“এতক্ষণে” – অরিন্দম কহিরা বিষাদে
“জানিনু কেমনে আসি রক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ? শূলী-শম্ভূলিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতপুত্র বাসব বিজয়ী?
নিজগৃহ পথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চÐলে বসাও আনি রাজার আরায়?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লস্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত। কাব্যটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কমৃ হিসাবে বিবেচিত।
এটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে বা ‘ফ্র ভার্সে’ রচিত। তিনি প্রথমে তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য ১৮৬০ সালে রচনা করেন। উপরের উদ্ধতি থেকে এ কাব্যের ছন্দ প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এই অংশটি ষষ্ঠ সর্গের অংশ বিশেষ এবং মেঘনাদ ও বিভীষণ নামে পরিচিত।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ট্রানবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতা। তিনি বাঙরা নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার এবং অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব্ আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও তিনি পরিচিত।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যমোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবাওে মধুসূদনের জন্ম। তাঁর পিতা রাজনারায়ণ দত্ত এবং জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের খ্যাতনামা উকিল।
মধুসুদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নাবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবী তাকে রামায়ন, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। বিদ্বান ইমামের নিকট তিনি বাংলা, ফারসি, আরবী পড়েছেন।
তের বছর বয়সে মধুসুদন করকাতায যান। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়া সোনা করেন। পওে তিনি তদনীন্দন হিন্দু কলেজে বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন।
১৮৪৩ সালে মধুসুদন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়ের নিকট খৃষ্ঠধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ‘ওল্ড মিশন চার্চ’ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্ঠান ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি। তিনিই তার নাম ‘মাইকেল’ রাখেন। তাঁর পিতা তাকে ত্যাজ্য পুত্র করেন। তবে শিবপুরের বিশব কলেজে পড়াশোনা করেন। চার বছর তার পিতা লেখাপড়ার খরচ বহন করেন।
কলেজ লেখাপড়া শেষ কওে কলকাতায় চাকুরির চেষ্টা কওে, চাকুরী না পেয়ে মধুসুদন মাদ্রাজে চলে যান। একটি ইংরেজী স্কুলে চাকুরী করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তার ইংরেজি কবিতা প্রকাশিত হয়। হিন্দু ক্রনিকল নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তার প্রথম ইংরেজী কাব্য ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ রচনা করেন। কবি ও দক্ষ ইংরেজী লেখক হিসাবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
মাদ্রাসে আসার কিছুদিন পর মধুসুদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। তবে কয়েক বছর পর তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি এক ফরাসী অধ্যাপকের মেয়ে হেনেরিয়েটা সোফিয়াকে বিয়ে করেন। তাঁর এই দ্বিতীয় স্ত্রী মৃত্যুও পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেই ছিলেন।
১৮৬২ সালে মধুসুদন ব্যরিস্টারী পড়ার জন্য বিলেতে গেলেন। তিনি বিলেতে খরচ চালানো অসম্ভব বুঝে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে চলে যান। বিদেশে আর্থিক সংকটকালে ইশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে অর্থ পাঠিয়ে সাহায্য করেন।
১৮৬৬ সালে ব্যারিষ্টরী পাশ কওে তিনি নিজ দেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনার কৃতিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তের, সনেটকে বাংলায় চতুশপদী নাম মহাকবি মাইকেল মধুসূদনই দিয়েছিলেন। বাংলা সনেট এর সার্থক দ্রষ্ঠা কবি মধুসূদন দত্ত ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সের ভাসাই নগরীতে অবস্থানকালেই ইতালির কবি পেত্রার্কেও সনেট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম বাংলা সনেট রচনা করতে সক্ষম হন। ১৮৬৬ সালে কবির চতুর্দশপদী কবিতাগুলি গ্রন্থাকাওে প্রকাশিত হয়। এই কবিতায় কবি চিত্তের ব্যাকুলতা, স্বদেশ প্রেম ও আবেগ ধ্বণিত হয়েছে। ‘বউ কথা কও’ শিরোনামে কবি যে সনেট লিখেন, তার কিছু অংশ পাঠকের সুবিদার জন্য উল্লেখ করছি-
‘কি দুখে, হে পাখি, তুমি শাখার উপরে
বসি, বউ কথা কও, কও এ কাননে?
মানিনী ভামিনী কি হে, ভামের গুমওে,
পাখারূপ- ঘোমটায় ঢেকেছে বদনে?
তেঁই সাধ তাওে তুমি মিনতি বচনে?
তেঁই হে এ কথাগুলি কহিছ কাতরে?
বড়ই কৌতুক, পাখি, জনমে এ মনে-
নর-নারী-রঙ্গ কি হে বিহঙ্গিনী করে?
সত্য যদি, তবে শুন, দিতেছি যুকতি,
(শিখাইব শিখেছি যা ঠেকি এ কু-দায়ে)
পবনের বেগে যাও যথায় যুবতী;
“ক্ষম প্রিয়ে” এহ বাল পড় গিয়া পায়ে!
কভু দাস, কভু প্রভু, শুন, ক্ষুন্ন-মতি,
প্রেম-রাজ্যে রাজাসন থাকে এ উপায়ে।”
কবি যখন বিলেতে বা ফ্রান্সে ছিলেন তখন তার হৃদয দেশ ও জাতির জন্য যে প্রেরণা অনুভব করেছিলেন, তা তিনি তার বিখ্যাত ‘বঙ্গভাষা’ সনেট ছন্দে অর্থাৎ চতুর্দশপদী কবিতায় বিধৃত করেন। তিনি জীবনের শুরুতে ইংরেজী কবিতা, প্রবন্ধ লিখা শুরু করেন। পরবর্তীতে সকলের সুপরামর্শে, নিজের বিবেক ও চিন্তার প্রেরণার তাগিদে আপন ভাষা বাংলায় কবিতা লেখা শুরু করেন। কবিকে জানার, বুঝার ও কবি মনের চিন্তার আকুতি নি¤েœ উল্লিখিত কবিতায় প্রকাশিত:
হে বঙ্গ, ভাÐাওে তব বিবিধ রতন,
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহারি।
অনিদ্রায়, নিরাহাওে সঁপি কায় মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অরেণ্যে বরি,Ñ
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললগ্নি কয়ে দিলা পরেÑ
“ওওে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ বিখারী দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা-ওে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা-সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপে খনি, পুর্ণ মনিজালে।”
মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্রের াঙ্গনে পদার্পন করেন। ‘রামনারায়ণ তর্করতœ’ বিরচিত ‘রত্মাবর’ি এটাকে ইংরেজী অনুবাদ করতে গিযে তিনি বাংলা নাট্য সাহিত্যেও াভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্যে তিনি নাটক লেখায় আগ্রহী হন। ১৮৫৯ সালে ‘শমিষ্ঠা’ নাটক রচনা করেন। এটাই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় প্রথম রচিত মৌলিক নাটক। ১৮৬০ সালে তিনি রচনা করেন দুইটি প্রহসন, যথা: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং পূণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী’ নাটক। কৃষ্ণকুমারী নাটক (১৮৬১), মায়াকানন (১৮৭৪), রচনা করেন।
কাব্য রচনা করেন: তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য (১৮৬০) মেঘনাদবধ কাব্র (১৮৬১), ব্রজজাঙ্গানা কাব্য (১৮৬১), বীরাঙ্গানা কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদি কবিতাবলী (১৮৬৫)। অনুবাদ গ্রন্থ: হেকটর বধ (১৮৬২)। ইংরেজী রচনা: কালেক্টেড পোয়েময, দি াপসরি আ স্টোরি ফ্রম হিন্দু মিথোরজি, দ্যা ক্যাগটিভ রেডি, বিশনস অফ দ্য পস্ট্ কাব্র নাট্য: রিজিয়া: ইমপ্রেস াফ ইন্ডে। ানুবাদ নাটক : রতœাবর,ি শর্মিষ্ঠা, নীল দর্পন অব দি ইন্ডিগো প্লান্টিং মিরর। প্রবন্ধ সাহিত্য: দি অ্যাংলো ম্যাক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দু, অন পোয়েট্রি এটসেট্রা, অ্যান এসে প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ন উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নাম মহাকাব্যটি। উক্ত কাব্যে চরিত্র চিত্রিত হয়েছে: রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, সীতা, সরমা, প্রমীলা প্রমূখ। তিনি তাঁর কাব্যকে অষ্ঠাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃতি অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী এতে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, মন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু প্রথমে তিনি নতুন ছন্দ্র ব্যবহার করেননি; সবশেষে পরবর্তী সর্গকথা আভাসিত করেন নি। যদিও তিনি বলেছেন,
‘গাইব মা বীরবসে ভাসি মহাগীত।
তবুও কাব্যে করুণ রাসেরই জয় হয়েছে। মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণ আহ্নত কাহিনীর পুরনরাবৃত্তি নয়- এটি নব জাগ্রত বাঙালির দৃষ্টি নিয়তি লাঞ্ছিত নব মানবতা বোধের সকরুণ মহাকাব্যের রূপে অপূর্ব গীতি কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্য এ দিক দিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে একক সৃষ্টি।
মধুসূদন অতি আশ্চর্যজনকভাবে নিশান-কুশলতা গুণে মহাকাব্যোচিত কাব্য বিগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এ কাব্যেও তাৎপর্য রাবণ চরিত্রের প্রতীকতায়। তার সৃষ্ট রাবন চরিত্রে পরম দাম্ভিকতা প্রকট হয়ে উঠেনি। রামায়নকে তিনি তার মানবতার আলোকে বিধৌত কওে যে মহাকাব্য রচনা করেছেন, তা আসওে রোমান্টিক মহাকাব্য। এ কারণেই আকাওে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মহাকাব্যোচিত হলেও এর প্রাণ-নন্দিনী সম্পূর্ণ রোমান্টিক এবং মধুসূদন এ কাব্যে জীবনের যে জয়গান করেছেন, তা বীরবসের নয়, কারুণ্যের। কবি তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
“সসমদ্রতীরের শ্মশানে দর্ঘিনিঃশ^াস ফেলিয়া
কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন।”
ছোটবেলা থেকে মধুসূদন অতি আদরে ধনীর ঘরে ধনাঢ্য অবস্থায় জীবন শুরু করেন। পিতার একমাত্র সন্তান, আদরে ধনে ধান্যে পালিত হয়েছিলেন। জীবনের যৌবনে ব্যরিস্টার হিসাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অতিখরচী, বেহিসেবী। অর্থ সম্পদ কখনো জমাতেন না। শুধু খরচ কওে যেতেন।
শেষ জীবনে এসে অর্থেও কষ্টে জীবন কাটাতে হয় তাকে। জীবনের শেষে এসে নিজে ও তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ যোগাতে পারতেন না। বড় অর্থ কষ্টে জীবনের শেষ সময়গুলো কাটিয়েছেন।
নানা সংগ্রাম কষ্টকর জীবন পাড়ি দিযে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭৩ সালে ২৯ জুন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে বোম্বাইয়ের এক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুও মাত্র চার দিন পূবেৃ স্ত্রী হেনেরিয়েটা মারা যান।
অনেকে বলেন মহাকবি মাইকেল মধূসুদন জন্ম গ্রহণ না করলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ হয়তো বিশ^কবি হতে পারতেন না। বাঙলা আধুনিক কবিতার জনক মধুসূদন দত্ত। আধুনিক পাঠকের তিনিই অগ্রদূত। বাংলা কাব্য ও নাট্য সাহিত্যে তার অবদান চিরদিন ভাস্মর হয়ে থাকবে।
Web Master