জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কার প্রয়োজন খুব বেশী। সমাজ, রাষ্ট থেকে শুরু করে ব্যক্তি জীবনে সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থনিিতর সংস্কার বিষয় আজ বিশ্বময় বড়ই প্রয়োজন। উন্নত ,অনুন্নত ও দারিদ্র সকল দেশের অর্থনীতিতে নিয়মিত সংস্কার চলছে। সংস্কার নিত্য দিনের বিষয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহ যখন আমাদের আর্থিক খাতের সংস্খারের কথা বলে তখন আমরা একটু হলেও নড়ে চড়ে বসি। চেষ্টা করি আর অর্থের প্রয়োজন হলে তো সংস্কার কর্মসূচি হাতে না নিলে বিশ্ব ব্যাংক টাকা দিতে বেশি বিলম্ব করে। হয়তো অনেক সময় ঋনও পাওয়া যায় না।
তবে সংস্কার নিজের জন্য, নিজের সমাজের জন্য, নিজের রাষ্ট্রের দুর্বলতা দূর করার জন্য সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার কোন প্রসাধনী নয়। কোন আরাম আয়েশ করার বিষয় নয়।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনঃ বিগত ২৯ সেপ্টেম্বর’২২ বিশ্ব ব্যাংক ‘ চেইঞ্জ অব ফ্যাব্রিক’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, অর্থনীতিতে সংস্কার না হলে ২০৩৬ সালে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ নেমে আসবে। মোটামুটি সংস্কার হলে জিডিপি হবে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে ভাল সংস্কার হলে জিডিপিতে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন তিনটি খাতের উপর বিশেষ সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। অবশ্য সরকার এই তিন খাতে সংস্কার কিছু কিছু সব সময় করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের এই সংস্কারে খাত তিনটির তেমন কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাই বিশ্ব ব্যাংক প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করেছে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে, ব্যবসায় প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে হলে,আর্থিক খাত, নগরায়ন, ব্যবসায় প্রতিযোগীতা সক্ষমতা এ তিন খাতের ব্যপক সংস্কার করা প্রয়োজন।
সংস্কার না হলে কি হবেঃ বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বর্তমানে যে ভাবে চলেছে, সংস্কার খুবই কম করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তাতে ক্রমান্বয়ে প্রবৃদ্ধি কমতে থাকবে। ২০২৬ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ নেমে আসবে। পরের ৫ বছর প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৫.৫ শতাংশ। আর ২০৩৬-২০৪১ সালে প্রবৃদ্ধি এই ভাবে কমে দাঁড়াবে ৫.০ শতাংশে। আবার সব চেয়ে ভাল সংস্কার হলে ২০৩৬-২০৪১ সালে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়ে ৭.৫০ শতাংশে পৌঁছবে। ভাল সংস্কার না হলে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৪১ সালে যে উন্নয়নের লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করেছে তা অর্জনে অনেক অনেক পিছিয়ে থাকবে।
কি কি সংস্কার চেয়েছে:
বিশ্ব ব্যাংক বলেছে ব্যবসা বাণিজ্যকে প্রতিযোগীতা সক্ষম করতে শুল্ক- কর কমানো, বাণিজ্য সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ,বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, আঞ্চলিক ও বহুজাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে। আর্থিক খাতের সংস্কারের মধ্যে রয়েছে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও শেয়ার বাজার শক্তিশালী করা। অবকাঠামো নির্মাণ ঋণ সহায়তা দেওয়া, মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবার সম্প্রসারণ, খেলাপি ঋন কমানো, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চত করা এবং আর্থিক খাতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কমানো। অন্য দিকে উন্নত জীবন ও আধুনিক নগরায়নে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন , নাগরিকদের ডিজিটাল সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, নগরায়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, যানজট নিরসন, ভূমি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ নানা পরামর্শ।
মাথা পিছু আয় কমবে: বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, ব্যবসা বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে , আর্থিক খাতের চরম দুর্বলতা, অনিয়ম এবং উন্নত নগরায়নের অভাবে মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে। তবে মোটামুটি সংস্কার হলে মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২০৪১ সালে দাঁড়াবে ২ হাজার ২৫৮ ডলার। তবে শক্তিশালী সংস্কার হলে মাথাপিছু আয় আরও বৃদ্ধি পেয়ে হবে ৬ হাজার ৬৬৮ ডলার বাড়বে। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্য্যরোর ( বিবিএস) হিসাবে ২০২১-২০২২২ অর্থ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৮২৪ ডলার।
ঢাকার উপর নির্ভরশীল: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও একটি বিষয় বেশ সুন্দর ভাবে এসেছে, তা হচ্ছে ঢাকা থেকে দেশের জিডিপি আয় বিষয়। বৃহত্তর ঢাকা থেকে মোট জিডিপি এক পঞ্চমাংশ আসে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের অর্ধেক যোগান দিচ্ছে ঢাকা। দেশের পণ্য আমদানী অনেক বেশী। বাংলাদেশে মধ্যবর্র্তী পণ্য আমদানীতে শুল্ক হার ১৮.৮ শতাংশ। এই শুল্ক হার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী। শুধু চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের তুলনায় দ্বিগুন। তাই দেশে পণ্য আমদানীর ব্যয় বাড়ছে।
তৃতীয় মুদ্রার আমদানি ব্যয়: ইতিমধ্যে রাশিয়া রুপপুর পারমানবিক কেন্দ্রর ঋন পরিশোধের জন্য রুশ মুদ্রায় প্রদানের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত ও চাচ্ছে ভারতীয় মুদ্রায় বিনিয়োগ বাণিজ্য করতে। চীন তো পূর্ব থেকে প্রস্তাব রয়েছে। বাংলাদেশ পড়েছে বড় বিপদে। কি করবে এখন ! বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনায় অর্থণীতিবিধগণ বলেন, বর্তমান ডলার সংকটে তৃতীয় মুদ্রায় আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য করা মোটেও বাস্তব সম্মত হবে না।
বড় ব্যবসায়ীদের বড় ছাড়: সরকার বিগত কয়েক বছর ধরে বড় বড় ব্যবসায়ীদের বড় বড় আর্থিক সুবিধা দিয়ে আসছে। তা ব্যবসায়ী মহলে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীগণ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। তাকে যৌক্তিক করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সরকার নানা ভাবে অধিক রাজস্ব আদায়ে মরিয়া। এতে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য সহায়ক রাজস্ব আদায় নীতিতে হচ্ছে না বলে সাউথ এশিয়ান নেটওর্য়াক অব ইকোনমিক মডেলিংয়ের ( সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান উল্লেখ করে সরকারকে ব্যবসায়ীদের প্রতি যত্নশীল , সহনশীল হওয়ার আহবান জানান।
এখন সরকারের করণীয়ঃ
১) বাংলাদেশে দ্রুত আর্থিক খাতের সংস্কার না হলে প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে মাত্র ৫ শতাংশ। মোটামুটি সংস্কার হলে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ভাল সংস্কার হলে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তাই দ্রুত ভাল সংস্কার করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব।
২) আর্থিক খাতে দলীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত নয়। দলীয় দৃষ্টিতে ব্যাংক, বীমা ও অ- আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত। যোগ্যতা , সততা ও সংশ্লিষ্ট খাতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের শুধু মাত্র পরিচালক নিয়োগের বিধান চালু করা প্রয়োজন।
৩) খেলাপি ঋন আদায়ে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। খেলাপি ঋন কোনক্রমে রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড় দেওয়া উচিত নয়।
৪) দেশ থেকে অর্থপাচার রোধ করা দরকার। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনের সু নিয়ম কার্যকরী করা প্রয়োজন । শুধু রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে পাচারকারীদের ছাড় দেওয়া উচিত নয়। সকলকে বিচারের আইনে সমান মর্যাদা দেওয়া খুবই জরুরি। আর্থিক খাতে সুশাসন খুবই প্রয়োজন। তা সরকারকে কায়েম করতে হবে।
৫) বাংলাদেশ ব্যাংককে সম্পূর্ন স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। সরকারি ও রাজনৈতিক যে কোন হস্তক্ষেপ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক মুক্ত থাকা প্রয়োজন।
৬) দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি প্রয়োজন। এ জন্য সরকারকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দল সমূহের সঙ্গে যৌক্তিক দাবী মেনে রাজনৈতিক সমঝোতা গ্রহন করে দেশকে উন্নয়নের ধারায় দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার আশা করি এগিয়ে আসবেন। এক দিকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ অন্য দিকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের আর্থিক খাতের মেরুদন্ড একে বারে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
৭) দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্যকে সকলে ‘না’ বলতে হবে। কঠোর হস্তে দুর্নীতি, ঘুষ ও অনিয়মের লাগামকে সরকার দমন করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
৮) অপ্রয়োজনীয়, অলাভজনক মেগা প্রকল্পসমূহ বন্ধ করা প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদি ঋনের ভিতিতে মেগা প্রকল্প গ্রহন করা উচিত। বিশেষ করে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ যে সকল প্রতিষ্ঠান কম সুদে,দীর্ঘ মেয়াদি ঋন দেয় শুধু তাদের থেকে ঋন নেওয়া উচিত। স্বল্প মেয়াদি অধিক সুদ হারে ঋন গ্রহন পরিহার সময়ের দাবী। তাই প্রয়োজন সংস্কার,সংস্কার এবং অবিরাম সংস্কার।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।