Dewan Mohammad Azraf

‘দর্শন সমাজকে সচেতন করে তোলে’
-দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ

“ধর্ম ও দর্শনের এই দুই পৃথক ধারা অতি পুরাতন কাল থেকেই চলে আসছে। অথচ এই দুই ধারার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হিগেল (Hegel) ও কোর্তের (Comte) মত দার্শনিকগণ দুটো ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে কুয়াশার সৃষ্টি করেছেন। হিগেলের মতানুসারে, ধর্ম সত্যের অনুসন্ধানের ব্যাপারে কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে কাব্য সৃষ্টির সঙ্গে তার সাদৃশ্য রয়েছে। দর্শনের স্তরে উঠেই মানুষ সত্যের প্রকৃত পরিচয় লাভে হয় ধন্য।” (ধর্ম ও দর্শন, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ)

আমাদের চিন্তা ও সংস্কৃতির ভুবনে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একটা মহিরুহের কত ডাল-পালা পত্র-পল্লব ছড়িয়ে আমাদের সমাজে আসীন হয়ে রয়েছেন। আজকাল সংস্কৃতি বলতে নৃত্য, গান, নাটক, অভিনয়, চিত্রাঙ্কনের যে একপেশে খন্ডিত ধারণা আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সংস্কৃতি চিন্তা তা থেকে স্বতন্ত্র। তিনি আমাদের জাতি গোষ্ঠীর সংস্কৃতির মৌল সূত্রগুলোর বিকাশে এবং রূপায়নে নিজকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। যে সব মূল্যবোধ সংস্কৃতি চেতনার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়ে একটা জাতি গোষ্ঠীকে প্রাণেইশার্থ সক্রিয় ও বেগবান করে তোলে, সেগুলোই হচ্ছে তাঁর চিন্তা ভাবনার উপজীব্য।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯০৬ সালে ২৫ শে অক্টোবর সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া গ্রামস্থ নানা মরমী কবি হাসান রাজার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন দুহালিয়ার জমিদার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা দেওয়ান মোহাম্মদ আসফ। ১৯২৫ সালে সুনামগঞ্জ জুবলী হাইস্কুল থেকে ফার্সি বিষয়ে লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২৭ সালে যুবারী চাঁদ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরক্ষিা পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে ডিষ্টিংশন সহ বিএ এবং ১৯৩২ সালে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টানেন।

তিনি ১৯৩৭ সালে গোলাপগঞ্জ মোহম্মদ চৌধুরী একাডেমীতে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে সুনাম গঞ্জ কলেজে তিনি ইংরেজী, বাংলা ও লজিকের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের পর ঐ কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত নরসিংদী কলেজের প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় আবুজর গিফারী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা, সততা ও সফলতার সঙ্গে গিফারী কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন ও পরে ইসলামিক

স্টাডিজ বিভাগে খন্ডকালীন অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। অগণিত ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর আদর্শে শিক্ষিত হয়ে সমাজের রাষ্ট্রে কর্মে নিয়োজিত।
দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ একদিকে ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সমাজ সেবক ও সংস্কৃতি কর্মী। ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা আন্দোলনের তিনি ছিলেন অগ্রণী পথিক।

১৯১৮ সাল থেকে দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ ‘শিয়াল মামা’ নামক একটি গল্প লেখা দিয়ে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। তখনকার কলিকাতার মাসিক ‘শিশু’ পত্রিকায় তাঁর এই গল্প প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়। ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম কবিতা ‘যাত্রী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে মুরারী চাঁদ কলেজের ম্যাগাজিনে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনীমুলক তার গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশাধিক। বাংলা ও ইংরেজীতে তার অধিকাংশ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। দর্শন শাস্ত্রের একজন দার্শনিক হিসাবে উপ মহাদেশে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। তিনি একজন আদর্শ, জ্ঞানী, দার্শনিক ছিলেন। বহু প্রবন্ধ এই বিষয়ে দেশে বিদেশে তিনি লিখেন ও বিভিন্ন সেমিনারে পাঠ করেন।

লোক কবি এবং জীবন দার্শনিক হাসন রাজার এই তত্ত্বচিন্তাই গোচরে কিংবা অগোচরে এক গভীর প্রভাব ফেলে তাঁর পৌত্র দেওয়ান মোহম্মদ আজরফের মানস গঠনে। হাসান রাজা তাঁর এক মরমী সঙ্গীতে প্রাচ্যের মৃত্তিকা সংলগ্ন নির্মোহ জীবনাদর্শ তুলে ধরে গেয়েছিলেন : আগে যদি জানতো হাসান বাঁচবে কতদিন, ঘর বাড়ি বানাইতো হাসান করিয়ে রঙিন। তাঁর আরেকটি গানেও ধ্বনিত হয়েছে জগত সংসারের প্রতি একই নিরাসক্ততা। গানটির বাণী ছিলো এ রকম : লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা না আমার, কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।

দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ সম্পর্কে সানাউল্লাহ নুরী তাঁর এক নিবন্ধে বলেন :
“দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ তাঁর এই মহান মাতামহেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন আধুনিক দর্শন এবং চিন্তার জগতে। হাসান রাজার মতোই সহজ সরল জীবনাচারে অভ্যন্ত হয়েও উচ্চ চিন্তার মেরুতে অধিষ্ঠান তাঁর। আমরা দেখে এসেছি আজরফ ভাইয়ের জীবনে কখনও বড় কোনো চাহিদা কিংবা বিরাট কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিল না। গ্রীক মনীষীর যুগে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিসস্টটল, পিথাগোরাস প্রমুখ দার্শনিকগণ যে ধরনের নির্লোভ জীবন যাপন করে গেছেন বাংলাদেশের এই জ্ঞান বৃদ্ধ এবং লোকনন্দিত দার্শনিকের জীবনাচারে তারই প্রতিভাস লক্ষ্য করা যায়। নবী সহচর আবুজর গিফারীর একজন অকৃত্রিম তার শিষ্য দেওয়ান আজরফ। গিফারী ছিলেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত ইসলামের বৈপ্লবিক রাষ্ট্রদর্শন এবং অভেদ মানবিক সাম্যের মহান প্রবক্তা। এ কারণে নীতিভ্রষ্ট উমাইয়া শাসকদের রোষানলে পড়ে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো তাঁকে। দেওয়ান আজরফ তার দর্শন চিন্তার গিফারীর এই আদর্শটিকে ধ্রুব সত্য হিসাবে গ্রহণ করেন।

দেওয়ান আজরফ সোফোব্রিজের মতন নৈরাশ্যবাদী নন কিংবা রুশের মতন রোমান্টিক নন। আবার হেগেল, মার্কস, এ্যাংগেলস এর মতন নৈরাজ্যবাদী বস্তুতপ্রীত নন। তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন সাদী, রুমী, গ্যাটে এবং ইকবালের মতো নৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী একজন একত্মবাদী। তাই এত প্রতিকুলতার মুখেও জীবন বিমুখতা কিংবা কোনো রকম হতাশা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। বয়সের চাপে জরায় খানিকটা ন্যুজ¦ পৃষ্ঠ হলেও তাঁর মুখমন্ডলে আমরা কখনো বিশ্বাসের এক আশ্চর্য উদ্ভাসন।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সাহিত্য চর্চা শুধুমাত্র দর্শন বিষয় ছিল না। তিনি একাধারে একজন দার্শনিক, লেখক, উপন্যাসিক, গল্পকারক, নাটক রচয়িতা। তার প্রধান প্রধান গ্রন্থের মধ্যে : তমদ্দীনের বিকাশ (১৯৪৯), সত্যের সৈনিক আবুযর (১৯৫১), ইতিহাসের ধারা (১৯৫২), জীবন সমস্যা সমাধানে ইসলাম (১৯৫৯), ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে (১৯৮০), ইসলাম ও মানবতাবাদ (১৯৮২), জীবন দর্শনের পুর্নগঠন (১৯৮০), সন্ধানী দৃষ্টিতে ইসলাম (১৯৮২), দর্শনের নানা প্রসঙ্গ (১৯৭৭), মরমী কবি হাসান রাজা (১৯৬৩), ধর্ম ও দর্শন (১৯৮৬), হাসান রাজা (১৯৯০) প্রভৃতি। উপন্যাসের মধ্যে ‘নয়া জিন্দেগী’ পাঠক সমাজে বেশ সমাদৃত। গল্পের মধ্যে ছন্দ পতন, কলমি শাক, এইতো জীবন, ছিন্নমুকুল। নাটকের মধ্যে : হাসান রাজা, আগামী পরশু। আত্মজীবনমূলক গ্রন্থের মধ্যে : জাগ্রত অতীত, সেই সোনা ঝরা দিনগুলি। ইংরেজী রচনা করেন : philosophy of History, Science and Revelation, Background of the Culture of the muslim, Islamic movement etc. এছাড়াও অনেক রচনা ও অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি আজও প্রকাশিত হয় নাই।

লেখালেখির সঙ্গে সঙ্গে তিনি একসময় সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাও ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পূর্বে ১৯৪৬ সালে তিনি আসামের আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সারে তিনি ভাষা আন্দোলন ও ইতিহাস ঐতিহ্য ভিত্তিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসে যোগদান করেন। আমৃত্যু তিনি তমুদ্দুন মজলিসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।

আজীবন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহিত্যের প্রতি অনুগত ছিলেন। জীবনের শুরু থেকে সাহিত্য চর্চা ও সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ‘সিলেট কেন্দ্রীয় মজলিস সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করে সাহিত্য চর্চাকে বিকশিত করেন।

১৯৪৮ সালে তিনি ‘সাপ্তাহিক ৯৬ বেলাল’ এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৯ সালে দর্শন সমিতির লাহোর কংগ্রেস ধর্ম দর্শন শাখার সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি অন্যান্যদের সহযোগিতায় দারুন উলুম ইসলামিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৯৬১ সালে এটি ইসলামিক একাডেমী নামে কাজ শুরু করে। বর্তমানে যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে আমাদের নিকট সুপরিচিত।

দর্শন শাস্ত্রের বিকাশ, চর্চা ও গবেষনার জন্য তিনি বিভিন্ন সময় বিশে^র নানা সেমিনারে অংশগ্রহণ করে। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সভাপতিত্বও করেন। কখনো কখনো আলোচক হিসাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে দর্শন সমিতির আন্নামালাই নগর অধিবেশনে philosopy of History বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি দিল্লীতে পাক-ভারত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগদান করেন এবং Education বা Morality বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি সিউলে রোমের ধর্ম সম্মেলনে Holiness in Islam শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। তিনি ইরান সরকার কর্তৃক ১৯৮৬ সালে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে সেই দেশ সফর করেন।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ লিখেন। যা সে সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
‘মধুময় স্মৃতির আধার নজরুল’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ লিখেছিলেন পাক ভারত স্বাধীন হওয়ার পূর্বে লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শেষে আজরফ কবি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে যে ছোট কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন তা হচ্ছে :
“তিনি রবীন্দ্র বলয় থেকে মুক্ত কবিগণের শিরোমণি, তাঁর কাব্যে নানা বিষয় ফুটে উঠেছে। তবু মানব জীবনকে তিনি অপূর্বভাবে মহামহিমান্বিত করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মানুষের প্রতি স্নেহ মমতার অপূর্ব দৃশ্যপট।

ছোট গল্প লিখতে দেয়ান মোহাম্মদ আজরফ খুবই পছন্দ করতেন। তার বিখ্যাত ছোট গল্প সংকলন নতুন সূর্য্য খুবই চমৎকার পাঠযোগ্য গ্রন্থ। উক্ত গ্রন্থের শুরুতে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন :
“গল্প লেখার অভ্যাস ছিল ছেলে বেলা থেকেই। পরিণত বয়সে প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে গল্প ফাঁদবার অভ্যাস বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছিল। গল্প ও প্রবন্ধ, সুয়োরানী, দুয়োরানীর মত কোন লেখকের জীবনে পাশাপাশি স্থান পেলে অবিচারটা বোধ হয় সুয়োরানীর প্রতিই হয় বেশী। আবার বিশিষ্ট সমালোচনা করা মন্তব্য করতে ত্রুটি করিনি, আমার প্রবন্ধে নাকি গল্পের মত হালকা পরিবেশ সৃষ্টির আভাস পাওয়া যায়। তাতে আমি মোটেই দমে যাইনি। আমার অসামর্থের দরুন না হয় তাতে সফলতা লাভ সম্ভব হয়নি, কিন্তু যারা শক্তিশালী তাদের হাতে যদি প্রবন্ধের মাঝে গল্পের সরলতা পাওয়া যায় অথবা গল্পে বুদ্ধিরদীপ্তি প্রকাশ পায়, তাহলে তাকে অভিনব শৈলী বলে বরণ করা উচিত। আমার দৃঢ় ধারণা, কোন বিশেষ সংজ্ঞার আলোকে কোন শৈলীর বিচার চলে না। প্রবন্ধ বা গল্পের মূল্য নির্ভর করে রসযোদ্ধা পাঠক-পাঠিকার উপর। যে কোন জাতের রচনাই হোক না কেন, রসিকজনের মনে রস পরিবেশনে সক্ষম হলেই তাকে সরল রচনা বলা চলে।

‘নতুন সূর্য’ গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। গল্পগুলোর পটভুমিকা সর্বত্রই কোন না কোন জায়গা। তাতে আঞ্চলিক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘নতুন সূর্য’ গ্রন্থে ১৫টি গল্প সংযোজন করা হয়েছে। সর্বশেষ গল্পের নাম অনুযায়ী গ্রন্থের নাম করণ করা হয়েছে। লেখকের সকল বিখ্যাত গল্পসমূহ এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। যেমন : শেষ দান, আজরাইলের দফতরে, সাক্ষী, নানাকার, মাটির বাসন, নিরালায়, অপরাধী, বাদলা রাতে, নতুন সূর্য ইত্যাদি।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একজন সত্যিকার ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, গবেষক, সমালোচক এবং মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জীবন ও জীবিকা যেন একাকার। জীবনকে তিনি আপন মনে বুনেছেন। জীবনকে তিনি পরকালের মুক্তির জন্য তৈরি করেছিলেন। জীবন যেন জীবন হয় তা ছিল তাঁর মৌলিক দর্শন।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক সোহেলা সোবহান তার ‘মানবতাবাদী দার্শনিক : দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন :
“দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তলস্তয়ের মতো বিশ্বাস করেন যে ধর্মের মধ্যে যুক্তি থাকলেও ধর্মের মূল হলো বিশেষ ধরনের অনুভুতি, প্রসার বিশ্বাস ও ঐশী দিশা। যুক্তি দ্বারা ধর্মীয় প্রত্যয়কে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় এবং বিভিন্ন মাধ্যমে ধর্মের বাণী প্রচার ও সেবার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এক্ষেত্রে আজরফ দর্শনের ছাত্র হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তোলেন ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দেওয়াটাই কি মানবোচিত না তার ওপর জোর করে ধর্ম বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়াটাই নৈতিক দিক দিয়ে সঠিক। একথা সত্যি যে মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা করতে হবে, নির্যাতিত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কেউ যদি এ কাজটি স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছায় না করে তাহলে তো তা নৈতিক হবে না, কারণ “নৈতিক জীবনে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকার না করলে নৈতিক জীবনের বিচারের কোন মূল্য থাকে না। এ স্বাধীনতার নীতি তত্ত্বীয় জীবনেও অবশ্য স্বীকার্য।”

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দর্শন চিন্তা কেবল বিমূর্ত তত্ত্বালোচনার সীমাবদ্ধ থাকেনি, তিনি দর্শনের সাথে জীবনকে সঙ্গতিপূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন, অন্য কথায়, তিনি একদিকে যেমন জীবনকে যুক্তির আলোকে আলোকিত করেছেন, অপরদিকে তেমনি যুক্তিকেও বাস্তব জীবনের প্রয়োজনে বল্গাহীন হতে দেননি। তার থেকেও বড় কথা তিনি দর্শনকে মানব জীবন উপলব্ধি করা এবং সে সাথে মানবতার স্বার্থে ব্যবহার করার ওপর জোর দিয়েছেন। সেজন্য নিঃসন্দেহে তাঁকে একজন জীবনবাদী মানবতাবাদী দার্শনিক বলা চলে।

দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ সকল মতের, সকল ধর্মের মানুষের প্রিয় ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন ঢাকার অধ্যক্ষ স্বামী অক্ষরানন্দ ‘আমার চিন্তায় দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ’ প্রবন্ধে বলেন :
“দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের শিক্ষা চিন্তা ও ধর্মানুরাগ বিকশিত হযেছে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ধর্মানুভুতি স্পর্শ করে। তাঁর ব্যক্তিত্বের অনাবিল ও সাবলীল গতি, অমায়িক আচরণ সম্ভল করে তাঁর জ্ঞান সমৃদ্ধ অবস্থানকে প্রাঞ্জল করেছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ মানুষের কাছে তাই প্রিয়। সকল মানবীয় ও ধর্মীয় অঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি এবং বিভিন্ন আলোচনা চক্রে তাঁর তাত্তি¡ক ও দার্শনিক অভিমত স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক ও স্বরূপ সন্ধানে অনেক অবদান রেখেছে।”

তাঁর অমর কৃতির জন্য দেশে ও বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। তার গবেষণা, চিন্তা, সমাজসেবা সম্মানে তাকে দেয়া হযেছে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৮১, একুশে পদক ১৯৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশান পুরস্কার ১৯৮৩, নাছির উদ্দিন স্বর্ণপদক ১৯৮৪, মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক ১৯৮৮, ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক ১৯৮৯সহ বহু পদক তিনি লাভ করেন। সর্বশেষ সরকার তাঁকে ১৯৯৩ সালে জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে সম্মানিত করেন। এই গুণী ব্যক্তি সকলকে ছেড়ে পরকালে চলে যান ১লা নভেম্বর ১৯৯৯ সালে।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমাদের জাতির বিবেক। এ দেশবাসীর সকলের গর্ব এবং অহংকার। আগামী প্রজন্মের তিনি অনুপ্রেরণার এবং দিক নির্দেশনার মুল উৎস হয়ে থাকবেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহম্মেদ ১৯৯৭ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এর জাতীয় সম্বর্ধনা কালে প্রকাশিত গ্রন্থের ‘বাণীতে’ বলেন :
“আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, মনন ও মনীষার ক্ষেত্রে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এর অমূল্য অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর লিখিত একাধিক গবেষণামূলক পুস্তক ও প্রবন্ধ তাঁর পান্ডিত্যের পরিচয় বহন করে। শিক্ষা ও জ্ঞান প্রসারে তাঁর আজীবন সাধনা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

কিংবদন্তীর নায়ক সিলেটের হাসন রাজার পৌত্র দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সব সময় নিজকে মনে করতেন তিনি একজন দর্শনের ছাত্র। তিনি বলতেন : “আমি এখন চিন্তা করছি এবং আমার এই চিন্তার ফল আমার বিভিন্ন লেখার প্রকাশ করছি। কাজেই একেবারে পাকাপোক্ত দার্শনিক যেমন প্লেটো, এরিষ্টটল, এদের মতো স্থান আমার নয় এবং আমাকে এখনও আমি দর্শনের ছাত্র বলেই গন্য করি।”

জীবনের আকা-বাকা পথে দেয়ান মোহাম্মদ আজরফ একটি নীতিবান সমাজ গঠনের জন্য অবিরাম কাজ করে গিয়েছেন। আমি যখন ১৯৭৪ সালের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছিলাম তখন বেশ কয়েকবার তাঁর আবু জর গিফারী কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে নিমন্ত্রনের জন্য গিয়েছিলাম। দেখেছি বিশাল এক টেবিলে ওপাশে তিনি শান্ত ধীরভাবে বসে কাজ করছেন। টেবিলের উপর অগণিত বই পুস্তক ও কিছু ফাইল। বই এর এই স্তুপের মধ্যে তিনি যেন ওপাশে স্রিওমান। কখনও যেন সভার প্রধান অতিথি বা কোন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার জন্য নিমন্ত্রণ করেছি। ঠিক সময় তিনি সভায় উপস্থিত হয়ে জ্ঞানগর্ব বক্তব্য দিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এর জীবন, ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তাই ছিল দর্শন। তাই যখন তাঁর বয়স পঁচাশি বছর তখন আমিনুর রহমানকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে দর্শনের সাথে সমাজের সম্পর্ক কোথায়, এই প্রশ্নের জবাবে বলেন :
“দর্শন সমাজকে সচেতন করে তোলে। মানুষের এই জীবনের উৎপত্তি, মানুষ কিভাবে গঠিত হলো, মানুষের সমাজ কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, মানুষের চিন্তাধারার উদ্ভব কিভাবে হলো, এই চিন্তাধারা মানুষকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এবং এই চিন্তার পরিনতি কি ইত্যাদি সম্পর্কে দর্শন সচেতন করে তোলে।

সাধারণভাবে সকল মানুষের মধ্যে এই সকল চিন্তার উদ্ভব হয় এবং এ সম্পর্কে তারা সচেতন নয়। দর্শনের কাজ হলো মানুষকে সচেতন করে তোলা এবং মানুষের চিন্তার মধ্যে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করা, যাতে সে চিন্তা করে মানুষের সেই আদি প্রশ্নগুলির সমাধান করতে পারে এবং এই সমাধানের চেষ্টা করে তার ফলও সমাজকে দিয়ে যেতে পারে। কাজেই সমাজে দর্শনের কার্যকারিতার বিশেষ স্থান রয়েছে বলেই দর্শনের চর্চা অনিবার্য এবং হওয়া উচিত।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments