তুলা বিহীন তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনাময় খাত। বিগত বছরে এই বিষয়ে আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ঐ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। অনেক তৈরী পোশাক মালিক প্রবন্ধটি পড়ে আলাপ করেছেন। বিশ্বে তুলাবিহীন পোশাকের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা এইখাতে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহী উদ্যোক্তা দেখতে পাচ্ছি।
এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে দেশে ২০৩২ সালে তুলা বিহীন তৈরি পোশাক বৃদ্ধি ৪২ বিলিয়িন ডলারে উন্নিত করা যাবে। তবে এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে আমাদেন তিন খাতে। স্পিনিং খাতে নতুন বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ করতে হবে কাপড় তৈরির জন্য ৯২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । আর এই ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের খাতে বিনিয়োগ করতে হবে ১৮ বিলিয়ন ডলার।
বৈশ্বিক তৈরি পোশাক রপ্তানির ৫৭ শতাংশ এখন তুলাবিহীন বা নন-কটনের। অথচ বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পোশাকের মাত্র ৩০ শতাংশ তুলাবিহীন, আর বাকি ৭০ শতাংশই তুলার তৈরি পোশাক। অন্যদিকে চীনের রপ্তানি করা মোট তৈরি পোশাকের ৬৬ শতাংশই তুলাবিহীন। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ও ভারতে এই হার যথাক্রমে ৬৫ ও ৪৪ শতাংশ। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ১ হাজার ৫৬০ কোটি মার্কিন ডলারের তুলাবিহীন তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। সমন্বিত সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে ২০৩২ সালে দেশ থেকে তুলাবিহীন বা নন-কটন পোশাক রপ্তানি বেড়ে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। তবে এ জন্য তন্তু ও সুতা, কাপড় এবং তৈরি পোশাক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে।
গত তিন বছরে আমাদের রপ্তানিতে নন-কটন পোশাকের হিস্যা ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের পোশাকশিল্পে নন-কটন পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ এসেছে। তুলাবিহীন পোশাক রপ্তানিসংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষে গবেষণাটি করেছে ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াইজির অ্যাডভাইজার। গত ৩ মার্চ‘২৪ রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান। প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন ওয়াইজির বিজনেস ডিরেক্টর বরুণ বৈদ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন ২০২২ সালে ১১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের তুলাবিহীন তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। তার মধ্যে আউটারওয়্যার ৩৪, প্যান্ট ১৪ ও অন্তর্বাস ১৩ শতাংশ। ওই বছর বাংলাদেশ রপ্তানি করে ১ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের তুলাবিহীন তৈরি পোশাক। এর মধ্যে আউটারওয়্যার ৩৮, প্যান্ট ২৩, শার্ট ১৪ ও অন্তর্বাস ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের তুলাবিহীন পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭৪০ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনটিতে বৈশ্বিক বাজারে তুলাবিহীন তৈরি পোশাক রপ্তানির সম্ভাবনা, জটিলতা ও করণীয়সহ একটি পৃথক নকশার সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, তুলাবিহীন তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। কারখানাগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে দেশি –বিদেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সম্ভাবনার নতুন খাত:
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর রপ্তানিতে সরাসরি প্রণোদনা বা ভর্তুকি দিতে পারবে না। তবে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে চীন, তাইওয়ান ও ভারতের অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে। চীনে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপনে মূলধনে ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিদেশে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নিতে প্রণোদনা দেয় দেশটি। তাইওয়ান গবেষণা ও উন্নয়নে ১৫ শতাংশ প্রণোদন দেয়। ভারতে তুলাবিহীন পোশাক ও কাপড় উৎপাদনে উৎসাহ দিতে ১৩০ কোটি ডলারের বাজেট রয়েছে। ৯০০ কোটি ডলার ব্যয়ে সাতটি স্থানে শিল্প পার্কও স্থাপন করছে তারা।
নন-কটন পোশাক রপ্তানিতে বিনিয়োগ ও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘গত তিন বছরে আমাদের রপ্তানিতে নন-কটন পোশাকের হিস্যা ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের পোশাকশিল্পে নন-কটন পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ এসেছে। নন -কটন পোশাকে জোর দিলেও তুলার তৈরি পোশাক থেকে আমরা মোটেও দৃষ্টি সরাচ্ছি না। বরং তুলার পোশাকের ক্ষেত্রে আমরা নতুন সম্ভাবনা তৈরিতে মনোযোগ দিচ্ছি।’
বিজিএমইএর সভাপতি জানান, বাংলাদেশে এখন ১০০ ডলার বা তার চেয়ে বেশি মূল্যের তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি হয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পে মূল্য সংযোজন ৭০ দশমিক ৭৮ শতাংশ।এদিকে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে তৈরি পোশাকশিল্পে খরচ বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন ফারুক হাসান। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো যেকোনো পরিষেবার মূল্য বাড়লে শিল্পের ওপর চাপ বাড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পোশাক উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেবে।
ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়িয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্থ হবে। বিদ্যুতের দাম আগের জায়গায় নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
নতুন ভাবনা:
এক: দেশে তৈরি পোশাক শিল্প রফতানির ৭৮ শতাংশ আয়ের গৌরব অর্জন করেছে। বাংলাদেশে এখন এক মাত্র তৈরি পোশাক শিল্পের বৈদেশিক মুদ্রার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্র অর্জনের খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। তাও দক্ষ , কম বেতনে চাকুরী করার মত বিশাল জনবল, তাই দেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ছাড়া কোন পথ খোলা নাই। এই খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
দুই: স্পিনিংখাতে বিনিয়োগ করতে হবে ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । দেশি উদ্যোক্তাদের দ্বারা এই এই পরিমান বিনিয়োগ সম্ভব নয় । দেশের ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা নাই। এই ক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।
তিন: স্পিনিং ও বস্ত্রখাতের উত্তোরণের জন্য সরকারের সহযোগীতা প্রয়োজন। দেশে প্রতিবছর বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে আবারও গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু স্পিনিং খাত বিগত দুই বছর ধস নামলে তৈরি পোশাক শিল্পে ধস নামবে। তাই স্পিনিং খাতে গ্যাসের মূল্য হ্রাস করে সহযোগীতা করা দরকার। বিটিএম এর পক্ষ থেকে বিগত বছরে গ্যাসের মূল্য যাহা ছিল তাতে ফিরে যাওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে। তা না হলে মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্পিনিং খাতে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় টিকতে পারবেনা। এখনো ভারতের সুতার মূল্য বাংলাদেশের সুতার মূল্যের চেয়ে ০.৪০ মার্কিন ডলারের বেশী। তবুও কিছু কিছু তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশ থেকে সুতা কিনছে। দেশের স্পিনিংখাতকে রক্ষা করার জন্য সরকার নীতি সহযোগীতা দেয়া প্রয়োজন। এই জন্য সরকার আমদানীর উপর শর্ত যোগ করতে হবে। তা হচ্ছে যে কোন এলসি মূল্যের ৫০ শতাংশের বেশী কোন আমদানী কারক আমদানি করতে পারবেন। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ সুতা অবশ্যই স্থানীয় স্পিনিং থেকে কিনতে হবে। তাতে স্পিনিংখাত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
চার : এ দিকে ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ১৪ শতাংশ সুদ দিয়ে দেশের শিল্পখাত কখনো লাভ করতে পারবেনা। এই সমস্যা নতুন করে শিল্প মালিকদের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তুলা বিহীন তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে সরকার স্পিনিং ও বস্ত্রখাতকে অনেক বেশী নীতি সহযোগীতা করা প্রয়োজন।
পাঁচ: অন্য দিকে সরকার আগামী জুন;২৪ পর নগদ সহায়তা ১ শতাংশ হ্রাসে করবেন। তা করা ঠিক হবে না। নগদ সহায়তা সুতার জন্য অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। স্পিনিং খাতের উন্নয়ন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগীতা টিকে থাকার জন্য নগদ সহায়তা চালু রাখতে হবে। তবেই সুতা বিহীন তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। দেশ উপকৃত হবে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।