Dr Lutfor Rahman

উন্নত জীবনের জন্য প্রয়োজন ডা. লুৎফর রহমানের সাহিত্য চর্চা

“মানব-চিত্তের তৃপ্তি অর্থ, প্রধান্য, ক্ষমতা এবং রাজ্য লাভ নয়। আলেকজান্ডার সমস্ত জগৎ জয় করেও শান্তি লাভ করেন নাই। মানুষ অর্থের পিছনে ছুটছে- অপরিশিষ্ট অর্থ দাও তাকে, সে আরও চাবে। তার মনে হয় আরও পেলে সুখী হবে। সমস্ত জগৎ তাকে দাও তবুও সে সুখী হবে না। জাগতিকভাবে যারা অন্ধ, তারাই জীবনের সুখ এইভাবে খোঁজে। দরিদ্র যে, সে আমার জীবন ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে ঈর্ষা করছে, সে আমার অবস্থার দিকে কত উৎসুক নেত্রে তাকিয়ে থাকে-কিন্তু আমি নিজে কত অসুখী। পরম সত্যের সন্ধান যারা পায় নাই, মানব হৃদয়ের ধর্ম কি, তা যারা বুঝতে পারে নাই- তারাই এইভাবে জ্বলে পুড়ে মরে, এমন কি এই শ্রেণীর লোক যতই মৃত্যুর পথে অগ্রসর হতে থাকে, ততই তাদের জীবনের জ্বালা বাড়ে। প্রতিহিংসা-বৃত্তি, বিবাদ, অর্থ-লোভ আরও তীব্রভাবে তাদেরকে মত্ত ও মুগ্ধ করে। তখনও তারা যথার্থ কল্যাণের পথ কি, তা অনুভব করতে পারে না। জীবন ভরে যেমন করে সুখের সন্ধানে এরা ছুটছে, মৃত্যুর অব্যাহতি পরেও তেমনি তারা সুখের সন্ধান করে- পায় না, এরই পথে মানুষ সুখ পাবে না। ক্রোধে তারা চিৎকার করে মানুষকে তারা দংশন করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাদের দুঃখী, আহত-ব্যথিত মন নিজের দেহ এবং পরের অন্তরকে বিষাক্ত করে। বলতে কী, মানুষ জাগতিক কোনো সাধনার সুখ, আনন্দ এবং তৃপ্তি পাবে না। এই পথ থেকে মানুষকে ফিরতে বলি; সমস্ত মহাপুরুষই এই কথা বলেছেন। মানুষ তার জীবনকে অনুভব করতে পারে নাই; শয়তান মানুষ চিত্রতে ধর্মের নামে ভ্রমান্ধ করেছে।”


ডা. লুৎফর রহমানের লেখা মানব জীবন গ্রন্থের ‘মানব-চিত্তের তৃপ্তি শীর্ষক শিরোনামের কিছু অংশ উপরে উল্লেখ করেছি। ১৮৮৯ সালের কোন একদিন ডা. লুৎফর রহমানের জন্ম মাগুরা জেলার পরণান্দুয়ালী গ্রামে। অতি অল্প বয়সে মাত্র ৪৭ বয়সে তিনি ১৯৩৬ সালের ৩১শে মার্চ এই দুনিয়া থেকে পরকালে চলে যান।


১৯১৫ সালে ডা. লুৎফর রজমানের প্রথম এবং শেষ কাব্য গ্রন্থ ‘প্রকাশ’ নামে চল্লিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা তিনি ১৯০৮ সাল থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে লিখেছেন। এই কাব্য গ্রন্থের ‘বাল্য ছবি’ কবিতাটি:
মনে হয় সেই দেশে ফিরে আমি যাই,
আবার যে সখাগণে ডাকিয়া শুধাই।
সে কথার ব্যাথা হত তরঙ্গ সঞ্চালন,
সে কথার কথা-ভরা বন উপবন,
হাসি-গান মুখরিত সাঁঝের আঁধার,
যাতার সে স্নেহময় শাসন-চীৎকার,
মৌন বনে ভাষাময় মশক সঙ্গীত
বাল্য প্রাণ করে দিত কেমন মথিত!
সুখদ সে মধু দৃশ্য অতীত সুন্দার
লয়ে আসে শত ব্যথা প্রীতি মনোহর।
দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আগাছায় জোড়া
মনে হয় ছিল তাতে কত সুধা পোরা।
একশত তেইশ বছর পূর্বে বৃটিশ শাসন আমলে একটি বৈরী পরিবেশে ডা. লুৎফর রহমানের জন্ম, বেড়ে উঠা। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনে বড়ই দুর্দিন ছিল। সেই দুর্দিনে মুসলিম সমাজ ধর্মের গোড়ামি কুসংস্কার কুশিক্ষা সব কিছুর বেড়াজালে জড়িয়ে শিক্ষা দীক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময় ১৮৮৯ সালে ১২ই ডিসেম্বর বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের ত্রাণকর্তা হিসাবে জন্ম নিয়ে ধরায় আসেন ডা. লুৎফর রহমান। তার পিতার নাম সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, মাতা শামসুনাহার। তিনি ছিলেন একজন সু-সাহিত্যিক সম্পাদক ও সমাজকর্মী। কিন্তু ডাক্তার লুৎফর রহমান হিসাবে তার পরিচিতি ছিল সমধিক। তার পিতা একজন ষ্টেশন মাস্টার ছিলে। চার ভাই ও এক বোন চিল। তার পিতা এফ.এ পাশ ছিলেন। ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তার পিতার অনুরাগ ছিল। এই কারণেই লুৎফর রহমানের মাসে পিতার অনুরাগ প্রতিভাস হয়েছিল।

ডা. লুৎফর রহমান ছোট বেলা থেকে লেখাপড়ায় খুব বেশী মনোযোগী ছিলেন। কোন কিছু একবার পড়লে তার মনে থাকত। দ্বিতীয়বার পড়ার প্রয়োজন হতো না। ১৯১৫ সালে তিনি মাগুরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। তারপর তিনি কলিকাতা হুগলী মহসিন কলেজে ভর্তি হন। তারপরই তিনি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাতে তার প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ক্ষতি হয়। তিনি এফ.এ. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। পরবর্তীতে তিনি ১৯২১ সালে কৃষ্ণনগর হোমিওপ্যাথিক কলেজ থেকে এইচএমবি (ঐড়হং) ডিগ্রী লাভ করেন। অধ্যয়ন কালে তিনি আয়শা খাতুন নামে এক কিশোরীর প্রতি প্রণয়সক্ত হয়ে পড়েন। পিতা-মাতার অমতেই বিয়ে করেন।
লুৎফর রহমান প্রথমে শিক্ষক এবং পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। এফএ অধ্যায়ন কালে তিনি ১৯১৬ সালে সিরাজগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলে অ্যাংলো পারসিয়ান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ১৯১৮ সালে ঐ স্কুল ছেড়ে চট্টগ্রামে জোরারগঞ্জ হাইস্কুলে একই বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯২০ সালে আবার তিনি কলিকাতা চলে যান এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন।

“মিথ্যাবাদী, তোষামোদকারী, শঠ, হৃদয়হীনের মুখে আমি দেখেছি শয়তানের মুখ। পরশ্রীকাতরতা, অপ্রেমিক, মোনাফেকের মুখে আমি দেখেছি শয়তানের মুখ। জগতের সমস্ত ধন সম্পদের বিনিময়ে শয়তানের সুখের সঙ্গে আমার সুখ বদলাতে চাইনে।” ‘মানব জীবন’ গ্রন্থে ‘শয়তান’ নামক প্রবন্ধ এবং মহৎ বাণীর প্রবক্তা বাংলা সাহিত্যের নীতিবাদী, আদর্শবাদী সাহিত্যিক ডা. লুৎফর রহমান। আদর্শ, নীতি, সততা থেকে জীবনে কখনো সরে আসেন নাই। আদর্শের জন্য আজও তিনি আমাদের মাঝে জীবন্ত, অনুকরণীয়, অনুসরণীয় সাহিত্যিক। সততা জীবনের মূল- মন্ত্র।
শৈশবকাল থেকে তিনি ছিলেন একজন ভাবুক প্রকৃতির। বাড়ির কাছে কুমার নদী, ঋতুতে ঋতুতে তার বিচিত্র রূপ দেখে তিনি মোহিত হতেন। চৈত্র-বৈশাখ মাসে নদীতে চর জাগে, ধুধু করে বালচুর। বর্ষায় নদীর ভয়ঙ্কর রূপ তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। দেখেছেন নদীর দুকুল ঘেঁষে সজল-সবুজ ধান ক্ষেত, প্রথম শীতে মাঠের সোনালী ফসল। প্রকৃতির এই অপরূপ শোভা বালক লুৎফর রহমানকে সাহিত্য পিয়াসী করে তোলে।


লেখক হওয়ার তীব্র বাসনা তাঁর কিশোর মনকে জীবনের শুরুতে অধিকার করেছিল। তাই সাহিত্য জগতে তার প্রথম আগমন ঘটে ‘বৃহৎ ডন কুইকজোটের অনুবাদ’ গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তা ১৯১৫ সালের পূর্বে।
জীবনে দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও লুৎফর রহমান সাহিত্য চর্চা থেকে সরে আসেননি। ক্রমাগত পূর্ণতার দিকে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। এ প্রেরণা তার এসেছে কখনও অন্তর থেকে বা কখনো বাহির থেকে। সৃষ্টি জাত প্রতিভার গুণে তিনি স্বীয় আসনে বলিয়ান। ১৯১৮ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সরলা’ প্রকাশিত হয়। ‘সরলা’ উপন্যাসে তিনি একটি পথ ভ্রান্ত নারীর জীবনের সমস্যা এবং প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে তার সংগ্রামের বিবরণ তুলে ধরেছেন। ১৯১৯ সালে তার দুটি উপন্যাস ‘পথহারা’ ও ‘রায়হান’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে তার প্রকাশিত ২য় উপন্যাস ‘প্রীতি উপহার’। নারী গৃহলক্ষ্মী পুরুষের প্রেরণার উৎস যাত্রী। পারিবারিক জীবনে নারী গড়ে তোলে সুন্দর শান্তির ভুবন। তাই আদর্শ নারী সমাজ গঠনে ‘প্রীতি উপহার’ উপন্যাস সমাজে এখন ,এখনও সমাদৃত। নারী ভিত্তিক ‘বাসর উপহার’ ‘প্রতিশোধ’ নামে আরও দুইটি উপন্যাস এই সময়ে তিনি রচনা করেন।


জাতি গঠনে নারীর ভুমিকা তিনি সব সময় মনে প্রাণে সোচ্চার ছিলেন। নারীর মুক্তি, নারীর স্বাধীনতা নিয়ে তার ভাবনা ছিল খুবই স্বচ্ছ। তাই নারী মুক্তির উদ্দেশ্যে তিনি বাংলায় ১৩১২ সালের অক্টোবর মাসে ‘নারী শক্তি’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। নারীদের উন্নতির জন্য, মুক্তির জন্য, নারী স্বাধীনতার জন্য, বিশেষ করে পতিতাদের অপকর্ম থেকে মুক্তির জন্য ‘নারী তীর্থ’ ও ‘নারী শিল্প শিক্ষালয়’ নামে কলিকাতায় দুইটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর্থিক সমস্যার জন্য প্রতিষ্ঠান দুইটি চালু রাখা সম্ভব হয় নাই। তিনি কলিকাতা ছেড়ে মাগুরায় এসে শেষ জীবন পর্যন্ত কাটিয়ে দেন।


শিশু-কিশোরদের নিয়ে লুৎফুর রহমান চিন্তা করতেন। তিনি ভাবতেন শিশু কিশোর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুবই জরুরী। তাই তিনি তাদের উদ্দেশ্যে সাহিত্য রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মধ্যে ‘ছেলেদের মাহাত্ম্য কথা (১৯২৯), ছেলেদের কারবালা (১৯৩১) ‘রানী হেলেন (১৯৩৫) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


ডাক্তার লুৎফর রহমান একজন আদর্শবাদী সাহিত্যিক ছিলেন। আধুনিকমনা স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী, সংস্কারপন্থী একটি মানুষ তিনি ছিলেন। তার সাহিত্য চিন্তা তার আদর্শ বিশ্বাসের একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে প্রবন্ধ রচনায় তিনি আজও সকলের উপরে স্থান করে রেখেছেন। নীতিবাদী সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র ভুবন সৃষ্টি করে সাহিত্যের মৌলিকত্ব তিনি নির্মাণ করে গিয়েছেন। আজও কেউ তার সমমানের সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে নাই। আমরা আমাদের স্কুল-কলেজ জীবনে তার প্রবন্ধ পড়ে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত হয়েছি। কিন্তু আজ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তার রচিত প্রবন্ধ তেমন দেখা যায় না। কিন্তু এখন প্রয়োজন বেশী। তার আদর্শবাদী সাহিত্য আজ যুব সমাজকে আলোর পথ দেখাতে সক্ষম। বেশী বেশী করে তার সাহিত্য চর্চা আমাদের সর্বত্র করা উচিত।


সাধারণ মানুষের দুঃখ বেদনা ও তাদের সমস্যা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তার সাহিত্য কর্মে মানব জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তাঁর রচিত ‘উন্নত জীবন’ গ্রন্থে ‘ব্যক্তিত্ব ও শক্তির সফলতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লুৎফর রহমান বলেন :
“শিক্ষা, জ্ঞানালোচনা, চরিত্র ও পরিশ্রমের দ্বারা দরিদ্র মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র তুমি হতে পার। যে অবস্থায় থাক না কেন- জ্ঞান অর্জন কর, পরিশ্রমী হও। মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। তুমি ব্যবসায়ী, তুমি সামান্য দর্জি, তুমি পৃথিবীর এক কোণে পড়ে আছ- তুমি যদি সাধু ও চরিত্রবান হও, সেই অবস্থায় মনের দীনতা ও মুর্খতা দূর করতে একটু একটু পড় ও বড় বড় লোকের উপদেশাবলী ও জ্ঞানের কথা আলোচনা কর, দেখতে পাবে, দিন দিন তোমার সকল দিক দিয়ে উন্নতি হচ্ছে- তোমার সম্মান, তোমার অর্থ সবই বেড়ে যাচ্ছে।”


মানুষকে উন্নত হওয়ার জন্য, জ্ঞানী হওয়ার জন্য, চরিত্রবান হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় কথা আর কি হতে পারে। তার প্রতিটি প্রবন্ধে এমনিভাবে তীর্যক ভাষায়, মধুর মাধুরী মিশিয়ে তিনি পাঠককে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। আজকের সাহিত্যে এই সকল বাক্য, শব্দ ও উক্তির চর্চা খুব বেশি প্রয়োজন। মানুষ আজ নিজকে হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব দিন দিন লোপ পাচ্ছে। ডাঃ লুৎফর রহমানের সাহিত্য চর্চায় আমাদের বিবেককে জাগ্রত করবে।
লুৎফর রহমান সময়কারে জাতি সব দিক থেকে মিলিয়ে পড়েছিল। বৃটিশের কুশাসনে দিশেহারা মুসলিম জাতি ছিল অবোলা। ঝিমিয়ে পড়া জাতিকে উন্নত শিরে বলীয়ান করে তোলার বাসনায় তিনি রচনা করেন ‘ব্যক্তি জীবন, ‘সমাজ জীবন’ ‘ধর্ম-জীবন’ ‘যুবক জীবন’ প্রভৃতি মুল্যবান গ্রন্থ।


লুৎফর রহমান মুক্তবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন যার প্রভাব তার সাহিত্যচর্চায় ফুটে উঠেছে। ১৯২০ সালে তিনি সাহিত্য চর্চা ও সমাজসেবা ব্রত নিয়ে কলিকাতা যান। তিনি তখন অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা থেকে তিনি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মুহম্মদ মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেন।
তখনকার বাংলা ভাষার বিখ্যাত পত্রিকা ও সাময়িকীতে তার রচনা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হতো। বিশেষত মোসলেম ভারত, সাধনা, সোলতান, সহচর, সাম্যবাদী, সাহিত্যিক, মোয়াজ্জিন, মাসিক মোহাম্মদী প্রভৃতি পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো।


লুৎফর রহমান বিশ্বাস করতেন, মানুষের শক্তির প্রধান উৎস হচ্ছে জ্ঞান এবং জীবনের সুন্দর বিশুদ্ধতম অনুভুতির নাম হচ্ছে প্রেম। উন্নত জীবন দর্শন তিনি মেনে চলতেন। লোক দেখানো বা বংশগত সম্মানকে তিনি আমলে আনেননি। এমন কি তাদের বংশের উপাধি ‘জরদার’ পর্যন্ত তিনি ব্যবহার করতেন না। ‘উন্নত জীবন’ গ্রন্থে ‘পিতৃমাতৃভক্তি’ প্রবন্ধে তিনি লিখেন :
“প্রবন্ধ লেখকের বংশকে লোকে জরদার বংশ বলে থাকেন। জরদার অর্থ স্বর্ণ অথবা ধন সম্পত্তির মালিক। বড় লোক ছাড়া কারো এই উপাধি হয় না। নদীয়া জেলার এক ব্রাহ্মণের এ উপাধি আছে, সুতরাং এ উপাধি ব্যবহার করতে মনে গর্ব ছাড়া লজ্জা আসে না। কিন্তু বিবেকের কাছে অনুমতি চাইলে সে জিজ্ঞাসা করেছে তোমার অর্থ কই? আর অর্থ যদিই থাকে, তবে তা লোকের কাছে প্রচার করা কী প্রকার ভদ্রতা?”


সমাজসেবার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন লুৎফর রহমান। পথভ্রষ্ট ও সমাজ পরিত্যক্ত নারীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে নিজ আবাসস্থলেই গড়ে তোলেন ‘নারীতীর্থ’ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের সভানেত্রী ছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এবং সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজেই। এছাড়াও কবি খান মোহম্মদ মঈনুদ্দীন ও মোহাম্মদ জোবেদ আলী কার্যনির্বাহী পরিষদের সক্রিয় কর্মী হিসাবেও কাজ করেন।


লুৎফর রহমান সময়কালে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, কবি, কথা সাহিত্যিক ছিলেন। সমাজের চোখে সমাজের বন্ধ দিকগুলো আয়নার মত করে তার সাহিত্যের মাধ্যমে তোলে ধরেন। কবিতা, প্রবন্ধে, ছোট গল্পে, উপন্যাসে তিনি তার আদর্শের সৃষ্টির উন্মাদনায় বিভোর ছিলেন।


লুৎফর রহমানের প্রথম ও শেষ কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের জন্য তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। প্রধান প্রধান প্রবন্ধ গ্রন্থের নাম : উচ্চ জীবন (১৯১৯), মহৎ জীবন (১৯৬), উন্নত জীবন (১৯২৭), মানব জীবন (১৯২৭), সত্য জীবন (১৯৪০) ধর্ম জীবন (১৯৭১), মহাজীবন (১৯৭৫), যুবক জীবন (১৯৮৫) সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাস : সরলা (১৯১৮), পথহারা (১৯১৯), রায়হান (১৯১৯), প্রতি উপহার (১৯২৭), বাসর উপহার (১৯৩৬) সালে প্রকাশিত হয়্ তিনি বেশ কিছু ছোট গল্প লিখেন। তা হচ্ছে : পলায়ন, রাণী, অহিংসা, রাজপথ, অমাবস্যা, রোমান্টিক বিয়ে, ফিরে যাও ফিরে যা। শিশুদের জন্য লিখেন : ছেলেদের মহত্বকথা (১৯২৮), ছেলেদের কারবালা- (১৯৩১), রানী হেলেন (১৯৩৪)। অনুবাদ সাহিত্যেও লুৎফর রহমান অবদান রাখেন। তিনি ‘মঙ্গল ভবিষ্যৎ’ ‘দুঃখের রাত্রি (ব্রিকেটার হুগোর লা মিনারেল এর অনুবাদ) ও ‘মুসলমান’ বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করেন।


ডাক্তার লুৎফর রহমানের সমগ্র জীবন কেটেছে সুন্দরের অন্বেষায় জগৎ জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে তিনি লিখেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে ছিল স্বচ্ছতা, সততা, মহৎ গুণাবলীর অপূর্ব সমন্বয়। জীবনের কখনও অন্যায়ের সঙ্গে তিনি আপোষ করেননি। ন্যায় পথ থেকে কখনো বিচ্ছুত হননি। সততা, নিষ্ঠা জীবনের সর্বসময় তিনি তা অবলম্বন করে কাটিয়েছেন। তার সাহিত্য কর্মের নানা গ্রন্থের পাতায় পাতায় সেই চরিত্রের রূপায়ন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
লুৎফর রহমানের ‘উন্নত জীবন’ গ্রন্থের পয়সা কড়ি প্রবন্ধে তিনি লিখেন :
‘তুমি সাধু ও জ্ঞানী, তুমি দরিদ্র হয়ে থাকবে, এরূপ ইচ্ছা পোষন করো না। তোমাকে ধনী হতে হবে, কেননা তুমি জ্ঞান, অর্থ কীভাবে ব্যয় করতে হয়।
অর্থ পিশাচ, নীচ, সঙ্কীর্ণ হৃদয় ব্যক্তি যদি অর্থ উপার্জন করে, তবে তার উপার্জনের কোনো মূল্য নাই।
সৎ উদ্দেশ্যে পয়সা উপায় করা উপসানরই তুল্য। সত্য কথা বলতে কি, ইহা শ্রেষ্ঠ উপাসনা।’
তিনি আরও বলেন :
“তুমি চরিত্রবান ও সত্যবাদী জ্ঞানের সাধক এবং পাপকে ঘৃণা কর, তুমি যে কোনো কাজই করো না, বিশ্বাস করো, তোমার মর্যাদা অল্প নয়।
আত্মার শুদ্ধতা রক্ষা করা- চিত্তকে মিথ্যার বিরুদ্ধে স্বাধীন করে রাখাই ধর্ম- তুমিই যথার্থ ধার্মিক, অতএব সম্মান তোমারই।”
মানব জীবনকে সুন্দর করার জন্য, নিজের চরিত্রে পরিবর্তন আনার জন্য, সমাজকে সুন্দরতম রূপে গড়ে তোলার জন্য ডাঃ লুৎফর রহমানের সাহিত্য পাঠ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নাই।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments