Vocational education and 4th industrial revolution

কারিগরি স্কুল ও কলেজ স্থাপন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে মূল ভূমিকা রাখবে

কোন দেশের জনশক্তি কোন সমস্যা নয়, তা প্রমাণ করেছে চীন। বিপুল জনশক্তিকে কর্মীর হাতিয়ার বানিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি চালিকাশক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখছেন। করোনা ভাইরাসের ফলে চীন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমদানী-রফতানীর গতি হ্রাস পাওয়ার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ প্রভাব পড়া শুরু করেছে। চীন তার বিপুল জনশক্তিকে কারিগর শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তিতে বলীয়ান হয়ে শিল্পের সকল স্তরে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। শিল্প বাণিজ্যে তাই চীনের বিকল্প কেউ দাঁড়াতে পারে নাই। ক্ষুদ্র শিল্প থেকে ভারী শিল্প পর্যন্ত চীন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর দেশ।


আমাদের দেশের জনশক্তি প্রায় এখন ১৮ কোটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবে জনশক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই অনুযায়ী ২০৫০ সালে আমাদের জনশক্তি দাঁড়াবে প্রায় দ্বিগুণের বেশী। এই বিপুল জনশক্তিকে কর্মীর হাতিযারে পরিণত করে দেশকে উন্নত দেশে উন্নীত করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা ছাড়া দ্রæত দেশের মানুষকে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনক্ষম করার কোন বিকল্প নাই। তাই সরকার এই বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিগত একনেক বৈঠকে ৩২৯টি উপজেলা একটি করে কারিগরি স্কুল ও কলেজ কতবার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। এইটি অত্যন্ত চমৎকার সিদ্ধান্ত। সময়ের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত বেশ পরিপূরক। এই প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর আবারও একাধিক কারিগরি স্কুল ও কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা নিতে হবে। এক বিপুল জনশক্তির জন্য প্রতিটি উপজেলায় একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন।


কারিগরি শিক্ষার বিকাশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন মোড় সংযোজন করেছে। সাধারণ শিক্ষার ভিড়ে কারিগরি শিক্ষা আগে সাধারণ মানুষের কাছে এত গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও বর্তমানে কর্মসংস্থানের বিভিন্ন সুযোগ ও সরকার কর্তৃক গৃহীত ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি ঘোষণার কারণে কারিগরি শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১২ সালে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫০২টি (যার মধ্যে সরাকরি প্রতিষ্ঠান ছিল ৩৩৮টি) যা জানুয়ারি ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৪৫২টিতে (যার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ৬৯৩টি)। একই প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায, ২০১২-২০১৩ সেশন থেকে ২০১৮-২০১৯ সেশন এই সাত বছরে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫৭.২৬ শতাংশবৃদ্ধি পেয়েছে যার অন্যতম কারণ হতে পারে কারিগরি শিক্ষার পর কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি।


আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। তাই এই নারীদেরকে কীভাবে কারিগরি শিক্ষায় সম্পৃক্ত করা যায় সেদিক লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার প্রেক্ষিতে এই নারীরাও সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-২০১৯ অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষায় ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় ৭৭.৫৩ শতাংশ।


শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে কর্মক্ষেত্রে অনেক কারিগরি পেশাগত কর্মীর চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশ থেকে অনেক শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি দিতেন, তাদের মধ্যে কারিগরি জ্ঞানের অভাবে তারা নানা জায়গায় ভালো চাকরির সুযোগ পেতেন না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এবং কারিগরি খাতে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে অনেক দক্ষ শ্রমিক গড়ে উঠেছে তা দেশে বিদেশে শিল্প কারখানায় কারিগরি ও দক্ষ জনশক্তি চাহিদা পূরণ করতে পারবে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড প্রকাশিত গবেষনা প্রতিবেদন অনুযায়ী সনদপ্রাপ্ত স্নাতকদের মধ্যে প্রায় ৯৪.৪ শতাংশ স্নাতক বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত আছে যার মধ্যে প্রায় ৭৭.১ শতাংশ চাকরিরত ও ১৭.৩ শতাংশ আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত। যার মধ্যে অনেকে বিদেশেও কর্মরত রয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত স্নাতক ডিগ্রিধারীরা ৯৫.৯ শতাংশ সন্তুষ্ট এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ৯২.৯ শতাংশ।


কোনো দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য সে দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হলে কারিগরি শিক্ষা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী নিয়োগের পাশাপাশি বিদেশেও এইসব কারিগরি শিক্ষিত কর্মী পাঠানো যাবে যার মাধ্যমে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে কর্মরতরা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা রেমিট্যান্সের তুলনায় বর্তমান অর্থবছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২১.৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (উৎস: বাংলাদেশ ব্যাংক) যার মধ্যে কারিগরি স্নাতক ডিগ্রিধারীদের অবদান উল্লেখযোগ্য বলা যায়।


যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে হলে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কাগিররি শিক্ষার মূল লক্ষ্য থাকবে দেশের বিপুল অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা, যাতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে নতুন আলো খুঁজে পায়। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে পারলে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সাহায্য করবে।
কিছু পরামশর্ :-
১) আমাদের দেশে কারিগরি স্কুল সরকারী ও বেসরকারীভাবে ১০ হাজার ৪৫১টি রয়েছে। ৩২৯টি স্থাপিত হওয়ার পর সরকারীভাবে কারিগরি স্কুলের সংখ্যা হবে ১ হাজার ২২টি। এই সকল স্কুরের সিলেবাসে পরিবর্তন থাকতে হবে। আধুনিকভাবে প্রতিটি বিষয়ে সিলেবাসকে উন্নত করতে হবে। বাজার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাকে সাজাতে হবে। অনেক পূর্বের তৈরী সিলেবাস অনুযায়ী স্কুল গুলিতে পড়ানো হচ্ছে।


২) কারিগরি স্কুল ও কলেজ সমূহে বিষয় ভিত্তিক পর্যাপ্ত ও আধুনিক ল্যাব প্রায় প্রতিষ্ঠানে নাই। প্রতিটি বিষয়ের ল্যাবকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। আবার কোন কোন স্কুলে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও ল্যাব শিক্ষক নাই। শিক্ষক ও ল্যাব শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন অনযায়ী নিশ্চিত করা জরুরী। ছাত্রছাত্রীগণ শিক্ষকদের অভাবে মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ল্যাব শিক্ষক না থাকার ফলে হাতে কলমে শিক্ষা ও ছাত্রছাত্রীগণ যাচ্ছে না।

৩) বিদেশে বেশ কয়েকটি বিষয় কর্মীর চাহিদা অনেক বেশী। যেমন বিদ্যুত, এসি, প্লামবিং, ফ্রিজ, উক্ত মেকানিকস, সিভিল ওয়ার্ক আইটি প্রভৃতি বিষয দেশে ও বিদেশে বেশ চাহিদা রয়েছে। এই প্রর্কপ বিষয়ে ৬ মাস, ১ বছর ৩ বছর মেয়াদী কোর্স রয়েছে। এই সকল কোর্স ভালভাবে সমাপ্ত করতে পারলে যে কোন ছাত্রছাত্রী দেশে বিদেশে চাকুরি পাবে। এখন শুধু মাত্র অদক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে আমরা যে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছি, দক্ষ করে পাঠাতে পারলে আমাদের বৈদেশিক আর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।


৪) আমাদের শিক্ষানীতিতে একটি পরিবর্তন আনা দরকার। তা হচ্ছে অষ্টম শ্রেণী পাসের পর স্কুলের শিক্ষকগণই উক্ত ছাত্রকে কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবে তা দিক নিদেৃশনা দেবে। কোন ছাত্র কারিগরি শিক্ষা করবে তাকে অষ্টম শ্রেণী পাসের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে দিতে হবে। দশম শ্রেণী পাসের পর কোন ছাত্রছাত্রী কোন ভিভাগে পড়বে তা ঠিক করার সুযোগ দিতে হবে। কয়েকদিন পূর্বে পালনীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দশম শ্রেণী পর্যন্ত কোন বিভাগে না রেখে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। এই পরামর্শ ও নির্দেশনা বেশ উত্তম।


আবার এইচএসপি পাসের পর কোন ছাত্র কোন বিভাগে পড়াশোনা করবে তা মেধা অনুযায়ী কলেজ ঠিক করে দেয়ার বিধান চালু করতে হবে। সকল ছাত্রছাত্রী অনার্স বা পাস কোর্সে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নাই। এইচএসসি পাসের পরও ছাত্রছাত্রীদেরকে টেকনিকেল শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহী করতে হবে। যে সকল ছাত্রছাত্রী রিচার্স করবে না উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের যোগ্যতা রাখবে সেই সকল ছাত্রছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার নিয়ম চালু করতে হবে। বর্তমানে ডিগ্রি ও মাস্টার ডিগ্রি পাস লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী চাকরির বাজারে অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে টেকনিকেল শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রছাত্রীর অভাবে আমাদের টেকনিকেল চাকরিতে জনশক্তির অভাব। এই অভাব পূরণে শিক্ষানীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে হবে।


৫) ছাত্রছাত্রীদের উপর পড়াশোনার ও কোচিং চাপ কমানোর জন্য ৫ম শ্রেণী ও অষ্টম শ্রেণী থেকে বাধ্যতামূলক প্রচলিত বার্ষিক পরীক্ষা বাদ দিতে হবে। ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে পরীক্ষার ফলে ছাত্রছাত্রীদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কোচিং বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত কোটি কোটি টাকা এই দুইটি পরিক্ষার জন্য খরচ হয়। এই অর্থ সমূহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও ল্যাব তৈরিতে আমরা ব্যবহার করতে পারি। তাতে শিক্ষা খাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। পূর্বের ন্যায় শুধুমাত্র এসএসসি ও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাসমূহ শুধু চালু থাকবে।
কারিগরি শিক্ষা আমাদের অর্থনীতিতে আগামীতে ব্যাপক পরিবর্তন থাকবে। দেশে বিদেশে আমাদের পক্ষে জনশক্তি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments