Comrade Muzaffar Ahmed

কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ
আহ্মেদ রাজনৈতিক নেতাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ

“আমি হলফ করে বলতে পারি, মুজফ্‌ফরকে দেখলে লোকের শুষ্ক চক্ষু ফেটে জল আসবে। এমন সর্বত্যাগী, আত্মভোলা, মৌন কর্শ, এমন সুন্দর প্রাণ, এমন ধ্যানী দুরদৃষ্টি, এমন উজ্জ্বল প্রতিভা এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কি করে জন্মালো বাংলায় তা ভেবে পাইনে।”
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন কমরেড মুজফ্‌ফর এ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরই ছোট উক্তিটি উপরে উল্লেখ করলাম।

আজ থেকে একশত একত্রিশ বছর পূর্বে বৃটিশ ভারতে আমলে মুজফ্‌ফর আহমদ চট্টগ্রাম জেলার সাগর বেষ্টিত সবুজ দ্বীপ সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে ৫ই আগস্ট ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মনসুর আলী (১৮২৭-১৯০৫)। মুজফ্‌ফর আহমদের মায়ের নাম চুনা বিবি, দাদার নাম ছিল মোহাম্মদ কায়েস। নানার নাম ছিল ইরশাদ আলী ঠাকুর। তাঁর মা চুনা বিবি ইন্তেকাল করেন ১৯১৪ সালে যখন মুজফ্‌ফর আহমদের বয়স মাত্র ২৫ বছর। তাঁর পিতা মনসুর আলী জমিদারী স্টেটের মোক্তার ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ সন্দ্বীপ পরগনার স্বাধীন রাজা দেলওয়ার খানের ‘মীর মুন্সী’ ছিলেন।

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সময় সন্দ্বীপে কোন হাইস্কুল ছিল না। তাই তিনি নোয়াখালী জেলা স্কুলে থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন। পরবর্তীতে কলিকাতার হুগলী মহসীন কলেজ আইএ ক্লাশে ভর্তি হন। কিছুদিন আইএ ক্লাস করেন। তবে পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ পান নাই।

আমার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানায় হওয়ার কারণে মুজফ্‌ফর আহ্মদ সম্পর্কে আমার জানারও বলার আগ্রহ একটু বেশি। ছোটকাল থেকে আমরা কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্মদ নামে তাকে জানি, শুনি। দেশে বিদেশে নানা স্থানে এই গুণীজনের আলোচনা।

অনেকদিন ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে বেশ মনোযোগ থাকার কারণে এই সকল রাজনৈতিক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক সম্পর্কে জানার সুযোগ কম হয়েছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে বাম রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে পরিচয় কম থাকার কারণে তাঁর সম্পর্কে জানার সুযোগও কম হয়েছে।

আজ থেকে প্রায় তের বছর পূর্বে একবার কোন এক শীতে আমার গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে বেশ কিছুদিন কাটাবার সুযোগ হয়েছিল। সঙ্গে ছিলে দেশের খ্যাতিমান কবি আবদুল হাই শিকদার। তিনি আবার কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে তখন বেশ চর্চাও গবেষণা করছিলেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি উত্তর মগধরায় যাওয়ার পর কবি আবদুল হাই শিকদার এর আগ্রহ হলো মুজফ্‌ফর আহ্মদের স্মৃতি চিহ্ন গ্রামের বাড়ি দেখার জন্য। তাই আমি কবি আবদুল হাই শিকদার ও আমার এক বন্ধু বেবী টেক্সি করে মুজফ্‌ফর আহ্মদের বাড়ি মুছাপুরে যাই। তখন বাড়িটি নদীতে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। নদীর তীরে। দুইটি মাত্র ঘর তখন ডাঙ্গায় বাকি ছিল। কবি নজরুল এই বাড়িতে মুজফফর আহমদ এর সাথে সময় কাটিয়েছেন- সেই স্মৃতি দেখার আমাদের আগ্রহ। বর্তমানে অবশ্য নদী ভরাট হয়ে আরও অনেক মাইল সন্দ্বীপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বর্তমানে মুজফফর আহমদ বাড়ি অক্ষত রয়েছে। তবে এখন তার বংশের কে বা কাহারা আছেন জানি না।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে মুজফফর আহমদ ১৯০৭ সালে সন্দ্বীপের ন্যায়াবস্তি ইউনিয়নের বিখ্যাত প্রজা আন্দোলনের নেতা চাঁদ মিয়া মুন্সীর কন্যা হাফেজা খাতুনকে বিবাহ করেন। তাঁর একমাত্র কন্যা সন্তান ছিল আফিফা খাতুন। এই কন্যাকে বিবাহ দেন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ব্রাহ্মণবাড়ীয়া নিবাসী আবদুল কাদির এর সঙ্গে। এই বিবাহের উকিল ছিলেন কবি কাজী নজরুর ইসলাম। কবি কাজী নজরুর ইসলাম আফিফা খাতুনের বড় ছেলের নাম রাখেন ‘দারা’।
আর্থিক দৈন্যতার জন্য মুজফফর আহমদ কলেজ জীবনের পর আর উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পান নাই। চাকরি জীবন প্রেসে কাজের মাধ্যমে তার শুরু। বাংলাদেশে তথা সন্দ্বীপ ছাড়ার পর আর কলিকাতা তথা ভারত থেকে আসেন নাই। বেড়ে উঠেন ভারতে, ভারতের আদর্শে, ভারতের সংস্কৃতিতে তার জীবন গড়ে উঠা।

কমরেড মুজফফর আহমদ ছোট বেলা থেকে সাহিত্যের প্রতি বেশ ঝোক ছিল। লিখতেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। ছিলেন একজন ভাল সাহিত্যকর্মী। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। কলিকাতায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর নিয়মিত ছেলেবেলার লেখা ছাপা হতো। নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মীর সাথে সাথে তিনি সাহিত্য চর্চাও ভালভাবে চালিয়ে যান। সাহিত্য না রাজনীতি কোনটি গ্রহণ করবেন, এই দ্বন্দ্বে তিনি দুটিকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে বেড়ে উঠেন সাহিত্যিক ও নিয়মিত সক্রিয় সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী।

তিনি পরবর্তীতে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পান। তিনি বক্ষীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সহকারী সম্পাদক এবং একমাত্র সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন। এই সময় লেখার সুবাদে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তিনি বন্ধু গড়ে উঠে। তিনি হয়ে উঠেন নজরুলের অন্তরঙ্গ বন্ধুও সহযোগী। ১৯১৮ সালে নজরুল ইসলামের
লেখা বঙ্গীয় মুসলিম পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। তখন থেকে নজরুলের সঙ্গে মুজফফর আহমদের সখ্যতা। উভয়ের মধ্যে পত্র লেখা, আলাপ ও সাক্ষাতে বন্ধুত্ব বেড়ে যায়। এ কে ফজলুল হকের মালিকানাধীন সান্ধ্য “দৈনিক নবযুগ’ বের করেন মুজফফর আহমদ এবং কবি কাজী নজরুল ইসলাম যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে। মুজফফর আহম্মদ ‘সাপ্তাহিক নবযুগ, গণবাণী’ পত্রিকারও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সময় নজরুল ইসলাম শ্রমজীবি মানুষের দুঃখ সুখ, সমস্যা প্রভৃতি দেখে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর সাহিত্যে তাদের নিয়ে বেশ লেখা গিয়েছে। ‘সর্বহারা’ শ্রমিক, প্রভৃতি কবিতা নজরুলের বাম রাজনৈতিক চিন্তার প্রকাশ।

বাংলা ১৩২৯ সালে শ্রাবণ মাসে অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন কাজী নজরুল ইসলাম। মুজফফর আহমদ “দেপায়ন’ ছদ্মনামে নিয়মিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় লিখতেন।
কলেজের ছাত্রাবস্থায় ১৯১৫ সালে মুজফফর আহমদ বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সহ সম্পাদক হন। এই সময় কবি নজরুলের সঙ্গে সখ্যতার পর তিনি নজরুলকে সাম্যবাদী ও বিপ্লবী রচনা লিখতে উৎসাহিত করেন।

১৯২২ সালে মুজফফর আহমদ একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পর তিনি তার সর্বশক্তি দিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী ও গঠনের জন্য নেমে পড়েন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় তখন কমিউনিস্ট পার্টি ভারতে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। ধীরে ধীরে ব্রিটিশের রোষানলে পড়েন। ১৯২৩ সালে মে মাসে “পেশোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র” মামলায় আসামী করে বন্দি করা হয়। কিন্তু প্রমাণ না পাওয়ায় তিনি মুক্তি পান। ১৯২৪ সালে ‘কানকুন কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র’মামলায় চার বছরের দন্ড দেয়া হয়। মুজফফর আহমদ সব সময় শ্রমিক, নাবিক, মেথর মাঝি নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলেন। কৃষক শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠনকে শক্তিশালী করা একমাত্র তার পক্ষে সম্ভব হয়। তিনি ছিলেন এর ক্ষেত্রে সবার চেয়ে যোগ্য ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা। “পূর্ব বাংলায় সমাজ ও রাজনীতি গ্রন্থে লেখক কমরুদ্দিন আহমদ বলেছেন, “এ উপমহাদেশের আধুনিক সংগ্রামী শ্রমিক সংগঠন আর কৃষক আন্দোলন প্রধানত তাঁর অবদান। মুজফফর আহমদ অতি সহজে সকলের সঙ্গে মিশতে পারতেন। নিজের আদর্শ সহজ ভাষায় তুলে ধরতে সক্ষম হতেন। নতুন ও জটিল এই মতাবাদকে তিনি সহজ ভাষায়, সহজে মানুষকে বুঝাতে সক্ষম হওয়ার কারণে তিনি জন মানুষের নেতায় পরিণত হন। ১৯২৯ সালে আবারও তিনি মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে বৃটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৩৩ সালে তিনি যাবজ্জীবন দীপান্তর দন্ডে দন্ডিত হন। উকিলে সাজা কমিয়ে ৩ বছর করা হয়। ১৯৩৫ সালে অসুস্থতার কারণে তাঁকে মুক্তি দিয়ে নজর বন্দি করে সন্দ্বীপে নিজ দ্বীপে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর পর তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান। এই সময় তার বন্ধুমহল সহ সকল স্তরের মানুষ লন্ডনে ভারত সচিবের নিকট ডেপুটেশন পাঠিয়ে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্তি লাভ করেন।

মুজফফর আহমদ এর ইতিহাস হচ্ছে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস। তার জীবন পুরোটা তিনি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে উন্নয়নে, সম্প্রসারণে ব্যয় করেন।নিজের ব্যক্তি জীবনের জন্য তিনি কোন কিছুই করেন নাই। সংসার জীবন ত্যাগ করে আজীবন সংগঠনের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজকে নিবেদিত করেন। দলের কার্যালয় ছিল তার আবাস। যেখানে তিনি থাকতেন, ঘুমাতেন এবং বাকী সময় সংগঠনের কাজ করতেন। অত্যাচার, নির্যাতন, কারাগার, হুলিয়া কোন কিছুই তাকে সংগঠনের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। গোটা ভারত বর্ষে কমরেড মুজফফর আহমদের মত আর কোন নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি অদ্বিতীয়, , অক্ষয়, অমর ব্যক্তিত্ব।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কমরেড মুজফফর আহমদ সম্পর্কে যে বক্তব্য লিখেছেন তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

কমরেড মুজফফর আহমদকে সব সময় বঙ্গীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি দায়িত্ব প্রদানের আহ্বান জানানো হতো। কিন্তু কখনও তিনি তা গ্রহণ করন নাই। শেষ পর্যন্ত সকলের অনুরোধে তিনি সহ-সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণে সম্মতি দিয়েছিলেন। সুভাস বোস তখন ছিলেন সভাপতি। বিশিষ্ট লেখক, অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁর রেখাচিত্র গ্রন্থে মুজফফর আহমদ সম্পর্কে লিখেন, “এ হচ্ছে মুজফফর আহমদের চরিত্রের একদিক পদ আর পদবীকে তিনি সব সময় এড়িয়ে চলেছেন। আজ আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র দেখুন কেমন। একবার কোন পদ পেলে তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়েন না। শত দুর্নীতি, অপকর্ম, অযোগ্যতার পরিচয় প্রকাশ হওয়ার পর উক্ত ক্ষমতা থেকে নিজকে সরিয়ে দিতে কোনক্রমেই রাজি হন না। আর তিনি ছিলেন ক্ষমতার প্রতি লোভহীন, শুধু কাজ আর কাজ করে দলের জন্য ছিলেন নিবেদিত।

কমিউনিস্ট পার্টির কাজ নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। তিনি নিজ পরিবারের খোজও নিতে পারেন নাই। দীর্ঘ জীবন কলিকাতা ও ভারতের অন্যান্য স্থানে থেকে দলের কাজ পরিচালনা করেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি একবার চট্টগ্রামে এসেছিলেন। আবার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু সেবারও তিনি ব্যস্ততার জন্য নিজ জন্মভ’মি সন্দ্বীপে যেতে পারেন নাই।

ছাত্র জীবন থেকে মুজফফর আহমদ লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কবি নজরুলের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। মুজফফর আহমদের লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হচ্ছে : ‘কৃষক সমস্যা, কাজী নজরুলের স্মৃতিকথা, নজরুল প্রসঙ্গ ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ’ ‘এরামে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন, ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ‘সমকালের কথা’ প্রভৃতি তথ্য সম্বলিত গ্রন্থ আজও পাঠক সমাজে অনেক সমাদৃত।

যখন মুজফফর আহমদ বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন তখন তার কর্মতৎপরতা সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম যা লিখেছেন তা হচ্ছে- “যে মুসলমান সাহিত্য সমিতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল মুজফফর অথচ নিজের নাম চিরকাল গোপন রেখে গেল, যেই মুসলমান সাহিত্য সমিতি যখন নুতন করে প্রতিষ্ঠা হল এবং তার নতুন সভ্যগণ মুজফফর রাজলাহিত বলে এবং তাদের অধিকাংশই রাজভৃত্য বলে তখন তার বন্দী বা মুক্ত হওয়ার জন্য নাম পর্যন্ত নিলেন না তার ঋণের কথা স্বীকার তো দূরের কথা, তখন একটি কথা কয়েও দুঃখ প্রকাশ করেনি মুজফফর। ও যেন প্রদীপের তৈল, ওকে কেউ দেখল না, দেখল শুধু সেই শিখায়ে, যা জ্বলে তৈল শোষণ করে।”

রাশিয়ার সর্বহারা বিপ্লব মুজফফর আহমদ এর উপর ভীষণভাবে প্রভাব সৃষ্টি করে। সেই সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেন। লেলিনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশে কমিউনিউজম প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা জানি তারই একান্ত চেষ্টায় ১৯২১ সালে তা প্রতিষ্ঠা।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলো। দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হলো একটি ভারত, অন্যটি পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান হলো। ১৯৪৮ সালে আবার কমিউনিস্ট পার্টি ২০শে মার্চ নিষিদ্ধ হলো। মুজফফর আহম্দ সহ বহু নেতা গ্রেফতার হলেন। ১৯৫১ সালে মুক্ত হলেন। ১৯৬২ সালে গ্রেফতার হয়ে দুই বছর কারাবরণ করেন। ১৯৬৫ সালে আবারও গ্রেফতার হন। ভারতীয় কংগ্রেস কর্তৃক দেশ স্বাধীন হবার পর বহুবার গ্রেফতার হন। কমিউনিস্ট পার্টি আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্ম পরিচালনার সঙ্গে ভারতীয় শাসক দল কংগ্রেস তখন একমত পোষণ করতে পারেনি।

কমরেড মুজফফর আহমদ সময়কার রাজনীতিকালে ভারতবর্ষের প্রায় এক চতুর্থাংশ জনগণ মুজফফর আহমদের রাজনৈতিক মতবাদের সমাজ বাদে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল। তখন এই মতবাদ ভারতবর্ষে রাজনৈতিক গগনে এক অত্যুজ্জ্ল শক্তি হিসাবে এসেছিল। যার প্রভাব ১৯৭১ সালে পর পর বাংলাদেশে লেনিনের আদর্শে ততদিল তরুন সমাজ বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্ট নামে দেশে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু করে। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন অত্যন্ত শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

কিন্তু বর্তমানে ভারতসহ সারা বিশ্বে লেনিন এর সেই আদর্শের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশ হ্রাস পেতে থাকে। খোদ রাশিয়া খন্ড খন্ড হয়ে অনেক স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। চীনেও মাওবাদী কমিউনিজম তখন ম্রিয়মান। পুজিবাদী আদর্শের সঙ্গে অগ্রিম নতুন মাত্রা নিয়ে রাশিয়া ও চীন আলাদা আলাদা আদর্শে বিশ্বাসী ও তৎপর।

১৯৭১ সাল পর্যন্ত এমন কি এর বেশ কিছু বছর পরেও লেনিনের আদর্শের সমাগম বেশ ভাল ছিল। তখন অনেকে চিন্তা করতেন অদূর ভবিষ্যতে এই উপমহাদেশে লেনিনের আদর্শে দেশগুলো গড়ে উঠবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আশায় নিভে গেল। কমরেড মুজফফর আহমদের শত চেষ্টা, শত আশা, তার আদর্শে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলন যেন স্তিমিত হয়ে এলো। তখন রাজনৈতিক এই উজ্জ্বল সময়ের চিত্রটি ছিল কমরেড মুজফফর আহমদের বিরাট সফলতা। আমাদের দ্বীপের বাসিন্দা হিসাবে আমরা আজও মুজফফর আহমদকে নিয়ে গর্ব করি। লেখালেখি করি। অনুষ্ঠান করি। তাঁকে স্মরণ করি।

আমাদের দেশে মুজফফর আহমদকে তেমন স্মরণ নাও করলে ভারতের মানুষ স্মরণ করে। কলিকাতায় রিপন স্ট্রীটের নাম পরিবর্তন করে মুজফফর আহমদ স্মরণী রাখা হয়েছে। মহাজাতি সদনে রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজী সুভাষ বসুর সাথে মুজফফর আহমদের তৈলচিত্র স্থাপিত হয়েছে। কলকাতায় সিপিআই (এম) এর প্রধান দফতর ভবনটির নাম করণ করা হয়েছে মুজফফর আহমদ ভবন। এখানে স্থাপিত হয়েছে তাঁর প্রস্তর মূর্তি। ৫ই আগস্ট ১৯৮৯ সালে মুজফফর আহমদ শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আইন সভায় তাঁর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।

একজন সৎ, নিষ্ঠাবান নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা হিসাবে তিনি সব সময় স্মরণীয় হয়ে থাবেন। যা আজকের রাজনীতি অঙ্গনে পাওয়া যায় না। আজ রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল কেন্দ্রিক তথা গোষ্ঠী কেন্দ্রিকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মুজফফর আহমদ এই সকলের অনেক উর্ধ্বে ছিল। ছিলেন সততার উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেশ, মানুষ ও মানুষের কল্যাণে নিজের পুরো জীবন বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। সম্পদ, অর্থ ভোগ বিলাস কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি সকলের জন্য জ্বলন্ত উদাহরণ। সকলের অনুসরণীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব। তিনি সন্দ্বীপে তথা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করলেও ভারতবর্ষের রত্ন ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান ও সহযোগিতা আমরা সব সময় স্মরণ করব।

কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা এবং আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই দুই বই থেকে মুজফফর আহমদ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানার সুযোগ হয়েছে।

১৯৬৪ সালে মার্চ মাসে মুজফফর আহমদ এর স্ত্রী পরলোক গমন করেন। তারই মৃত্যুর আট বছর পর ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে ৮৪ বছর বয়সে এই মহান নেতার বিদায় ঘটে। বামপন্থী, লেনিন পন্থী, কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের স্রষ্টা, স্বপ্নদ্রষ্টা, ভাতরবর্ষের আদর্শ কমরেড রাজনৈতিক আদর্শ ব্যক্তির বিদায় রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য সব সময় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Romiz Uddin
Romiz Uddin
2 years ago

কমরেড মোজাফফর আহমেদের বংশধর কে কে আছে? ওদের নাম পাওয়া যাবে?