জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ প্রনয়নের কাজ শুরু হয়েছে। সরকার এই সংক্রান্ত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। প্রতি বছরের মতো এবারও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাজেট প্রনয়নে কার্যক্রম শুরু করেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা, গবেষক, অর্থনীতিবিদগণ বাজেট নিয়ে আলোচনা করছেন এবং মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করছেন। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে আরও বেশি শক্তিশালী এবং একটি কার্যকর বাজেট প্রনয়নে সহযোগিতার জন্য দেশের বণিক সমাজও এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন সমিতি, চেম্বার এবং এফবিসিসিআই সকল বাণিজ্যিক বেসরকারী সংগঠন বাজেট নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি বাজেট প্রনয়নে নানা পরামর্শ রাখছেন। প্রতিবছর এই কাজটি আমাদের দেশে হয়ে আসছে। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে যে সকল বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে জোর : ৫ আগস্ট ২৪ এর ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা দেশে ছেড়ে ভারতের দিল্লীতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে দেশের অর্থনীতিতে একেবারে ধ্বংস করে গিয়েছে। দেশের ব্যাংকিং তথা আর্থিক খাতকে লুট করে, অর্থ পাচার করে একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে। তাই আসন্ন বাজেটে তথা ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে অধিকতর অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের সকল ব্যাংক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুবিচারের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নীতি সহযোগিতার মাধ্যমে সবল করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থ পাচারসহ যাবতীয় নেতিবাচক কাজ কর্ম থেকে সকলকে সরে আসতে হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প গ্রহণ : দেশে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। প্রতিবছর শিক্ষিত বেকার আসছে চাকরির সন্ধানে। ২০ লক্ষের অধিক চাকরির বাজারে প্রতিবছর প্রবেশ করছে। তাই সরকারকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে চীন, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বন্ধু দেশসমূহের বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। আগামী বাজেটে সেই লক্ষ্য ঠিক করে অগ্রসর হতে হবে।
দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা : দেশের দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। বিগত করোনাকালে এই দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের লুটপাটের ফলে দেশের আর্থিক খাত ধ্বংস হয়ে পড়ে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ব্যাংকগুলো থেকে নামে বেনামে ঋণ নিয়ে হাসিনা সরকারের সহযোগিরা দেশের অর্থনীতিকে একেবারে পঙ্গু করে ফেলে। ফলে দেশে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখনও দিন দিন বাড়ছে। তাই এই জনগোষ্ঠীর রক্ষা করার জন্য বাজেটে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে : দেশের মূল্যস্ফীতি এখন বড় সমস্যা। সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির ফলে ক্রয় ব্যয়ের সামাল দিতে পারছে না। এই ব্যাপারে আসন্ন বাজেটে বিশেষ উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের ব্যয় হ্রাস করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় দ্রæত হ্রাস করা দরকার। পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। আমদানীকৃত পণ্যের এলসি পরিকল্পিতভাবে খোলে পণ্যের চাহিদা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারী’২৫ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি ছিল। গ্রাম ও সদরে খাদ্য বহিভর্’ত মূল্যস্ফীতি থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি। মূল্য স্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ কোন সঞ্চয় করতে পারছে না। পূর্বের সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করলে মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়বে। তাই কোন ক্রমেই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা ঠিক হবে না।
সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা : বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক, ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প খাতে যেন কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেটি আসন্ন বাজেটে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
করনীতি : আসন্ন বাজেটে করনীতি পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ব্যক্তিকর বাড়িয়ে কমপক্ষে ৫ লক্ষ কর মুক্ত করা উচিত। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে এর সীমানা বাড়ানোর যুক্তি রয়েছে। করদাতা যেন ঝামেলামুক্তভাবে কর দিতে পারে সে বিষয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। সামঞ্জস্যপূর্ণ কর নীতি করতে হবে, যা হবে বাস্তবায়নযোগ্য। ভ্যাটের হার পরিবর্তন করে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার। অবশ্য এই ক্ষেত্রে কেউ কেউ ১০ শতাংশের প্রস্তাব রেখেছেন। ব্যক্তি কর ২৫ শতাংশ করা উচিত। যা বর্তমানে প্রায় ৩৫ শতাংশ রয়েছে।
এনডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে : সরকার ইতিমধ্যে দেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর করার জন্য ২০২৬ সালকে ঠিক রেখেছেন। এই অবস্থার ফলে রপ্তানিকারকগণ নগদ সহায়তাসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন না। দেশীয় শিল্প রক্ষার স্বার্থে বিকল্প হিসেবে শিল্পখাতে সকল পণ্যের উপর ভ্যাট হ্রাস করে মাত্র ৫ শতাংশ করাতে পারে। তাতে ব্যবসায়ীরা নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা পাবেন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাত : দেশের বিদ্যুত ও জ¦ালানী খাতের উন্নয়নের উপর পুরো দেশের উন্নতি নির্ভর করে। বিদ্যুত কেন্দ্রে ম্যাগাসিটি পেমেন্ট বিষয়টি বাতিল করা উচিত। পেট্রোবাংলার মাধ্যমে দেশে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির স্বার্থে কুপ খননে মনোযোগী হতে হবে। গ্যাস উন্নয়নের তহবিলকে বৃদ্ধি করতে হবে। কুপ খননে পেট্রোবাংলাকে এই তহবিল ব্যবহার করা উচিত, বিদেশী ঋণের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত : ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। এই দুই খাতের ব্যয় বৃদ্ধি এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথ সহজ হবে। ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের আমদানি করা বইয়ের ওপর শুল্ক, কর সম্পুর্ণ প্রত্যাহার করা উচিত। মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করর্পোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা উচিত। শিক্ষা উপবৃত্তির অর্থ দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করছি। জুলাই আগস্ট ’২৪ এর আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে স্কুল ফিডিং কর্মসূচীর আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
ডিজিটাইজেশন করা : দেশের বিভিন্ন খাত আইটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। এইক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে। এই খাতে বিনিয়োগ করলে এর উপর কর কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যাবে।
দুর্বল শিল্পকে সহায়তা : বিগত স্বৈরশাসক আমলে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক নানাভাবে লুট হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকসমূহকে পরিকল্পিতভাবে এস আলমসহ কিছু গ্রুপ ও ব্যক্তি কর্তৃক লুট করে দুর্বল করা হয়েছে। সেই সময় প্রকৃত ব্যবসায়ীগণ ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। যার ফলে অনেক বড় বড় ভালো শিল্প উদ্যোক্তাগণ এখন ঋণখেলাপী। কারখানা বন্ধ। এলসি করতে পারছে না। আসন্ন বাজেট বিশেষ ব্যবস্থা রেখে এই সকল ঋণখেলাপী শিল্প খাতকে উদ্ধার করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। তাদের সকল ঋণ ১৫ থেকে ২০ বছর মেয়াদী করে দিয়ে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। তাতে দেশের বিরাট উপকার আসবে। হাজার হাজার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংকগুলো তাদের ঋণের অর্থ সহজে ফেরত পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয় এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্বল এই সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় নগদ ঋণ সহায়তা দিতে হবে। এলসি খোলার অনুমতি দিতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্প ও স্পিনিং খাত : দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধানতম খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পখাত। দেশের ক্রয় ৭৮ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে এই খাতের মাধ্যমে। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান সহযোগী খাত হচ্ছে দেশের স্পিনিং খাত। শতভাগ তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করে আমাদের স্পিনিং খাত তৈরি পোশাক শিল্পে সুতা সরবরাহ করছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের স্পিনিং খাত টিকতে পারছে না। তাই দেশের সামগ্রিক বস্ত্রখাতের সহযোগিতার জন্য সূতা আমদানী কারকের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সূতা দেশীয় স্পিনিং থেকে ক্রয় করার বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার। তাহলে দেশের স্পিনিং খাত ভারতের দানবীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাবে। সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মাধ্যমে এম আরও জারি করে দ্রুত এই ব্যবস্থা নিতে পারে। আসন্ন ২০২৫-২৬ বাজেট প্রস্তাবে মাননীয় অর্থ উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেশীয় শিল্প রক্ষার স্বার্থে প্রস্তাবনা আশা করছি। এবং তুলা আমদানির ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভ্যাট ও কর মওকুফ রাখা প্রয়োজন। তুলার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের নানা চার্জ সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করার আহŸান করছি।
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি : আমাদের দেশে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্যাস নির্ভর। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্প প্রতিষ্ঠান চলে। বিগত স্বৈরাচার সরকার গ্যাসের মূল ঘনফুট প্রতি এক লাফে পনেরো টাকা থেকে ত্রিশ টাকা উন্নীত করে। তাতে অনেক শিল্প দূর্বল হয়ে পড়েছে। শুধু দেশের শিল্প খাতে উন্নীতির স্বার্থে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের পূর্বের মূল্যে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে স্পিনিং খাত ভারতের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না তাই গ্যাসের মূল্য হ্রাস করা খুবই জরুরি।
কয়েক দিন পূর্বে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন এবারের বাজেট হবে ব্যবসায়ি বান্ধব বাজেট। ব্যবসায়িদের স্বার্থ রক্ষা বিনিয়োগ বৃদ্ধি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির টার্গেট নিয়ে ২০২৫/২৬ সালের বাজেট প্রণীত হবে বলে আমরা আশা করছি।

আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।