মানুষের জীবনমান উন্নত করার জন্য সরকার দেশের কল্যাণে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। যে কোন সরকার জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হোক বা না হোক, সকল সরকারই জনমানুষের কল্যাণে নিয়ত সময় ব্যয় করে। যেহেতু সরকার জনগণের অর্থে পরিচালিত হয়। জনমানুষের উপার্জিত টেক্সের টাকায় সরকার ও সরকারের সকল অঙ্গ পরিচালিত। বেতন ভাতা জনগণের কর থেকে প্রাপ্ত হয় জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ।
বর্তমান সরকার দেশকে পরিচালনার দীর্ঘ সময় পেয়েছে । তিন তিন বার ক্ষমতায় বর্তমান সরকার। তাই এই দীর্ঘ সময়ে অনেক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কিছু কিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে। অবশিষ্ট প্রকল্প চলমান রয়েছে। মেট্রোরেল সরকারের মেগা প্রকল্পের কিছু অংশ দৃশ্যমান হয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হয়েছে। এক বছর পর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচলের সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত কাজ চলেছে।
মেট্রোরেলের ইতিকথা : পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে মেট্রোরেল গণপরিবহনের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেট্রোরেলের স্টেশন কেন্দ্রিক শহর গড়ে উঠেছে। ১৮৬৩ সালে লন্ডনের প্যাডিংটন থেকে পারিংডন পর্যন্ত দ্রুত ট্রানজিট সিস্ট্রেমে ছয় কিলোমিটার বিশেষ রেলপথ চালু হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মেট্রোরেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উক্ত রেলপথ এখন লন্ডন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর একটি অংশ। ১৮৯০ সালে এসে লন্ডন মেট্রোতে যুক্ত হয় ইলেকট্রিক রেল। লন্ডন মেট্রোরেলে বছরে প্রায় ১১৭ কোটি মানুষ যাতায়াত করে। তারপর থেকে শুধু সামনে তাকানোর গল্প। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেল ব্যবস্থা চালু করে এবং ১৯০৪ সালে নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে প্রথম বারের জন্য খোলা হয়েছিল।
১৯২৭ সালে জাপান প্রথম পাতাল রেল চালু করে। ১৯৭২ সালে ভারতের কলিকাতায় মেট্রো সিস্টেম নির্মাণ শুরু করে। তারপর ভারত অন্যান্য শহরে মেট্রোরেল চালু করে। বর্তমান বিশ্বে ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতাল রেল চালু হয়েছে। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে মেট্রোরেল চালু হয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে। ২০০২ সালে ইউনেস্কো পাতাল রেলকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৮৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক বোস্টন সাবওয়ে চালু হয়্। পৃথিবীতে তিনটি মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক রয়েছে যথাক্রমে জাপানের টোকিও, চীনের বেইজিং এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। ১৯২৭ সালে টোকিও সাবওয়ে এশিয়ার প্রথম সাবওয়ে। পরবর্তীতে মিশরের কায়রো, তিউনিসিয়ার তিউনিস, আলজেরিয়ায় আলজিয়ার্স, ইথিওপেয়ার আদ্রিস আবাবাসহ আফ্রিকার কয়েকটি শহরে ও মেট্রোরেল চালু হয়েছে। জাপানে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় টোকিও ১৯২৭ সালে।
বাংলাদেশে মেট্রোরেল : ঢাকা শহরে মেট্রোরেল আংশিক চালু হয়েছে। ঢাকা-মেট্রোরেল প্রকল্প চালু করেছে ঢাকা গ্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএসটিসিএল) পরিচালনা করছে। ২০১২ সালে ডিসেম্বরে ‘ঢাকা-ম্যাস র্যাপিড ট্রানিজট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ বা ‘মেট্রোরেল’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে।
কেন মেট্রোরেল: যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্টের এক সমীক্ষায় ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তার যানবাহনের গড় গতি ছিল ২১.২ কিমি, কিন্তু ২০১৫ সালে তা ৬.৮ কিমি/ঘণ্টা নেমে আসে। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়টের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশী। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার শূন্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌছতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট।
এটি প্রত্যাশিত যে, এ ধরনের পরিবহন মানুষের জীবনধারা পরিবর্তন করে এবং তাদের উৎপাদনশীল সময় বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে।
কোন শহরে কত ভাড়া : আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ রুপি অর্থাৎ ৬ টাকা ২ পয়সা। মেট্রোরেলে কলকাতার তুলনায় তিন গুণ ভাড়া বাংলাদেশে। পাকিস্তানে ২০২০ সালে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। পাকিস্তানের লাহোরে ২০২০ সালে ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য অরেঞ্জ লাইন চালু হয়েছে। দৈনিক ডন পত্রিকার ২৪ ডিসেম্বর ২২ খবর অনুযায়ী ভাড়া ৪০ রুপি অর্থাৎ বাংলাদেশী ১৮ টাকা। বর্তমানে সর্বনি¤œ ভাড়া ২০ রুপি অর্থাৎ ৯ টাকা। লাহোরে মানুষ ১৮ টাকা দিয়ে ২৭ কিলোমিটার ভ্রমণ করতে পারে।
সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া মেট্রোরেলের ভাড়া বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যুক্তিটি গ্রহণ করা যায় না। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। ক্রয় ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) মালয়েশিয়া মাথা পিছু আয় ২৮ হাজার ৭৩০ ডলার, ইন্দোনেশিয়া ১২ হাজার ৫৬০ ডলার। বাংলাদেশে ৬ হাজার ৯৬০ ডলার।
ইন্দোনেশিয়া মেট্রোরেল ও ম্যাস র্যাপিড কার্যকর রয়েছে। সেখানে সর্বনিম্ন ভাড়া বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬ টাকা। প্রতি কিলোমিটার ২৫০ রুপিয়া যা বাংলাদেশী টাকায় ১ টাকা ৬৪ পয়সা।
কুয়ালামপুরে ৫০ রিঙ্গিত ব্যয় করে পুরো মাস গণপরিবহন ব্যবহার করা যায়। যা বাংলাদেশী টাকায় ১ হাজার ১৬৩ টাকা।
কলকাতার মেট্রোরেল ও দিল্লির মেট্রোরেলের পার্থক্য রয়েছে। দিল্লিতে কিলোমিটার ভাড়া ১০ রুপি, যা বাংলাদেশী ১২ টাকার সমান। আর ২১ থেকে ৩২ কিলোমিটার ভ্রমণে ভাড়া মাত্র ৫০ রুপি যা বাংলাদেশী টাকায় ৬২ টাকা মাত্র।
বাংলাদেশে ভাড়া কত হওয়া উচিত : ঢাকা-মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া হচ্ছে ২০ টাকা। সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। যা আমাদের সকল নিকট প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ২৭ ডিসেম্বর ২২ মেট্রোরেল উদ্বোধনের সময় নানা ধরণের ব্যানার লাগানো হয়। দেখা গেলে লেখা আছে “মেট্রোরেল ধনী গরিব সবার পরিবহন।” আসলে কি তাই? দেশের গরীব মানুষের মেট্রো রেলে চড়তে পারবে।
রাজধানীবাসী মেট্রোরেল পেয়েছে। ঢাকার বাইরের জেলা থেকে মানুষ এসে মেট্রো রেলে চড়ে আনন্দ করছে। বর্তমানে উত্তরা থেকে আগারগাঁও মেট্রোরেল চলছে। আগামী এক বছর পর মেট্রোরেল উত্তরা থেকে মতিঝিল চলবে।
মেট্রোরেল একটি স্বস্তির পরিবহন। ঢাকায় যারা গাড়িতে চড়েন, একা-অটোরিক্সা চড়েন, মোটরসাইকেলে শরিকি যাত্রায় (রাইড শেয়ারিং) গন্তব্যে যান, তাদের জন্য মেট্রোরেল সাশ্রয়ী। কিন্তু ঢাকা শহরের বেশির ভাগ মানুষ বাসযাত্রী। জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজধানীর মানুষের ৬৭ শতাংশই বাস ও মিনিবাসে চলাচল করেন। বাসে বাড়তি ভাড়া নিয়ে নিয়মিত মারামারি হয়। কারণ দুই টাকা, পাঁচ টাকা ও তাদের নিকট অনেক কিছু। তাদের পক্ষে মেট্রোরেল এখন বিলাসিতা মাত্র।
তাই সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে মেট্রোরেলে ভাড়া কমানোর। মেট্রোরেলের ভাড়া বাস ও মিনিবাসের চেয়ে কম করতে হবে। তা হলে এদেশের গরিব মানুষ উপকৃত হবে। তখন হবে ধনি গরিবের মেট্রোরেল। তবেই অর্থনীতিতে ইতিবাচক গতি আনবে মেট্রোরেল।
Image Source : https://www.dhakatribune.com/dhaka/2022/11/23/dmtcl-metro-rail-likely-to-open-december-last-week
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
খুবই যুক্তিসংগত ও সময় উপযোগী লেখা।
কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা দরকার।
I appreciate your observation and comparison of fare in different countries. I agree with your suggestion to reduce fare for metro rail. It should be extended imagining future expansion of Dhaka. I also suggest to introduce it in all big cities of Bangladesh. Bullet train will facilitate our economy, is a long waited requirement for Dhaka- Cox bazaar connection. Thank you AQH vai.
Professor Bashar