হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্যে। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। গল্প, গান, উপন্যাস, কল্প-বিজ্ঞান, ভ্রমণ কাহিনী, প্রবন্ধ, আত্মকথা আরও কত কী? নাটক লিখেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত নিজকে সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। তার সর্ব শেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’। ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রথম দুইটি বহুল নন্দিত উপন্যাস। জীবনের শুরুতে এই দুটি উপন্যাসই হুমায়ুন আহমদ পাঠক সমাজে সু পরিচিত করে তোলে।
হুমায়ুন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রামে। পিতা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ। মাতা আয়েশা ফয়েজ। ছোট বেলায় বাবা তার নাম রাখেন শামসুর রহমান কাজল। পরবর্তী তিনি তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন হুমায়ুন আহমেদ।
১৯৭৩ সালে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। কার্জন হল সংলগ্ন আমার বিভাগ। আমার সাবসিডিয়ারী বিষয় ছিল রসায়ন এবং উদ্ভিদ বিদ্যা। রসায়ন পড়ার সুযোগে তখন আমি হুমায়ুন আহমেদের ছাত্র। কয়েকটি ক্লাশ রসায়ন বিভাগে করার সুযোগ হয়েছিল। তখন অবশ্য তিনি সাহিত্যিক হিসাবে আমাদের নিকট বহুল পরিচিত ছিলেন না। কিছুদিন পর তিনি পিএইচডি করার জন্য আমেরিকায় চলে যান। তাই তেমন বেশী পড়ার সুযোগ পাই না। ১৯৮২ সালে তিনি পলিমার রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন।
হুমায়ুন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান ও একজন ভালমানের লেখক ছিলেন। যখন তিনি বগুড়া চাকরী করতেন তখন তার ‘দ্বীপ-নেভা যার ঘরে’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় হানাদার বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শহীদ হলেন ফয়জুর রহজমান। পিতার মৃত্যুর পর হুমায়ুন আহমেদ এর সংগ্রামী জীবনের সূচনা হয়। মমতাময়ী মা আয়েশা ফয়েজ এর যতেœ, আদরে বেড়ে উঠেন হুমায়ুন আহমেদ। বাবা সরকারী চাকুরীর কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গার প্রকৃতি ও পরিবেশের রূপরস তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ১৯৬৫ সালে তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে থেকে রাজশাহী বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে মাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৭ সালে মেধাতালিকায় স্থান লাভ করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে উচ্চতর ডিগ্রী লাভের পর ১৯৮২ সালে পলিমার
রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। মা আয়েশা ফয়েজ ও একজন ভাল লেখিকা। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘জীবন যে রকম’ পাঠক সমাজে খুবই সমাদৃত।
২০১২ সালে ১৯শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহার্টনের বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ুন আহমদ ক্যানসারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু খবর শোনে সারাদেশের মানুষের হৃদয় যেমন ভেঙ্গে গেলো, তখন আমারও বেশ খারাপ লাগলো যে, আমার শিক্ষক, আমাদের সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়ে সংবাদে। বেশ কয়েকদিন বেশ খারাপ অনুভব করলাম। তখন মনের মধ্যে একটি বিষয় উঁকি দিল হুমায়ুন আহমেদ জন্য কিছু একটা করতে হবে। তখন খুব দ্রুত তার বিদায়কালীন পত্র-পত্রিকার সকল, লেখা নিয়ে ‘হুমায়ুন আহমেদকে যেমন দেখেছি’ নামে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আমার ‘লেখালেখি’ প্রকাশনী থেকে গ্রন্থটি প্রকাশ করলাম। বইটির কয়েকটি কপি নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ সঙ্গে মীরপুর বাসায় এক প্যাকেট ভাল মিষ্টি নিয়ে দেখা করলাম। তিনি অতি সহজে, ভদ্রভাবে আমাকে গ্রহণ করলেন। বইটি হাতে তুলে দেখলেন। বললেন বেশ সুন্দর হয়েছে। তুমি অনেক ভাল কাজটি করেছ।
হুমায়ুন আহমেদ এর মৃত্যুর পর লেখক কুতুবউদ্দিন, আহমেদ “বাংলা সাহিত্যের জ্যোৎস্না ঢেকে গেল মেঘ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেন, “আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, একজন হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাংলা ভাষায় এমন জনপ্রিয় নন্দিত, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব শরৎ চন্দ্র ছাড়া আর কেহ জন্মাননি। এমন কি বলা যায় যে, জনপ্রিয়তাকে তিনি শরৎচন্দ্রকেও হার মানিয়েছেন।”
লেখক হুমায়ুন আহমেদের লেখালেখির স্ফুরণ ঘটেছিল তার ছাত্রজীবন থেকেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থাকা কালীন তার প্রথম উপন্যাস লিখে ফেলেন। এই নিয়ে বেশ ভাল একটি গল্প আছে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটিতে তাদের বাড়ী ডিপরোজপুরে গেলেন। তখন ছিল বর্ষাকাল। কিছুক্ষণ হলো সন্ধ্যা নেমেছে। খুব বৃষ্টিতখন হচ্ছিল। হুমায়ুন আহমেদ বই খুলে বসেছেন। খাতায় টুকটাক কিছু লিখছেন। নোট খাতাতেই তিনি লিখে ফেললেন, ‘বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম।’ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ফুকে গেলেন তিনি। একের পর এক লাইন লিখে গেলেন তিনি নীল মলাটের খাতায়। এত দ্রুত লিখলেন যে তিনদিনের মধ্যে তিনি উপন্যাসটি লেখা শেষ করলেন। লেখা শেষ হলো উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার।’ উপন্যাসটি হুমায়ুন আহমেদের জীবনের প্রথম উপন্যাস। হুমায়ুন আহমেদ চিন্তা করলেন কিভাবে লেখাটি বাবাকে দেখানো যায়। সরাসরি বলতে লজ্জাবোধ করছিলেন। তাই একদিন তিনি বাবার অফিসে গেলেন। একটি ফাইলের মধ্যে উপন্যাসটি লুকিয়ে রাখলেন লিখিত খাতা। বাবা ফয়জুর রহমানও সরাসরি ছেলে হুমায়ুন আহমেদকে এই ব্যাপারে কিছু বললেন না। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। তাই একদিন সন্ধ্যাবেলা মাগরিবের নামাজ শেষে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, “আল্লাহপাক তোমার বড় ছেলেকে লেখক বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। শুকুর আলহামদুল্লিাহ।” সূত্র-২২শে জুলাই ২০১২, দৈনিক কালের কন্ঠ।
হুমায়ুন আহমেদের জীবন ছিল সংগ্রাম মুখর। পিতা হারানোর পর সন্তানদের নিয়ে কঠিন সময় পার করেন মা আয়েশা ফয়েজ। কিন্তু উপযুক্ত মানুষ করে দুনিয়াতে সন্তানদের তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই তিনি ‘স্বর্ণ গর্ভা মা।’ নানা ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। আবার একই সাথে নানা বর্ণে বর্ণিলও ছিল তার জীবন। একই সাথে নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও নানা রঙে রাঙায়িত সুখ-দুঃখ নিয়ে এক মধুর জীবন তৈরী হয়েছিল তার। পাঠক তাকে গ্রহণ করেছিল একান্ত নিজের মানুষ মনে করে। সকল শ্রেণীর সকল দলের, সকল মতের মানুষ ছিল হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্যের প্রতি প্রচুর আগ্রহ। তিনি ধীরে ধীরে পুরো জাতির সঙ্গে এক গভীর আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কোন বিষয়ে, যে কোন সময় তার যে কোন মতামত গ্রহণ করে নেয়ার মানসিকতা পুরো জাতির মধ্যে তৈরি হয়েছিল। ঠিক সে সময় মহান আল্লাহপাক তাকে পৃথিবী থেকে তুলে নিলেন অপর দুনিয়ায়।
হুমায়ুন আহমেদ মৃত্যুর পর এ বাংলা এবং অপর বাংলার কবি-সাহিত্যিকেেদর মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে যায়। নানা বক্তব্য সে সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের পাঠকের হৃদয় জয় করে ভারতের পশ্চিম বাংলায়ও বিশাল এক পাঠক-গোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার হিমু চরিত্রটি বাংলাদেশে যেমন জনপ্রিয় তেমনি পশ্চিম বাংলায় ও জনপ্রিয়। তার নন্দিত নরক যে কোন পাঠক পড়ে মুগ্ধ হবেন। তার জনপ্রিয়তা পশ্চিম বাংলা এত বেশী ছিল যে, দেশ পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় টানা আট বছর তার উপন্যাস ছাপা হয়েছে। পশ্চিম বাংলার কোন লেখকের ভাগ্যে এই ভালবাসা কখনো জোটেনি। এতেই আমরা বুঝতে পারি তার পাঠক পরিধি কত বড় কত বিশাল ছিল।
দৈনিক প্রতিদিন ২১শে জুলাই ২০১২ সংখ্যায় জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “বাংলা শিল্প সাহিত্যের কোথায় ছিল না সে? একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার এবং একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। এর বাইরে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যেও পথিকৃৎ যে। তার লেখনিতে ছিল এক যাদুকরী ক্ষমতা। বাক্যের বিন্যাসে, শব্দের প্রয়োগে আর ঘটনার ঘনঘটায় তার লেখায় মুহূর্তের মধ্যেই পাঠকদের আগ্রহ বাড়িয়ে দিত। তার শব্দচয়ন ও বর্ণনাভঙ্গি তার সাহিত্যকে আরও মজবুত করেছে।”
বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ২১শে জুলাই ২০১২ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে বলেন, “হুমায়ুন ছিলেন গল্পের জাদুকর। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কলমের জাদু নিয়ে তরুণ পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারতেন। হুমায়ুন ছিলেন পাঠক তৈরির প্রকৃত কারিগর। পাঠকের হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।”
সুদীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ। তার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে যে, অন্য কেউ তার ধারে কাছে পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মৃত প্রায় শিল্পকে শ্রোতবাহী নদীতে তিনি রূপান্তর করেছেন। তার লেখনির মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেছেন বিশাল এক পাঠক সমাজ। এ প্রকল্পের কেউ যদি একটি বই পড়ে থাকেন তা হবে লেখক হুমায়ুন আহমেদের। এক কথায় তিনি নতুন প্রজন্মকে বই এর প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিজস্ব স্টাইলে বাকভঙ্গি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নানা টানা পোড়েন, সুখ-দুঃখ, ভালবাসা তিনি তুলে ধরেছেন যা পাঠক সমাজকে মন্ত্রের মতো টানে। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস পড়ে পন্ডিত আহমদ শরীফ ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, “বাংলা সাহিত্যে ক্ষেত্রে এক নিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারকের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।” মাত্র চারটি উপন্যাস লিখে হুমায়ুন আহমেদ ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, নাটক, চলচ্চিত্র প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে তিনি কবিতাও রচনা করেন। বাসব, রাশান, রোনেট, বাবার চিঠি, কাচ পোকা, তিনি, কব্বর, সংসার অশ্রু ও গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না প্রভৃতি শিরোনামে বহুল প্রচারিত সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখেন। তার কাব্যগ্রন্থ ও রয়েছে। অ তার লেখা ‘গৃহত্যাগী জোছনা’ কাব্য গ্রন্থে তিনি লিখেন-
আমি যাচ্ছি নাখালপাড়ায়
আমার বৃদ্ধ পিতা আমাকে পাঠাচ্ছেন তার
প্রথম প্রেমিকার কাছে।
আমার প্যান্টের পকেটে সাদা খামে মোড়া বাবার লেখা দীর্ঘ পত্র।
খুব যতেœ খামের উপর তিনি তার প্রণয়িনীর নাম লিখেছেন অ।
কে জানে চিঠিতে কি লেখা?
তার শরীরের সাম্প্রতিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা?
রাতে ঘুম হচ্ছে না, রক্তে সুগার বেড়ে গেছে
কষ্ট পাচ্ছেন হাঁপানিতে এইসব হাবিজাবি প্রেমিকার কাছে
লেখা চিঠি বয়সের ভারে প্রসঙ্গ পাল্টায়
অন্য রকম হয়ে যায়।
লেখক জীবনে হুমায়ুন আহমেদ প্রায় তিনশটি গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় স্থান দখল করে আছে উপন্যাস। কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদ আমাদের তরুণ প্রজন্মের গর্ব। তরুণ সমাজ তাকে নিয়ে ভাবে। তার উপন্যাস পড়ে আনন্দ পাই। আজও প্রতিদিন, প্রতি বছর যে সকল পাঠক উপন্যাস, গল্প, মন্ত্র সপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, নি, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, গৌরিপুর জংশন, লীনাবতী, বহুব্রীহি, ছবি, নৃপতি, অমানুষ, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথা কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টিও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাব যাব, আজ আমি কোথাও যাব না, আমার আছে জল, আকাশ ভরা মেঘ, মহাপুরুষ, শূন্য, ওমেগা পয়েন্ট, ইমা, আমি ও আমরা, কে কথা কয়, অপেক্ষা, পেন্সিল আঁকা পরী, হিমু, আজ হিমুর বিয়ে, আমিই মিসির আলি, বৃষ্টি বিলাস, , আমার মেয়ের সংসার, দেয়াল ইত্যাদি।
হুমায়ুন আহমেদ গান লিখতেন, সুর দিতেন, গান গাইতেন। গান শোনতে খুব ভালবাসতেন, হুমায়ুন আহমেদ স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন তার গান শোনা লেখা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তার এক নিবন্ধে শাওন বলেন, “আমাদের প্রায় সব গানের আসর মৃত্যু সঙ্গীত দিয়ে শেষ হলেও হুমায়ুন আহমেদ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওই বিশেষ গানটি আমি গাইতে চাইতাম না।
পাঠকের যেমন মৃত্যু হয়, শ্রোতারও মৃত্যু হয়। অতি প্রিয় গান এক সময়ে আর প্রিয় থাকে না। তবে কিছু গান আছে কখনো তার আবেদন হারায় না। আমার কাছে মরমী কবি গিয়াসউদ্দিনের একটি গান সে রকম।” গানটি হুমায়ুন আহমেদের খুবই প্রিয় ছিল।
গানটির পঙক্তি-
‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়
ও যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়’।
কিন্তু হুমায়ুন আহমদে অনুরোধে গানটি শাওন গাইলেন। গানটি শোনে হুমায়ুন আহমেদ প্রথম দিনের মতো কাঁদলেন। এরপর আর গান শোনানো হয়নি তাকে।”
হুমায়ুন আহমেদ লিখিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ হচ্ছে : বল পয়েন্ট, রঙ পেন্সিল, কাঠ পেনসিল, ফাউন্টেন পেন, নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ প্রভৃতি।
চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাণে হুমায়ুন আহমেদ অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সকল চলচ্চিত্রকারদের পেছনে ফেলে তিনি শীর্ষে চলে আসেন। দর্শক প্রিয় চলচ্চিত্র হচ্ছে : আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, চন্দ্রকথা, সর্বশেষে ঘেটুপুত্র কমলা।
জনপ্রিয় নাটক সমূহ হচ্ছে : এই সব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত অয়োময়, নিমফুল আজ রবিবার ইত্যাদি।
হুমায়ুন আহমেদ প্রচুর গল্প লিখেছেন গল্প ও বেশ জনপ্রিয় তার। নিজ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে হুমায়ুন আহমেদ তার লেখা উপন্যাস ‘মাতালি হাওয়া’ গ্রন্থে বলেন-
“আমি মূলত একজন গল্পকার। গল্প জানাতে আমি ভালবাসি। দুর্বোধ্য কারণে ইতিহাস আমার পছন্দের বিষয় না। আমি বর্তমানের মানুষ।
আমার কাছে অতীত হচ্ছে অতীত। লেখকের সমস্যা হলো তারা কাল অপেক্ষা করে লিখতে পারে না। তারা যদি বিশেষ কোনো সময় ধরতে চান, তখন ইতিহাসের কাছে হাত পাততে হয়।
ঊনসত্তর আমার অতি পছন্দের একটি বছর। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু ঊনসত্তর। একটি মহান গণআন্দোলনকে কাছ থেকে দেখা হয় এই উনসত্তরেই। মানুষ চন্দ্র বিজয় কর ঊনসত্তরে। মাতাল সেই সময়কে ধরতে চেষ্টা করেছি ‘মাতাল হাওয়ায়।’।
হুমায়ুন আহমেদ মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’ প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ করেছেন অন্যপ্রকাশ। উপন্যাসটির ভুমিকা লিখেছেন বিখ্যাত গুণী ব্যক্তি, আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষা গুরু অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। গ্রন্থের ভুমিকায় আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেন, “দেয়াল উপন্যাসের প্রথমদিকে হুমায়ুন আহমেদ নিজের উল্লেখ করেছে প্রথম পুরুষে শেষ দিকে এসে উত্তমপুরুষে নিজের কথা সে বলে গেছে। আমরা জানতে পারি অনেকেরই তা অজানা নয় যে শহীদ পরিবার হিসেবে ঢাকা শহরে হুমায়ূনদের সরকারিভাবে যে বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয় রক্ষী বাহিনীর এক কর্মকর্তা তা দখল করে তাদেরকে নির্মমভাবে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে পথে নামিয়ে দেয়, হুমায়ুনের মা এবং ভাই বোনেরা শুধু চরম অপমানের শিকার হন, তা নয়, নিরাপত্তার সম্পূর্ণ অভাবে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক হুমায়ুনকে বাকশালে যোগ দিতে চাপ দেয়া হয় এবং চাপের কাছে নতি স্বীকার করে রসায়ন বিভাগে, রেজিস্ট্রারের অফিসে এবং উপাচার্যের দপ্তরে ছুটাছুটি করেও শেষ পর্যন্ত সময় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে তার প্রয়াস নিষ্ফল হয়, বাকশালে যোগদান থেকে সে বেঁচে যায় বলতে হবে। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধুর সরকার সম্পর্কে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।”
হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাসে নতুনত্ব থাকে, চমক থাকে। ব্যক্তি জীবনেও তিনি খুব রসিক লোক ছিলেন। সব সময় সকলকে হাসাতে ভালবাসতেন। কৌতুক বলা তার যেমন নেশা, তেমনি ভাল অভ্যাস ছিল। লেখকের ‘দেয়াল’ উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে তার স্বভাবসিদ্ধ এপিগ্রাম। কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করে ড. আনিসুজ্জামান তাঁর ভূমিকা লেখা শেষ করেন।
মানুষ এবং পশু যে বন্ধু খোঁজে তা না তারা প্রভুও খোঁজে।
এই পৃথিবীতে মূল্যবান শুধু মানুষের জীবন, আর সবাই মুল্যহীন।
কিছু বিদ্যা মানুষের ভেতরে থাকে। সে নিজেও তা জানে না।
যে লাঠি দিয়ে অন্ধ মানুষ পথ চলে, সেই লাঠি দিয়ে
মানুষও খুন করা যায়।
মানব জাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার
আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।
অমর হুমায়ুন আহমেদ মৃত্যুকে জয় করেছেন। কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যেদিন নিউইয়র্কের হাসপাতালে ঢোকেন, সে দিন ডাক্তারকে প্রথম যে কথাটি জিজ্ঞেস করেছিলেন তা হলো ডক্টর আমি আর কত দিন বাঁচব? ডাক্তার বলেছিলেন তা বলা মুশকিল। এই প্রশ্নের পিছনে অনেক তথ্য লুকায়িত। তিনি জানতেন অতি অল্প সময় তাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু তাঁর অনেক স্বপ্ন এখন পূরণ হয়নি। তার স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছায় ‘কত দিন বাঁচবেন’ জানতে চেয়ে ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিলেন। মানুষ বাঁচতে চায়। কিন্তু আল্লাহপাক যাকে যতদিন বাঁচতে দেবেন, শুধু তত দিনই বেঁচে থাকতে পারবেন। জন্ম-মৃত্যু মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট সম্পূর্ণরূপে বিরাজমান। হুমায়ুন আহমদ স্বশরীরে হয়তো আজ আমাদের মাঝে নাই। কিন্তু তার সাহিত্য, তার সৃষ্টি তার সুকাজসমূহ বিরাজমান। হুমায়ুন আহমদ স্বশরীরে হয়তো আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার সাহিত্য, তার সৃষ্টি তার সুকাজসমূহ বিরাজমান। তা দিয়ে তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।
সৃষ্টি কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ হুমায়ুন আহমেদ জীবত অবস্থায় বহু পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। পুরস্কার গুলো হচ্ছে : বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৮১, একুশে পদক ১৯৯৪, শিশু একাডেমী পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ১৯৯৩-১৯৯৪, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার ১৯৯০, লেখক শিবির পুরস্কার-১৯৭৩, মাইকেল মধুসুদন দত্ত পুরস্কার ১৯৮৭, বাচসাস পুরস্কার ১৯৮৮, জয়নুল আবেদিন স্বর্ণপদক ইত্যাদি।
যে কোন লেখকের লেখা কতোদিন বাঁচবে তা নির্ভর করে সেই লেখার আবেদনের ওপর। এই আবেদন যতদিন থাকবে, ততোদিন নিশ্চয় হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকবেন। সমাজ ও সমাজ মানস দ্রুত বদলায় ফলে এক সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখার যে আবেদন তা পরবতী সময়ে থাকে না। তবে বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ মানস যতই দ্রুত বদলাক, হুমায়ুন আহমেদের স্বকাল থেকে তার উত্তরণ সহসা ঘটবে মনে হয় না। সুতরাং তিনি আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
Ok Br Haider.this is Br zohurul islam. now livinliving in Toronto congratulate for your. contribution in inndustry,education and literatures ..Enjoyed your piece on Humayu Ahmed.
.
লেখক হুমায়ৃন আহমেদ সম্পর্কে আপনার সুন্দর লেখাটা পড়লাম।আপনি বলেছেন যে আপনি ওনাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ।সত্যিই আপনি ভাগ্যবান ওনার মত একজন প্রথিতযশা ক্ষনজনমা পুরুষের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন।সত্যিই হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন পন্ডিত ব্যক্তি ।আপনার মত আমিও সুদীর্ঘ ৫টি বছর ওনার কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছিলাম।সেটা সম্ভব হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে একই শেনীতে পড়াশোনা করার কারনে অর্থাৎ আমি হুমায়ূন আহমেদের সহপাঠী হওয়ার সুবাদে ।সে যাইহোক আপনি হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে যথার্থই লিখেছেন ।যদিও তিনি ছিলেন একজন রসায়নবিদ। কিন্তু সাহিত্য,নাটক,সিনেমা,বিজ্ঞান প্রতিটি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল অপরিসীম ।এমন একজন প্রতিভামান মানুষকে হারিয়ে বাংলাদেশের অপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে ।দোয়া করি মহান রাববুল আলামীন ওনার আত্মাকে শান্তি দান করেন।