Dr Muhammad Shahidullah

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ : জ্ঞানতাপস বাংলা ভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব রক্ষায় অনির্বাণ

‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ শব্দগুলো উচ্চারণ করেছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি ১৯১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন’ এর দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে আরও বলেন, ‘আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তায়, ভয়-ভালোবাসায়, চিন্তা ও কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।’


ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উক্ত সভায় আরও বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করে দেখ, মাতৃভাষায় উন্নতি ছাড়া কোনো জাতি কি কখনও বড়হতে পেরেছে? আরব পারস্য জয় করেছিল, কিন্তু পারস্য আরবের ভাষা নেয়নি। শুধু নিয়েছিল তার ধর্মভাব আর কতগুলো শব্দ। সেদিন অতি কাছে যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করবে। বিদেশি ভাষার সাহায্যে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার মতো সৃষ্টি ছাড়া প্রথা কখনও টিকতে পারে না।’
‘এখন আমাদের শিক্ষিত সমাজের রুচি সাধুভাষার দিকে। এখন এই ভাষায় চলবে। এ ভাষায়ই লেখাপড়া করতে হবে। এতেই আমাদের ভাবী বাংলার মুসলমান সাহিত্য রচনা করতে হবে। এটাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি জাতির ভাষা হবে।’


মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালে ১০ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুনশী মফিজউদ্দিন আহমেদ। তার পিতা হাড়োয়া গ্রামের গোরাচাঁদের প্রাচীন দরগাহর একজন খাদেম ছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।


ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। তিনি ১৯০৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯১০ সালে সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ১৯১২ সালে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্তে¡ এমএ পাস করেন। ১৯১৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনও পাস করেন। ১৯১৯ সালে তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের গবেষণা সহকারী পদে যোগদান করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তিনি সংস্কৃত ও বাংলাভাষা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন।


১৯২৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি প্যারিস যান। ধ্বনিতত্তে¡ প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।


ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার সারাটা জীবন জ্ঞান সাধনায় কাটিয়েছেন। জ্ঞান চর্চা, জ্ঞান অন্বেষণ, জ্ঞান আহরণের তার আনন্দ আর্তি আর উল্লাস। জ্ঞান বিতরণই ছিল তার শান্তি। তিনি মাতৃভাষা বাংলা ছাড়া আরও ১৮টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তার জীবনের ৮৪ বছর বয়সের মধ্যে ৭৫ বছর শিক্ষা ও জ্ঞান অন্বেষণের সাধনার জীবনে ইংরেজি, ফারসি, জার্মান, সংস্কৃত পালি, প্রাকৃত, আরবি, উর্দু, বৈদিক, আবেস্তান, তিব্বতি, সিংহলি, হিন্দি, মৈথলী, আসাম ও উড়িষ্যা প্রভৃতি দেশ-বিদেশের ভাষা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘সাধনা করলেই সিদ্ধি লাভ হয়।’


ড. এনামুল হকের মতে- ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হইলেও জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নেহের দুলাল এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরপুত্র। প্রকৃতপক্ষে তিনি সভ্য জগতের তিন তিনটি খ্যাতনামা এবং প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানধারার ত্রিবেনী সঙ্গম। এই জ্ঞান তীর্থে স্নাত হইলে পুণ্য অর্জিত হয় কিনা বলা যায় না, তবে মন যে মুক্ত, প্রাণ যে উদার, হৃদয় যে বিশাল এবং মস্তিষ্ক যে জ্ঞানগর্ভ হইয়া ওঠে, তাহাতে অপরের না হোক, অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নাই।’


ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রাচ্যের আল-বেরুনি নামে সকলের নিকট পরিচিত। তিনি ৮৪ বছর জীবিতকালে তার কর্মক্ষেত্রে এবং সাহিত্য সংস্কৃতিতে অশেষ অবদান রেখে গেছেন।
শহীদুল্লাহ সব সময়ই সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমএ পাসের পর তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে:
ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষার ইতিহাস, দীওয়ানে হাফিজ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, নবী করিম মুহাম্মদ, ইসলাম প্রসঙ্গ, বিদ্যাপতি শতক, বাংলা সাহিত্যের কথা ২ খণ্ড, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, ব্যাকরণ পরিচয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, মহররম শরীফ, টেইল ফ্লম দি কুরআন, Bnddhist Mystic songs (1960), Hundred sayings of the Holy Prophet উল্লেখযোগ্য।
আজ খুব বেশী করে মনে পড়ে এই জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। তাতে অনেক কারণ রয়েছে। ভাষা, শিক্ষা ও ইসলামের ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উল্লেখিত সব ভাষা শিক্ষা এবং ধর্ম চর্চাকে ইবাদত মনে করতেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি তাই অবদান রেখে গেছেন।


আজ আমরা তার অবদানের কথা অনেকটা ভুলে গিয়েছি। তরুণসমাজ তাকে নিয়ে তেমন যেন চর্চা করছে না। অনেকে বলেন, তিনি ১৮টি ভাষা জানতেন, আবার অনেকে উল্লেখ করেছেন তিনি ২০টি ভাষা জানতেন। সব চেয়ে বড় পরিচয় তিনি ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মূল পথিকৃত ছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পেয়েছিলেন তখন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার প্রতিবাদে দৈনিক আজাদে এক প্রবন্ধ লিখে অতীত জাগরুক করেন।


ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা ভাষার প্রকৃত গবেষক। তার গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নির্মাতা হিন্দুও নয় মুসলমানও নয় – বৌদ্ধতান্ত্রিক সম্প্রদায়। অবশ্য রূপে রসে একে সজিব করেছেন মুসলিম আমির উমরাহরা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাই প্রমাণ করেছেন সংস্কৃত থেকে নয়, বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে ‘ গৌড়ি প্রকৃত’ থেকে। যেমন বাংলায় ‘তুমি ঘোড়া দেখ’ গৌড়িতে হবে ‘তুন্থে ঘোড়া অংদেক খহ’।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার গবেষণা দেখিয়েছেন সংস্কৃতিতে ‘ঘোড়া’ শব্দ নাই। আছে ‘অশ্ব’। গৌড়ি প্রকৃত (পালি ভাষায়) ‘ঘোটক’ শব্দ পাওয়া যায় ঘোড়া সেখান থেকেই বাংলা ভাষায় এসেছে। ১৯১৬ সালে হর প্রসাদ শাস্ত্রী নেওয়ার বৌদ্ধদের কাছ থেকে কতগুলো পুঁথি সংগ্রহ করেন। ঐ সকল পুঁথি বৌদ্ধ দোহা বা সঙ্গীত রয়েছে। এই সঙ্গীতগুলো তখন প্রাচীন বাংলার নিদর্শন। শহীদুল্লাহ ঐ বৌদ্ধ গানের ওপর ডক্টর অব থিসিস করেন।
১৯৫২ সালে একুশের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিন থাকাকালে তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন।


তিনি বলতেন, ভাষার বৈচিত্র আল্লাহতায়ালারই সৃষ্টি। মানবচিত্তে আল্লাহতায়ালাই ভাষার বীজ রোপণ করে দিয়েছেন। তিনি বাংলা ভাষার গঠন, বৈশিষ্ট্য ও বিকাশের জন্য আজীবন সাধনা করে গেছেন। তিনি তাই লিখেছেন, বাংলাভাষার সহজ ব্যাকরণ, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও ইসলামি বিশ্বকোষ। তিনি পবিত্র কোরআন শরীফের তাফসিরও করেছেন।


অবাক হওয়ার বিষয যে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এত বড় শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তি হয়েও খাঁটি মুসলমান ছিলেন। ধর্মের সঠিক আকিদা তিনি পোষণ করতেন। ধর্ম নিয়ে তার কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। এখনও আমাদের সমাজে মানুষ সাধারণত একটু উচ্চশিক্ষিত হলেই ইসলাম সম্বন্ধে ভুল ধারণা করে বসে। এটা তাদের অজ্ঞতার জন্য। অনেকে নতুন নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জুড়ে দেয় ধর্মে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মধ্যে এসব ছিল না। আমরা বলব ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চিরদিনের শিক্ষিতদের শিক্ষক, সাধারণ মানুষের পথপ্রদর্শক, গোটা মুমিন মুসলমানের আদর্শ। বিদ্যা আর আগুন দান করলেই, বাড়ে যা- তা তিনি কাজকর্মে, আদর্শে, চর্চায় প্রমাণ করে দেখিয়ে গেছেন।


তিনি ১৯৬৯ সালে ১৩ জুলাই আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
আজ তাই দুঃখ হয় অনেক অবহেলা, অযত্নে যখন দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলে ঢুকতে বাম পার্শ্বে তার কবর, আদি প্রাচীন জীর্ণ মসজিদ সামনে। কেউ যখন স্মরণ করে না, যত্ন করে না। জন্ম ও মৃত্যু দিবসে এসে দলে দলে জিয়ারত করে না। অনেক দিন পর এখন তার কবরে একটি সাইন বোর্ড লাগানো হয়েছে। আমরা যখন সত্তর দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ি তখন তার কবর চেনার জন্য কোনোসাইন বোর্ডও দেখতে পাইনি। আমাদেরঘুমন্ত জাতি আবারও জেগে উঠুক জ্ঞানতাপস, ধার্মিক, পণ্ডিত ড. মুহম্মাদ শহীদুল্লাহ সাহিত্য চর্চা করে।


ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ অসংখ্য পুরস্কার ও পদক লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ প্রদান করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক ‘নাইট’ অব দি অর্ডারস অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স দেয়। ঢাকা সংস্কৃতি পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। পাকিস্তান আমলে তাকে ‘প্রাইভ অফ পারফরম্যান্স পদক’ (১৯৫৮) ও মরণোত্তর ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রদান করে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনীত করে কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মরণোত্তর ‘ডিলিট’ উপাধি দেয়। ১৯৮০ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করে সম্মানিত করেন।
ভাষা ক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে শহীদুল্লাহ হল করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি কলা ভবনের নাম তার নামে অলংকৃত করে।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments