Mowlana Abdur Rahim

মওলানা আবদুর রহীম
বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারার প্রতিষ্ঠাতা

শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি জাতির স্বরূপ অন্বেষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বের জাতিসমূহের নিকট একটি বিশেষ জাতির অবস্থান কোথায়, তা চিহ্নিত করা যায় তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আলোক সম্পাদন করে। কারণ একটি জাতির অবয়ব নির্মাণ করে, সাহিত্যে সে অবয়বের প্রতিফলন ঘটে আর সংস্কৃতি তাকে পূর্ণতা দান করে। এভাবেই একটি জাতির পরিচয় বিধৃত হয় তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। তাই যে কোন জাতির বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার সাথে তার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বলেনÑ
‘আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা একটি শিল্পোন্নত সমাজ ও জাতির প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে রচিত। যে শিক্ষায় বৈষিয়িক জীবন সত্তার স্থিতি, সুখ সম্ভোগ ও চাকচিক্যই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তার মূলে দ্ব›দ্ব সংগ্রাম ও যোগ্যতমের উর্ধ্বতন (ঝঁৎারাধষ ড়ভ ঃযব ভরঃঃবংঃ) লাভের ভাবধারা অত্যন্ত উৎকটভাবে নিহিত। কিন্তু এতদাঞ্চলের চিন্তাবিদগণ তাকে কখনও মনে প্রাণে গ্রহণ করেননি। ইউরোপ থেকে আমদনি করা জিনিসের প্রতি প্রথম দৃষ্টিতে আকর্ষণ জেগে উঠলেও, তার চাকচিক্য চোখকে ঝলসিয়ে দিলেও এবং প্রথম দিকে জনমনে একটা প্রবল মাদকতার সৃষ্টি করলেও এতদ্দেশীয় চিন্তাশীল ও সমাজদরদীদের ভুলভাঙ্গতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয়নি। ইংরেজদের তৈরি শিক্ষা ব্যবস্থার মারাত্মক বিষক্রিয়া সম্পর্কে সজাগ হতে অন্তত মুসলমানদের খুব বেশি সময় লাগেনি।
এমনকি, কবি রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সমর্থক হয়েও স্পষ্টত অনুভব করেছিলেন যে, এ শিক্ষা ব্যবস্থা এতদ্দেশীয় পরিবেশের সাথে সম্পর্কহীন। শিক্ষা যাদের জন্য, শিক্ষাকে তাদেরই ঈমান, বিশ্বাস, মন মানস, মুল্যমান মূল্যবোধ, সৌন্দর্যবোধ ও রুচিবোধ এবং সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অতএব শিক্ষা তাই গ্রহণযোগ্য, যা নিজেদের দ্বীন ও ঈমান এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্য ও মূলনীতি সমন্বিত ভাবধারার ভিত্তিতে রচিত।”
মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ:) বর্তমান শতকের এক অসাধারণ ইসলামী চিন্তা ও চেতনার ব্যক্তিত্ব। এ শতকে যে কয়জন মুসলিম মনীষী ইসলামকে বাস্তবায়নের সংগ্রামে অগ্রণী ভুমিকার সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব লেখনীর মাধ্যমে একমাত্র আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
১৯১৮ সালে ১৯শে জানুয়ারি মাসে পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানায় শিয়ালকাঠী গ্রামে এই মহাপুরুষের জন্ম। ১৯৩৮ সালে শীর্ষনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করেন। ১৯৪০ সালে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিলা এবং ১৯৪২ সালে একই মাদ্রাসা থেকে কামিল ডিগ্রী লাভ করেন। অসাধারণ মেধাবী এ ব্যক্তি ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে তিনি এই ভূখÐে ইসলামকে বাস্তবায়নের সংগ্রামের নেতৃত্ব থেকে জীবন কাটান।
আমার স্কুল জীবন শেষ হয় ১৯৬৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা পাশের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম জেলার স›দ্বীপ থানায় সাউথ স›দ্বীপ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করি। তখন স্কুল জীবনে যেমন ছাত্র থাকা দরকার, আমরা তাই ছিলাম। স্কুলের পড়া শোনা ছাড়া অন্য কোন তৎপরতা সঙ্গে ছাত্রছাত্রীগণ তখন জড়িত ছিল না। তাই আমরা এই সকল মনীষী সম্পর্কে স্কুল জীবনে তেমন কিছুই জানতে পারি নাই।
তখনকার বাংলা সাহিত্যে ইসলামী সাহিত্য চর্চা খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি ছিলেন। মওলানা মহিউদ্দীন আহমেদ, মাওলানা হাফেজী হুজুরসহ কতিপয় ব্যক্তির নাম আমরা কিছু কিছু শুনেছি। তাছাড়া আমরা মাদ্রাসা বিভাগে পড়াশোনা না করার কারণে ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে পরিচয়ও ঘটেনি।
মওলানা আবদুর রহীম ছাত্র জীবন থেকে বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকায় ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লিখতেন। বাংলা ভাষায় ইসলাম জীবন ধর্ম হিসাবে পরিচিত করার জন্য তিনি এই অঞ্চলে সেরা ব্যক্তিত্ব। ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ৬০টিরও অধিক তাঁর মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মূল্যবান গ্রন্থের মধ্যে : কালেমা তাইয়েবা, ইসলামী রাজনীতির ভুমিকা, মহা সত্যের সন্ধানে বিজ্ঞান ও জীবন বিধান, বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত¡, আজকের চিন্তা ধারা, পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, সুন্নত ও বিদয়াত, ইসলামের অর্থনীতি, নারী, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম, শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি, ইসলামের জিহাদ, হাদীস শরীফ তিন খন্ডে, প্রভৃতি সুধীমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আজও এই সকল পুস্তকের অগণিত পাঠক রয়েছে।
মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় লিখিত মনীষীদের বহু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। আধুনিক শ্রæতিমধুর ভাষায় তিনি তার অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন। উচ্চ শিক্ষিত পাঠক সমাজের জন্য তার বই ছাড়া বিকল্প কোন লেখক আজও বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয় নাই। তিনি বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে অদ্বিতীয়।
তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে বিখ্যাত ‘তাফীমুল কুরআন, আল্লামা ইউসুফ আল কারাযাভীকৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান’ ‘ইসলামে হালাল হারামের বিধান’ ‘মুহাম্মদ কুতুবের বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত এবং ইমাম আবু বকর আল জাসসাসের ঐতিহাসিক ‘আহকানুল কুরআন অন্যতম। মৌলিক লেখার মত তিনি ৬০টি গ্রন্থের সঠিক অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য চর্চার এক নতুন ধারা তিনি সৃষ্টি করেন।
‘ইসলামের অর্থনীতি’ গ্রন্থটি অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি মৌলিক বই। এই গ্রন্থটি লেখক প্রথম প্রকাশ করেন ১৯৫৬ সালে। ইসলামের অর্থনীতির বিষয় মৌলিক বই তিনি ছাড়া আর কেউ বাংলা সাহিত্যে উপহার দিতে পারেন নাই।
“ইসলামের অর্থনীতি” গ্রন্থ সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক, লেখক মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান উক্ত বই এর প্রসঙ্গ কথা শীর্ষক নিবন্ধে বলেনÑ
“প্রায় অর্ধ যুগব্যাপী নিরন্তন সাধনা ও গবেষণার ফসল হিসাবে ১৯৫৬ সালে তিনি বাংলা ভাষী জনগণের কাছে উপস্থাপন করেন ‘ইসলামের অর্থনীতি’ নামক এই অতুলনীয় গ্রন্থটি। কোন ভাষাভাষী ও গতানুগতিক আলোচনা কিংবা প্রচলিত অর্থনীতির দেহে ইসলামের রং চড়ানো নয়, বরং আধুনিক অর্থনীতির আলোকে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হইতে ইসলামী অর্থনীতির মূল সূত্রগুলি তিনি পরম যতেœর সহিত তুলিয়া ধরিয়াছেন এই মূল্যবান গ্রন্থে। বিশেষত সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির এই যুগে সুদমুক্ত অর্থনীতির প্রবর্তন এবং জন্ম নিরোধ ন্যায় আত্মঘাতি কর্মপন্থা ছাড়াই যে জনসংখ্যা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব তাহা এই গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করেছেন অসাধ্যভাবে। বলাবাহুল্য, বাংলা ভাষায় ইসলামী অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় এই গ্রন্থটি হইতেছে একমাত্র পথিকৃত এবং সর্বাধিক প্রামান্য ও সমৃদ্ধ দলীল।
বিগত চার দশক যাবত এই গ্রন্থটি সমাদৃত হইয়া আসিতেছে ইসলামের অর্থনীতি সংক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পাঠ্যগ্রন্থ হিসাবে।”
লেখক ‘ইসলামের অর্থনীতি‘ গ্রন্থে ইসলামী অর্থনীতির বাস্তবতা, স্বার্থকতা এবং এর স্থায়ীত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক নতুন অর্থনীতির প্রয়োজন শীর্ষক শিরোনামে বলেনÑ
“আধুনিক পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইসলামী অর্থব্যবস্থা পুরাপুরি খাপ খাইয়া যাইতে পারে এবং যে কোন সময়ের যে কোন চ্যালেঞ্জকে সুষ্ঠুরূপে পূর্ণ সার্থকতা সহকারে মোকাবিলা করিতে যে কোন সমস্যা সমাধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম। একমাত্র এই অর্থ ব্যবস্থাই যথার্থ, স্বাভাবিক এবং সর্বপ্রকারের শোষণ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত। সেই সঙ্গে সার্বিক শান্তি, সমৃদ্ধি প্রগতি ও নিরাপত্তার বিধান করা উহার পক্ষে খুবই সহজ। নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সার্বিক কল্যাণ বিধান কেবলমাত্র এই অর্থনীতির পক্ষেই সম্ভব। সমস্ত জুলুম ও বঞ্চনা বন্ধ করিয়া দেয় ইসলামী অর্থনীতির বিশেষ ঋণ বন্টন পদ্ধতি। ইহা মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণকে বন্ধ করিয়া মানুষ কর্তৃক মানুষের নিরন্তর কল্যাণ সাধনের প্রক্রিয়াকে সক্রিয় ও জোরদার করিয়া তোলে। ধন-সম্পদের একীভুত পুঞ্জীভুত (ঈড়হপবহঃৎধঃরড়হ ড়ভ যবধষঃয) হওয়া ও পারস্পারিক অসাম্য ও পুঁজিবাদের অন্যান্য অশুভ প্রতিক্রিয়ার মুকাবিলায় শক্ত প্রতিরোধ গড়িয়া তুলতে পার একমাত্র এই অর্থ ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার বেশী মাত্রার অর্থনেতিক, প্রবৃদ্ধি, সুনিশ্চিত করে সুষম, সুষ্ঠু ও সুবিচারপূর্ণ অর্থ বন্টনের মাধ্যমে।”
আজকে আমাদের সমাজে অপরাধ, অন্যায়, অবিচার, ঘুষ, দুর্নীতি ও অপশাসনে ভরে গিয়েছে। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও সমাজকে কলঙ্কমুক্ত করতে পারছে না। এমনকি করোনাকালীন এই দুঃসময়েও মানুষ কিভাবে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার করছে তা দেখে অবাক হতে হয়। মানুষের মন থেকে যেন ভয়ভীতি, লজ্জা শরম কিছুই নেই। করোনা সুরক্ষা থেকে শুরু করে দরিদ্র মানুষের রিলিফ পর্যন্ত অন্যায়ভাবে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজে অরাজকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থার মৌলিক সমাধান কি তা নিয়ে মওলানা আবদুর রহীম তার গ্রন্থ “অপরাধ প্রতিরোধ ইসলাম’ লিখেন। অবশ্য এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তিনি ইন্তেকাল করেন ১৯৮৭ সালের ১লা অক্টোবর। দ্বিতীয়বার এই বই নতুন আকারে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়। পাঠক সমাজ বইটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছে।
লেখক অপরাধ দমন বা প্রতিরোধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেনÑ
“যে সব অপরাধ সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা নিরাপত্তা বিঘœকারী সমাজ সমষ্টিকে সে সবের মুকাবিলা করতে হবে, যদিও তা সাধারণ সংঘটিত হয় এক ব্যক্তি বা কয়েক ব্যক্তির দ্বারা। আর সে সবের মুকাবিলা করতে হবে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে অথবা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে অথবা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তার জন্য নির্দিষ্ট দন্ড বা শাস্তি অবিলম্বে কার্যকর করে। এভাবেই অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব, সম্ভব তার ধারাবাহিকতা বা পৌনপুণিকতা রুদ্ধ করা।”
অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনের এই স্বাভাবিক ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াটি পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বিস্তৃতভাবে উল্লিখিত হয়েছে। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানী মওলানা আবদুর রহীম অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম গ্রন্থে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটি চুলছেরা বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ শতকের এই আলোকোজ্জ্বল যুগেও ইসলামই যে অপরাধ মুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের একমাত্র হাতিয়ার, এই গ্রন্থে তিনি তা অকপট্যভাবে প্রমাণ করেছেন।
তাওহীদ ও রিসালাত ইসলামের মৌল ভিত্তি। তাওহীদ ছাড়া যেমন ইসলামী জীবন দর্শনের কল্পনা করা যায় না, তেমনি রিসালাত ছাড়া যে দর্শন কোন অবয়বও লাভ করে না। মূলত তাওহীদ ও রিসালাত পরস্পর সম্পৃক্ত দুটি স্বতন্ত্র বিষয়। এই একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব পর নয়। এই সম্পর্কে মওলানা আবদুর রহীম অত্যন্ত গুরুত্ব ‘নবুয়ত ও রিসালাত’ গ্রন্থটি রচনা করেন। সমাজে এই গ্রন্থের গুরুত্ব অনেক বেশী। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। এই গ্রন্থের পর পরই তিনি ‘শিরক ও তাওহীদ’ বইটি রচনা করেন। যেটি আজকের সমাজের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। আজ সমাজে শিরক এর ছড়াছড়ি।
‘আল কুরআনের আলোকে শিরক ও তাওহীদ’ ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক মওলানা আবদুর রহীম এর এক অনন্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাওহীদের গুরুত্ব ব্যাখ্যায় শুধু দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকÑ যুক্তি প্রমাণেরই আশ্রয় নেননি, আল কুরআন থেকে প্রাসঙ্গিক আয়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন অত্যন্ত মুনশীয়নার সাথে। বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআন সম্পর্কে এ ধরনের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা এই প্রথম।
এই গ্রন্থটি বর্তমান সমাজ জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। সমাজে যেভাবে শিরক বৃদ্ধি পেয়েছে, যেভাবে মানুষ শিরক এর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে তা জানা খুবই প্রয়োজন। লেখক উক্ত গ্রন্থের ‘গ্রন্থকারের বক্তব্য’ শিরোনামে বলেছেনÑ
“দ্বীন ইসলামের প্রধান পরিচয় তা তাওহীদী দ্বীন। এই দ্বীন আল্লাহ তায়ালার সার্বিক এককত্ব ও অনন্যতা বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল। শিরক এই তাওহীদী আকিদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, সোজা বিপরীত দিকে স্থিত। কুরআন শিরককে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে তাওহীদী আকীদা পুরাপুরি গ্রহণের আহŸান জানায়। শিরককে সমূলে উৎপাটিত ও শিরক এর যাবতীয় প্রতিষ্ঠানকে ভিত্তিসহ ধ্বংস করে তাওহীদী জীবনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাই কুরআনের লক্ষ্য।
তাই তাওহীদী আকীদা কুরআন থেকেই জানতে হবে। বক্ষমান গ্রন্থে কুরআনের আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাওহীদ ও শিরক এর স্বরূপ এবং তাওহীদের তত্ত¡ ও ব্যাপকতা উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে একই তত্তে¡র বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা আয়াতসমূহকে একত্রিত করে।”
মওলানা আবদুর রহীম শুধুমাত্র একজন লেখক, গবেষক বা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি);র অন্তর্গত ফিকাহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন।
মওলানা আবদুর রহীন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বহু সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ও প্রশান্ত মহানাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে কলম্বোতে আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
মওলানা আবদুর রহীম একজন সমাজ সচেতন, সাংস্কৃতিবান ব্যক্তি ছিলেন। সমাজ সম্পর্কে, সমাজের পরিবর্তন, সমাজ সংস্কৃতি প্রভৃতির সু² সু² বিষয় সময়ে তিনি গভীরভাবে বিচরণ করেছেন। তাই তাঁর লেখনিতে আমরা তার ক্ষুরধার বক্তব্য দেখতে পাই। ‘ইসলামী সংস্কৃতির লক্ষ্য’ শিরোনামে এক গ্রন্থের আলোচনায় লেখক বলেনÑ
সংস্কৃতি বলতে বুঝায় সংস্কার, সংশোধন, পরিশুদ্ধকরণ ও পরিচ্ছন্নতা বিধান। আর কালচার বলতে বুঝায় কৃষিকাজ। তাহযীব ও পরিচ্ছন্নকরণ ও উন্নয়নকে বুঝায় আর সাক্কাফাতের অর্থ হল তীক্ষè, শানিত ও তেজস্বী করে তোলা। এর প্রতিটি অর্থেই উদ্দেশ্যের ব্যাঞ্জনা বিধৃত। ‘সংশোধন’ শব্দ শোনামাত্রই চোখের সামনে ভেসে উঠে ভুলগুলোকে বাদ সাদ দিয়ে তদস্থলে সঠিক ও নির্ভুল জিনিস সংস্থাপন। পরিশুদ্ধকরণ তখনি বলা চলে যখন অপবিত্র ও অশুদ্ধ জিনিস দূর করে দেয়া হবে।
আর কৃষিকাজ হল জমির আগাছা-পরগাছা ও ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলে, অবাঞ্ছিত তৃণ লতা উপড়ে ফেলে নাঙ্গল দিয়ে জাল চালিয়ে জমিকে নরম মসৃণ করে সেখানে বীজ বপন করা। এইসব ক্ষেত্রেই ভাঙা গড়ার ন্যায় নেতিবাচক কাজের অপরিকার্যতা সুস্পষ্ট। একদিকে ছাঁটাই বাছাই ও বর্জন এবং অপরদিকে মনন, আহরণ ও গ্রহণ। বস্তুত এসব কাজের নির্ভুল, যৌক্তিক ও বিচক্ষণ সম্পাদনেই গড়ে উঠে সংস্কৃতি। তাই সংস্কৃতি অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক।”
মওলানা আবদুর রহীম সত্যিকার অর্থে এক গভীর গবেষক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিমনা, আধুনিক যুগের মনীষী। বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর পাÐিত্য সকলের নিকট পরিচিত। আমাদের দেশে তথা বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে তিন ধরনের চরিত্রের মানুষকে দেখা যায়। প্রথমত: এক ধরনের কবি, সাহিত্যিক যারা নিজকে সকল কিছু থেকে নিরপেক্ষ থেকে সাহিত্য চর্চা করতে চান। তারা সেকুলারিজম বিষয়টি পছন্দ করেন। দ্বিতীয় এক ধরনের সাহিত্য চর্চাকারী ব্যক্তি রয়েছেন যারা বাম আদর্শকে নিজেদের সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু বানান। তৃতীয় এক শ্রেণীর সাহিত্যিক রয়েছেন যারা স্ব স্ব ধর্মীয় মুল্যবোধকে তাঁর সাহিত্য চর্চার মূল উপাদান হিসেবে প্রসৃণ করেন। শেষের সাহিত্যিকগণ হচ্ছেন যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল ইসলাম, বেনজীর আহম্মদ, কবি ফররুখ আহমেদ ও মওলানা আবদুর রহীম প্রমুখ।
আমাদের দেশে পাঠক সমাজ কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত। লেখক কুল যেমন নানা শ্রেণীতে তেমনি পাঠক সমাজও কয়েকটি শ্রেণীতে শ্রেণীবদ্ধ।
এদেশে সৃজনশীল বই এর পাঠক সংখ্যা এখনও অনেক কম। জরিফে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের সৃজনশীল পাঠকের সংখ্যা মাত্র ৪০ শতাংশ। ৬০ শতাংশ পাঠক এখনও স্ব স্ব ধর্মীয় গ্রন্থের পাঠক। বিভিন্ন ধর্মের বই বিশেষ করে মুসলিম ও ইসলাম সম্পর্কীয় গ্রন্থের পাঠক তখনও আমাদের সমাজে ৬০ শতাংশের অধিক। এই বিশাল পাঠক সমাজের খাদ্য সরবরাহ করছেন আমাদের দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদকগণ।
মওলানা আবদুর রহীম সেই অসাধারণ কাজটি বাংলা ভাষাভাষি পাঠকদের জন্য করে গিয়েছেন। তাঁর মৌলিক গ্রন্থ, অনুবাদ, তফসির, হাদিসের ব্যাখ্যা আজও পাঠক সমাজে বিপুলভাবে সমাদৃত। বাংলা ভাষার নতুন ধারণা তিনি সৃষ্টি করেছেন। রুচিশীল, উন্নত ভাষা নৈপুণ্যে সৃষ্টি তার সাহিত্য গ্রন্থসমূহ পাঠককে সব সময আকৃষ্ট করে।
সর্বশেষে তাঁর লেখা একটি গ্রন্থের কিছু অংশ পাঠকের জন্য উপস্থাপন করে এই মহান ব্যক্তির উপর সংক্ষিপ্ত আমার মত অযোগ্য ব্যক্তির সাহসের সমাপ্তি টানছি। ভাষা, শব্দ, ও বর্ণনার অতুলনীয় তার লেখার মধ্যে বিরাজমান। তিনি বলেনÑ
“জীবনের কুল-কিনারাহীন মহাসমুদ্রে মানুষের অস্তিত্ব এক ক্ষুদ্র তৃণখন্ড সদৃশ মনে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত বৈচিত্র্য ও সামাজিক উত্তরাধিকারের পার্থক্যের দৃষ্টিতে বহুতর মহাসমুদ্রের ব্যাপকতা ও বিশালতা রয়েছে মানুষের সত্তায়। মানুষ শুধু নিজের আকার আকৃতি ও সামাজিক উত্তরাধিকারের বৈচিত্র্যেরই প্রতীক নয়, বরং ভাষা-সাহিত্য, বিশ্বাস-প্রত্যয়, চিন্তা পদ্ধতি ও জ্ঞান-বুদ্ধির রকমারি শাখা-প্রশাখা ও প্রতিবছর এই মানুষ। স্পষ্টতই মনে হয়, এ বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতাই একটি প্রানির এই জগতের সৌন্দর্য শ্রোতা। জীবনের স্থিতি ও দৃঢ়তা এ বৈচিত্র্যেরই ফসল।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments