Karnaphuli Tunnel Project

কর্ণফুলী টানেল : চীনের সহযোগিতায়
চট্টগ্রাম হবে অর্থনৈতিক নতুন হাব

image source : profilebd.blogspot.com

বর্তমান সরকার অনেকগুলো মেগা প্রকল্প নিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করছে। ইতিমধ্যে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে চীনের সহযোগিতায় কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। চীন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বন্ধু। ইতিমধ্যে সরকার ১৭টি প্রকল্প চীনের সহযোগীতায় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং দেশের প্রধানতম বাণিজ্যিক রাজধানী। ৫৭ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের শহর চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনৈতিক বড় কর্মস্থল। কর্ণফুলী চট্টগ্রামের সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী। কর্ণফুলী নদী ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। মূলত কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে।
কর্ণফুলীর পূর্ব পাশের শিল্পাঞ্চল এবং পশ্চিম পাশে সমুদ্র বন্দর, বিমান বন্দর ও মূল নগরীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী উপযুক্ত হিপ্টারল্যান্ড এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী জরুফর। যাতায়াতের সময় কমিয়ে আনা, যানজটে কমানো এবং চীনের বেল্ট এন্ড কোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হতে প্রয়োজনে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আঞ্চলিক যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দিয়ে নির্মিত এই টানেলের নাম দেয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান টানেল।’ চট্টগ্রাম বিসিআইএস (বাংলাদেশ-চীন-ইন্ডিয়া মিয়ানমার) করিডোরের ৩য় নম্বর স্থানে অবস্থিত। চীনের কুনসিং থেকে শুরু করে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের কলিকাতায় গিয়ে শেষ হবে এ করিডোর।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্থল পথে টানেল রয়েছে, তবে সমুদ্র বা নদী তল দেশে টানেল নির্মাণ উপমহাদেশের অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম।

২০১৪ সালে জুনে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের টানেল স্থাপনে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এক বছর পর ২০১৫ সালে ৩০ জুন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ইয়াং চুয়ানতাঙ্গের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবসায়িক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালে অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শিং জিনপিং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০১৭ সালে ৬ নভেম্বর ঋণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০১৯ সালে ২৪ ফেব্রæয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের বোরিং কাজের শুভ উদ্বোধন করেন। প্রকল্পটির নির্মাণ কাজের মেয়াদ ধরা হয়েছে পাঁচ বছর। সেই অনুযায়ী ২০২১ সালে ডিসেম্বরে টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।

কেন এই টানেল :
সরকারি বিভিন্ন তথ্য বিবরণীতে দেখা যায় উক্ত টানেল নির্মাণের পিছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। চীনের কুনসিংকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের সাথে যুক্তকারী করিডোর বেল্ট এন্ড কোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরই) উদ্দেশ্য হচ্ছে :
১. পণ্য সেবা ও জ্বালানির বাজার প্রবেশগম্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি অশুল্ক বাঁধা দূরীকরণ।
২. বাণিজ্য সহজীকরণ ত্বরান্বিত করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা এবং খনিজ দ্রব্য পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের যৌথ উত্তোলন ও উন্নয়ন করা।
৩. এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা।
৪. চীনের সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রামকেও ‘ওয়ান সিটি’ এন্ড টু টাউন এর আদলে গড়ে তোলা।
৫. বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে আবর্তিত ব্লু ইউকোনমি সমর্থন দেওয়া।
৬. আনোয়ারা উপজেলায় এক্সক্লুসিভ চাইনিজ ইকোনমিক ও কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনকে আরও সমর্থন জোগানো।
৭. চট্টগ্রাম নগরীতে নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন করা।
৮. পরিবহন কেন্দ্রস্থল হিসাবে চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক শহরকে আরও বেশী শক্তিশালী করা।
৯. কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি প্রসার ঘটানো।
১০. কর্ণফুলী নদীর উপর বিদ্যমান দুই সেতুর ওপর থেকে যানবাহনের চাপ কমিয়ে আনা।
১১. ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান স্থানের সঙ্গে কর্ণফুলী পূর্ব পাশে নির্মীয়মান শহরের সংযোগ স্থাপন এবং উন্নয়ন কাজে গতি বৃদ্ধি করা।
১২. কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাশে নতুন শহর ও বসতি বাড়ানো।
১৩. চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা।
১৪. ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগের আরও উন্নয়ন করা।

টানেল প্রকল্পের বর্ণনা :
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে রোড টানেলটি হবে চার লেনের। টুইন টিউব টাইপের মূল টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩.৩১৫ কিলোমিটারের বাইরে পতেঙ্গা প্রান্তে ৫৫০ মিটার এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার কনভয়ের বেল্টের কারণে সেখানে থাকছে ৭২৭ মিটার ফ্লাইওভার ব্রিজ, যা আনোয়ারা উপজেলাকে চট্টগ্রাম নগরীর সঙ্গে সংযুক্ত করবে।

প্রবেশের পথ :
সরকারের বর্তমান প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রবেশ পথ হবে, বিমান বন্দর অর্থাৎ পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ পশ্চিম অংশের কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে নৌবাহিনী এভিনিউ এর সামনে।

বহির্গমন পথ :
কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে আনোয়ারা প্রান্তে সার কারখানা কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানী এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিঃ এর মাঝামাঝি স্থান দিয়ে।
টানেলের দৈর্ঘ্য হচ্ছে মোট ৯.৩৯২ কিলোমিটার। ডুয়েল অর্থাৎ দুই লেনের টানেল এইটি। শিল্প ড্রিভেন মেথন পদ্ধতিতে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। নদীর তলদেশ থেকে টানেলের গভীরতা হবে ১৮ থেকে ৩১ মিটার বা কমপক্ষে ৩৬ ফুট থেকে ১০৮ ফুট পর্যন্ত গভীর।

খনন পদ্ধতি:
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মেশিন এবং চীন থেকে আমদানী করা প্রায় তিন তলা ভবনের সমান উচ্চতার ৯৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২২ হাজার টন ওজনের খননের মূল যন্ত্র টানেল বোরিং মেশিন টিবিএম, দিয়ে মাটি, বালি, এমনকি শক্ত মাটি কেটে খনন কার্য সম্পাদন করা হচ্ছে। পাথরের ক্ষেত্রে ড্রিলিং এন্ড ব্লাস্টিং (ডিএন্ডবি) পদ্ধতি এবং মাটির ক্ষেত্রে প্রথাগত ‘হ্যান্ড মাইনিং’ এর বিকল্প হিসেবে টিবিএম ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

টানেলের অন্যান্য তথ্যঃ
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ আইন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। টানেলের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চায়না কমিনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানী লিমিটেড (সিসিসিসি)। অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না (এক্সিম) এর মাধ্যমে চীন সরকার। এটি বাংলাদেশে একক বৃহত্তম বিনিয়োগ। উক্ত টানেলের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ওভি অরূপ এন্ড পার্টনারস হংকং লিমিটেড, ডেভ কনসালট্যান্সস লিমিটেড, এসিই কনসালট্যান্টস লিঃ এবং স্ট্যাটেজি কনসালটিং লিমিটেড এর সহযোগি এসএমইসি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড, অষ্ট্রেলিয়া ও সিওডবিøউআই এ/এস ডেনমার্কের জয়েন্ট ভেনসর (এসএমইসি-সিও ডার উমাই জেভি) প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের ৪ হাজার ৪৬১ দশমিক ২৩ কোটি বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। বাকী ৫ হাজার ৩১৯ দশমিক ১৯ কোটি ঋণ সহায়তা দেবে আমাদের বন্ধু দেশ চীন।
কর্ণফুলী টানেল বাস্তবায়নের জন্য অনেকগুলি চুক্তি সরকার বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে করেছে। টানেলের নকশা, নির্মাণ ও কমিশনিংয়ের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন্স কোম্পানীর সঙ্গে নির্মাণ চুক্তির মধ্যে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। অ্যাপ্রোচ রোড, ভায়াডাকী, সার্ভিস ফ্যাসিলিটিজ এবং ইলেকট্রিকেল কন্ট্রোল সিস্টেম ও এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত।

প্রকল্পের জমি ও অন্যান্য বিষয়:
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ৩৮৩ দশমিক ৪৯২১ একর এলাকা নিয়ে। পশ্চিম পাশে পতেঙ্গা এলাকায় জমি প্রস্তাব করা হয়েছে ৭০ দশমিক ২২৫৫ একর। যার ৯৯ দশমিক ২৮ শতাংশ অর্থাৎ ৬৯ দশমিক ৭২০৫ একর জমি সিসিসিসি এর নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। অবশিষ্ট দশমিক ৫০৫০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলেছে। পূর্ব পাশে (আনোয়ারা) জমি প্রস্তাব করা হয়েছে ৩১৩ দশমিক ২৫ একর। অধিকাংশ জমি এরিমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। অবশিষ্ট ২২ দশমিক শূন্য ১ একর জমি অধিগ্রহণের পথে রয়েছে।
সরকার ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ১২৪ জনের মধ্যে ৬৩ কোটি ৯ লক্ষ ৩০ হাজার ৮৬৬ দশমিক ৪ টাকা বিতরণ করেছেন। অবশিষ্ট কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন হবে।

টানেল ব্যবস্থাপনা বিষয়:
টানেল পরিচালনার জন্য প্রয়োজন বিশেষ ব্যবস্থাপনা কাঠামো ও রিসোর্স। এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রথম। টানেলটি পরিচালনা দায়িত্বের ক্ষেত্র মূলত: চারটি: নিয়মিত পরিচালন, প্ল্যান্ট পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জরুরি মুহূর্তে দ্রুততম সময়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ। পরিচালনের ক্ষেত্রগুলো দুটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি পরিচালন বিভাগ অন্যটি প্রকৌশল বিভাগ। পরিচালন বিভাগের কাজ হবে টানেল এলাকায় নিরাপদ যান চলাচলের ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ করা। তাৎক্ষণিক জরুরি সেবা তলব, টানেলে যানবাহনের প্রবেশ তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ করা ও পরিচালন বিভাগের মূল কাজ।
আর টানেলের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্ব। টানেলের পরিচ্ছতা ও নানা রকমের রং এর কাজ ও এই বিভাগের। প্রশাসনিক ও অন্যান্য সহায়তামূলক কাজের দায়িত্ব পরিচালন বিভাগের অধীন প্রশাসন বিভাগের উপর।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে:
এই টানেল সমাপ্ত হয়ে কাজে রূপান্তরিত হলে দেশের বৃহত্তর অংশে অর্থনৈতিক আলোড়ন সৃষ্টি হবে। চট্টগ্রামের চেহারার পরিবর্তন ঘটবে। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক নগরীতে সত্যিকার অর্থে প্রবেশ করবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল হিসেবে সমগ্র দেশের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম তথা দক্ষিণ চট্টগ্রাম শহর নতুন রূপে সজ্জিত হবে।

মিয়ানমার-চীন-হংকং-থাইল্যান্ড-এর সংযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যাত্রা শুরু হবে পূর্বমুখী। তাই এখন থেকে দেশ পূর্বমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঢেউ লেগেছে। সেই ক্ষেত্রে চীনের ভ‚মিকা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কর্ণফুলী টানেল তৈরির প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে পরিচালন পর্যায়ে প্রতি বছর এই টানেলটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ মূল্য ৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা বা ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার সংযোজন করবে বলে ধারণা করা হয়েছে।
উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালে টানেল দিয়ে ৬৩ লক্ষ যানবাহন চলাচল করবে। টানেলটি চালুর তিন বছর পর এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৩৯ লক্ষ, ২০৫০ সালে তা হবে ৩ কোটি ৩৯ লক্ষ এবং ২০৬২ সালে ৫ কোটি ৫ লক্ষ।
টানেল দিয়ে কক্সবাজার যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হবে। দূরত্ব কমে দাঁড়াবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এতে অর্থের সাশ্রয় ঘটে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে বিমান বন্দর থেকে আনোয়ারার দূরত্ব কমে দাঁড়াবে মাত্র দুই কিলোমিটার। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী সহজে যাতায়াত করতে পারবে। সময় কম লাগবে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে সহজে, দ্রুত সময়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ফলে চট্টগ্রাম শহরের যানজট বেশ কমে আসবে।

এই টানেলকে কেন্দ্র করে বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গড়ে উঠবে। বিশেষ করে গভীর সমুদ্র বন্দর, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল, বাঁশখালীর কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিপুল সম্ভাবনার বেশীর ভাগই টানেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে।

বিভিন্ন ধরনের ২৩টি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ৩টি বড় কোম্পানী, গায়া প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানী ও ডেইগু প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানী তাদের ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা যায় রপ্তানিমুখি জুতা, তৈরী পোশাক শিল্প, টেক্সটাইল সহ নানা উৎপাদনমুুখি শিল্প প্রতিষ্ঠান উক্ত এলাকায় স্থাপিত হবে। তাতে অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকার যুবক মহিলাদের প্রচুর কর্মসংস্থান হবে।

অন্যদিকে ৭৮৩ একর জমি নিয়ে আনোয়ারায় চায়না ইকোনোমিক জোন স্থাপিত হচ্ছে। উক্ত এলাকায় চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। এখানে রপ্তানিমুখি জাহাজ শিল্প, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফার্নেশ ও সিমেন্ট শিল্প সহ ৩১টি শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে।

বেসরকারি ইকোনোমিক জোন তৈরি করছে দেশের দীর্ঘ ৩৭ বছর অভিজ্ঞ শিল্প গ্রুপ সাদ মুদ্রা গ্রুপ। তাদের ৪০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত শিল্প পার্কে চীন, কোরিয়া, জার্মান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশের শিল্প উৎসাহী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইউনাইটেড গ্রুপের পক্ষ থেকে ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হবে। অন্যদিকে এস. আলম গ্রুপ চীনের শেনডম ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শুরু করে দিয়েছে।

কক্সবাজার মহেশখালী মাতারবাড়ী এলাকায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি ষ্টেশনসহ জ্বালানিবিত্তিক বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাশে পারকির চরের ১ হাজার ৭০০ একর জমিতে কোস্টাল ট্যুরিজম উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। শীঘ্রই এর কাজ শুরু হয়ে যাবে। কর্ণফুলীর পশ্চিম পাশে দক্ষিণ পতেঙ্গাকে বিনোদনের স্থান হিসাবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। পতেঙ্গা সৈকতের আধুনিকায়নের পাশাপাশি আরও নতুন এলাকা উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হবে। উপক‚লে পশ্চিমের এলাকাকে ক্যাম্পিং, পিকনিক, বার্সিক ক্রীড়া ও অন্যান্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের জন্য সংরক্ষিত রাখা হবে। আর পতেঙ্গ সড়কের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাকে ব্যবহার করা হবে বিনোদন উদ্যান হিসাবে। বিমান বন্দর ও শিল্প কারখানার মাঝখানের স্থানকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহারের জন্য চিহ্নিত রয়েছে। বিমান বন্দর থেকে নেভি স্থাপনা পর্যন্ত হারবার ফ্রস্ট পাবলিক প্রমাণাড অর্থাৎ হাঁটার জন্য চওড়া রাস্তা হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে সেখানে পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে।

টানেলের বর্তমান অবস্থা:
স্বাধীনতার পঞ্চম বছরের সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে কর্ণফুলী টানেল এর কাজ এগিয়ে চলেছে। তবে করোনার কারণে কর্ণফুলী টানেলের কাজের গতি বেশ কমে যায়। দেশী শ্রমিকগণ করোনার কারণে কাজ ছেড়ে চলে গেলেও চীনের শ্রমিক ও প্রকৌশলীগণ কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়। দু’টি টিউবের মধ্যে করোনাকালে একটি টিউব বসাতে সক্ষম হয়। এখন দ্বিতীয় টিউব বসানোর কাজ চলেছে। প্রথম টিউব পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে আনোয়ারা গিয়ে শেষ হয়। দ্বিতীয় টিউবের কাজ আনোয়ারা প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পতেঙ্গায় শেষ হবে।
এ পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোর অগ্রগতি হয়েছে ৫৫.৫ শতাংশ। আর্থিকভাবে অগ্রগতি হয়েছে ৫০.২৬ শতাংশ।
চীনের জিয়াংসু এদেশের জিনজিয়াং শহরে টানেলের জন্য বসানো ২০ হাজার মেগামেন্ট এর মধ্যে ৯১ শতাংশ এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে। ৭৬ শতাংশ মেগামেন্ট চট্টগ্রামে এসেছে। প্রথম টিউবের রিং তৈরিতে অর্ধেক মেগামেন্ট বসানো হয়েছে এবং অবশিষ্টগুলি দ্বিতীয় রিং এ বসানো হবে। বর্তমানে ২৫৩ জন চীন এবং ৫৬৭ জন দেশী শ্রমিক কাজ করছে। চীনের টেকনিকেল টিম পুরোদমে টানেলের কাজ করছে। ডিসেম্বর ’২১ নাগাদ দ্বিতীয় টানেলের বোরিং কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

সবশেষে:
অতি আনন্দের বিষয় বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশে কর্ণফুলী টানেলের মতো বিদেশি আদলে তৈরি হচ্ছে এশিয়ার বৃহত্তম টানেল। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে এই টানেল যোগ করবে দেশের গৌরব, অহংকার। পুরো বিশ্ব আজ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। নজীরবিহীন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চীনের আন্তরিক সহযোগীতায় আমাদের স্বপ্নের টানেলের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে প্রভাব পড়ছে আমাদের জীবনধারণ , সমাজ ও জীবিকাসহ নানা ক্ষেত্রে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে টানেলের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে।
প্রস্তাবিত এই টানেল নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে বলে আমরা আশা করি। এই টানেলের ফলে দেশে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে দারিদ্র্যতা হ্রাসে ভ‚মিকাসহ বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিক যোগাযোগের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক ভ‚মিকা রাখবে। ২০২২ সালে কর্ণফুলী এই টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ হলে নদী কর্ণফুলীর তলদেশে সুড়ঙ্গপথ দিয়ে শুরু হবে গাড়ী চলাচল। বর্তমান বিশ্ব দেখবে দেশবাসীর স্বপ্ন, সাংহাইয়ের আদলে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের নতুন রূপ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের আর একটি বড় অর্জন। আমরা স্বপ্ন দেখি। পরিকল্পনা করি। বাস্তবায়ন করতে আমরা পারি। আমরা সক্ষম। আমরা পরিশ্রমী। আমরা সচেতন, সুনাগরিক। উন্নয়নের পথে আমাদের প্রিয় দেশ বাংলাদেশে।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments