব, শিক্ষণীয়, ঈর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী তিনি ছিলেন।


আজ শাহ আবদুল হান্নান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক কথা ভুলেই গিয়েছি। তবে বার বার মনে পড়ে তিনি অতি আস্তে সুন্দরভাবে স্বল্প কথায় ইসলামের দাওয়াত দিতেন। যখনি তার সাথে দেখা হয়েছে তিনি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার কাজে জড়িত হতে বলতেন। নিজেও সব সময় এই কাজটি নিখুঁতভাবে করেছেন। সরকারি চাকরি করতেন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে কাজ করেননি। তবে তিনি ইসলামি আদর্শে মনেপ্রাণে, চরিত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই আদর্শে বলিয়ান ছিলেন।


একদিন পত্রিকায় আমার একটি লেখা পড়ে আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন। তিনি তা না করলেও পারতেন। কিন্তু এত বড় মানুষের অধিকারী হয়েও অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা করতে ভুল করতেন না। তিনি আমাকে আরো বললেন, তুমি লিখে যাও। লেখা বন্ধ করো না। সবসময় লিখবে।


সমাজ সচেতন মানুষ শাহ আবদুল হান্নান। সামাজিক নানা কাজে নিজেকে আজীবন জড়িয়ে রেখে ছিলেন। ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অতুলনীয়। অবসর জীবনে ইসলামি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি বলতেন, এই দায়িত্ব আমার ইবাদতের অংশ। আন্দোলনের অংশ। ইসলামি শরীয়া বোর্ড গঠন ও তার কার্যক্রম নিয়ে তিনি সবসময় সক্রিয় ছিলেন। ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ, মানারত স্কুল, মানারত বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামি ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজসহ বহু প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামি অর্থনীতির একজন যোগ্য, জ্ঞানী গবেষক হিসেবে শাহ আবদুর হান্নান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।


শাহ আবদুর হান্নানের মতো একজন কৃতীমান মানুষের বিদায় সমাজে শূন্যতা সৃষ্টি করে। তাই করেছে। আর একজন শাহ আবদুল হান্নান কবে আমাদের সমাজে আসবে জানি না। তিনি চলে গিয়েছেন। কিন্তু তার আদর্শ, চিন্তা, লেখনি, উপদেশ আমাদের মাঝে মজুত রয়েছে। তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে আগামীতে পথ চলতে হবে। তার সর্বশেষ বিশটি উপদেশমূলক লেখা সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য অতি সুন্দর পথ নির্দেশনা, আল্লাহপাকা তাকে পরকালের সর্ব উচ্চ মর্যাদায় স্থান দিক এই দোয়া করি।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments