জাগো বঙ্গবাসী
দেখ, কে দুয়ারে
অতি ধীরে ধীরে করে করাঘাত।
ঐ শুন শুন!
কেবা তোমাদের
সুমধুর স্বরে বলে: “সুপ্রভাত!”
অলস রজনী
এযে পোহাইল,
আশার আলোকে হাসে দিননাথ।
শিশির সিক্ত
কুসুম তুলিয়ে
জলাভরে নিয়ে এসেছে ‘সওগাত’।
বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাংলা সাহিত্যে বেগম রোকেয়া এক অসাধারণ নাম। অধঃপতিতা নারী সমাজকে মুক্তির সত্য সুন্দর পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে ত্যাগের একটি উজ্জ্বল আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। উপরের কবিতাটি বেগম রোকেয়ার বিখ্যাত ছোট্ট কবিতা ‘সওগত’।
আজ থেকে একশত চল্লিশ বছর পূর্বে ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০ সালে বর্তমান রংপুর জেলার পায়রাবন্দ বৃটিশ শাসন আমলে, মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩২ সালে ৯ই ডিসেম্বর তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। রোকেয়া খাতুন তাঁর পিতা মাতার দেয়া নাম। বাবা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলা হায়দার সাবের ছিলেন জমিদার এবং বহু ভাষাবিদ বুদ্ধিজীবি। মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। তিন ভাই তিন বোন পিতা মাতার। বেগম রোকেয়ার স্বামী খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন।
বেগম রোকেয়ার সময় মেয়েদের শিক্ষা লাভ বড়ই কঠিন ও কঠোর ছিল। ইংরেজি শিক্ষা তো শিক্ষা করার প্রশ্নই উঠে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় নয় কলেজে, স্কুলে ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বেগম রোকেয়া বঞ্চিত হন। বড় বোন করিমুন্নেসা খানম (১৮৫৫-১৯২৬) সহযোাগিতায় এবং বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের এর প্রত্যক্ষ উৎসাহে রোকেয়া বড় বোনের বাড়িতে ইউরোপিয়ান গর্ভনেসের কাছে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পান। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় না গিয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন বেগম রোকেয়া। তখনকার অবরুদ্ধ নারী জীবনে বাড়িতে ভাই বোনদের সহযোগিতায় ইংরেজি, আরবী, ফার্সি, ইর্দু ও হিন্দি ভাষায় শিক্ষিত ছিলেন তিনি।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৯৬ সালে বেগম রোকেয়ার বিবাহ হয় খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন এর সঙ্গে। বিহারের ভাগলপুরের অধিবাসী সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন বিয়ের সময় উড়িষ্যার কনিকা স্টেটের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের নিযুক্ত ম্যানেজার ছিলেন। ১৮৯৯ সালে স্বামী শাখাওয়াত ভাগলপুরের কমিশনারের পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট নিযুক্ত হন। বিয়ের পর পর দুই সন্তান অকালে হারান। তাঁর স্বামীর পূর্বের বিয়েতে এক মেয়ে ছিল। নিসন্তান বেগম রোকেয়া জীবন যুদ্ধে নারী জাগরণের জন্য বিজয়ী মহিয়সী মহিলা।
বেগম রোকেয়ার লেখালেখি শুরু হয় জীবনের শুরু থেকে। প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ (মহরম) ১৯০২ সালে। হরেন্দ্রলাল রায় ও জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় সম্পাদিত নরপ্রভা চৈত্র ও বৈশাখ ১৩০৮-১৩০৯ যুগ্ম সংখ্যায় ‘পিপাসা’ প্রকাশিত হয়। বেগম রোকেয়ার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নিতান্তই অল্প, সাত পাঁচটি : মতিয়ুর (প্রথম খন্ড ১৯০৪), ঝঁষঃধহং উৎবধস (১৯০৮), মাতচুর (দ্বিতীয় খন্ড ১৯২২), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধ বাসিনী (১৯৩১)।
সাহিত্য কর্মের বাইরে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ১৯০৯ সালে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং ১৯১৬ সালে ‘আনজুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি সেবামূলক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা। বাংলা, ইংরেজি রচনা, স্কুল প্রতিষ্ঠা, নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা বেগম রোকেয়ার এই সমস্ত কর্মকাÐের লক্ষ্য দিন নারীর জাগরণ, পুরুষের সমান নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা।
১৮০০ খ্রিস্টাবে বাঙালি মুসলিম নারী সমাজ ছিল অন্ধকারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে শুরু হয়েছিল বাঙালি মুসলমানের বহবিলম্বিত জাগরণ। সেই জাগরণের সঙ্গে বেগম রোকেযা নারী সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চেয়েছিলেন। রোকেয়া চেয়েছেন মনুষ্যত্বের উদ্বোধন। বেগম রোকেয়ার এই ইচ্ছা কেবল স্বপ্ন ছিল না, তা ছিল ভুমিস্পর্শী অভিযানÑ বেগম রোকেয়ার লেখালেখি, স্কুল প্রতিষ্ঠা, সংগঠন তৈরি, বক্তৃতা বিবৃতি সবই তার সাক্ষ্য দেয়। তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম যে আলোড়ন জাগিয়েছিলেন শতাব্দীর শেষে এবং আজকে পর্যন্ত তার তরঙ্গের ঢেউ প্রত্যক্ষ করছি।
বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে ‘বেগম রোকেয়া রচনাবলী’ গ্রন্থের ‘প্রসঙ্গ কথা’ শিরোনামে বলেনÑ
‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য সাধারণ নাম। দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত বেগম আর এস হোসেন বাংলার অধঃপতিতা নারী সমাজকে মুক্তির সত্য সুন্দর পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে ত্যাগের একটি উজ্জ্বল আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ কেবল সমাজ সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল নাÑ বরং তাঁর চেতনার বিমুর্থ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই সাহিত্য সাধনার মধ্যেও। চিন্তার গভীরতায় এবং সৃষ্টির প্রসারতায় তাঁর প্রতিটি রচনা আমাদের জাতীয় জীবনে সুদুরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। এদিক থেকে তাঁর সমগ্র রচনার নব মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না।”
বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন সৎ, নিষ্ঠা, চরিত্রবান, ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসী, সমাজ সংস্কারক। তিনি ছিলেন ইসলামের সঠিক মুল্যবোধের বাস্তবায়নের সত্যিকার সৈনিক। তিনি ব্যক্তি জীবনেও পর্দার সঙ্গে জীবনযাপন করতেন। তাঁর যে ছবি আমরা পত্র-পত্রিকায় পুস্তকে দেখতে পাই তা তাঁর অন্দরমহলের ছবি। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ মতিচুর প্রথম খন্ডে ‘বোরকা’ শিরোনামে নিবন্ধে বলেন,
“কেহ কেহ বোরকা ভারী বলিয়া আপত্তি করেন। কিন্তু তুলনায় দেখা গিয়েছে ইংরেজ মহিলাদের প্রকান্ড প্রকান্ড হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বোরকা অতি ভারী নহে।
পর্দা অর্থ তো আমরা বুঝি গোপন করা বা হওয়া, শরীর ঢাকা ইত্যাদিÑ কেবল অন্তঃপুরের চারি-প্রাচীরের ভিতর থাকা নহে। এবং ভালমতে শরীর আবৃত না করাকেই ‘বে-পদা’ বলি। যাঁহারা ঘরের ভিতর চাকরদের, সম্মুখে অর্ধ নগ্ন অবস্থায় থাকেন, তাঁহাদের অপেক্ষা যাঁহারা ভালমতে পোশাক পরিয়া মাঠে বাজারে বাহির হন, তাঁহাদের পর্দা বেশি রক্ষা পায়।”
বেগম রোকেয়ার বিখ্যাত উপন্যাস ইংরেজীতে প্রথম ঝঁষঃধহং উৎবধসনামে ১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনের বছরে ওহফরধহং খধফরবং গধমধুরহবএ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাািটর সম্পাদক ছিলেন কমলা সাতকিয়া নাথান এবং সরোজিনী নাইডু। ১৯০৮ সালে গ্রন্থ আকারে ঝঁষঃধহং উৎবধসপ্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি উক্ত গ্রন্থ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থমতিচুর দ্বিতীয় খন্ডে ‘সুলতার স্বপ্ন’ স্থান পেয়েছে।
‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থ সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক, কথা সাহিত্যিক আবুল হুসেন বলেন,
“পুরুষের পশুশক্তিকে দমন করিয়া নারীর আভ্যন্তরীণ ঐশী শক্তিকে প্রখতর করিতে পারিলে এই দুনিয়াতে যে স্বর্গ সুষমা রচনা করা যায়, তাহাই এই স্বপ্নের অর্থ বলিয়া আমার বিশ্বাস। ভগিনী সারার খধফু ষধহফএ কোনো কুৎসিত আচরণ ও নীতিবিগাহি কর্ম কেহ করিতে পারে না। সেখানে পুলিশ নাই। সে একবারে সত্য ও ভালবাসার রাজ্য। বস্তুত:, নারী জাতি সত্য ও ভালবাসার সাক্ষাৎ প্রতিমা স্বরূপ হইতে পারেন, যদি তাঁহাদের মন ও মস্তিষ্কের যাবতীয় শক্তিকে সম্পূর্ণ সুযোগ প্রকাশে স্ফুর্তি লাভ করিতে দেয়া হয়। তাহা হইলে আমাদের নারী জাতি পুরুষের পার্শ্বে নন্দনকানন ও ঐ খধফু খধহফ-এর পরিজাতে ‘বাগ’ প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে।
পুস্তিকাখানি যেরূপ সুমার্জিত বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় লেখা, সেরূপ ভাষা আয়ত্ত করা আমাদের অনেক ইংরেজি শিক্ষিত যুবকের পক্ষে কঠিন।”
১৯২২ সালে বেগম রোকেয়ার বিখ্যাত গ্রন্থ মতিচুর দ্বিতীয় খন্ড ১০ই মার্চ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে লেখিকা নুর ইসলাম, সৌরজগৎ, সুলতানার স্বপ্ন, ডেলিশিয়া হত্যা, জ্ঞানফল,নারী সৃষ্টি, নার্স নেলী, শিশু পালন, মুক্তিফল, সৃষ্টি তত্ত¡ শিরোনামে লিখেছেন। গ্রন্থটির নুর ইসলাম শিরোনামে বেগম রোকেয়া বলেন
“প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণ সমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে ধর্ম, ধর্ম ব্যতিরেকে মানুষ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিম্বা সভ্যতা লাভ করিতে পারে না। যে দেশের সমুদয় অধিবাসী একই ধর্মাবলম্বী, যে দেশে সকলে একইভাবে একই ঈশ্বরের পূজা করেÑ তাঁহাকে সকলে একই নামে ডাকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির মনোভাব একই সূত্রে কথিত থাকে, সে দেশে অত্যন্ত সৌভাগ্যশালী সন্দেহ নাই।”
বেগম রোকেয়ার একনিষ্ঠ সাধন ও চিন্তাশীলতা এই বইটির প্রতিছত্রকে গৌরব দান করিয়াছে। গ্রন্থটি পড়লে বুঝা যায়, লেখিকা আত্মযশ-নিস্পায় প্রণোদিত হইয়া লেখনি ধারণ করেন নাই। পক্ষান্তরে ভূয়োদর্শনের ফলে তাঁর হৃদয় ও বেদনার যে সুর বাজিয়া উঠিয়াছে তাহাকে তিনি নানা কথায়, নানা ঢঙে তুলিয়া ধরিয়াছেন। যেখানে অনুভুতির গভীরতা বেশি ও চিন্তা প্রবাহের বিপুলতা অধিক সেখানে লঘুভাব ভাল খেলিতে পারে না, ইহা স্বাভাবিক নিয়ম। যেখানে ব্যথার সুর বাজাইয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছেন সেখানে তিনি দক্ষ কলমে লিখিয়াছেন। গ্রন্থের ভাষা অতি সুন্দর ও সরস। গ্রন্থটির মধ্যে ‘শিশু পালন’ একটি সুন্দর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। প্রত্যেক নারী ্ই প্রবন্ধটি পাঠ করা উচিত। চমৎকার বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অনুকরণীয়।
১৯২৪ সালে বেগম রোকেয়ার বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’ প্রকাশিত হয়। বইটি উৎসর্গ করেছেন বড় ভাই আবুল আসাদ ইব্রাহিম সাবেরকে। লেখিকা এই ক্ষেত্রে বড় ভাই সম্পর্কে বেশ সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “জননী সময়ে সময়ে শাসন করিয়াছেন, তুমি কখনও শাসন কর নাই। যাই মাতৃস্নেহের কোমলতা ও তোমাতেই অনুভব করিয়াছি।”
‘পদ্মরাগ’ গ্রন্থের ভুমিকা লেখার জন্য বেগম রোকেয়া তখনকার কলিকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক বিনয় ভূষণ সরকারকে অনুরোধ করেন। তিনি ছোট একটি রচনা ভুমিকা হিসাবে লিখে দেন। কিছু অংশ উদ্ধৃত করলামÑ
“উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সম্বন্ধে কোন রায় প্রকাশ করিব না- পাঠকগণ নিজের নিজের হৃদয়ের কষ্ঠিপাথরে তাহাদের যাচাই করিয়া লইবেন। একই চন্দ্র যোগীর হৃদয়ে, কবির হৃদয়ে, বৈজ্ঞানিকের হৃদয়েও প্রেমিকের হৃদয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাব উদ্বোধিত করিয়া তুলে। আলো ছায়ার ভিত্তির বিভিন্নতায় ছবির পার্থক্য হইয়া দাঁড়ায়। অনেক সময় গ্রন্থকারের নিজের ভাবও সুযোগ্য পাঠকের মধুর প্রাণের রঙে বিচিত্র শোভায় উজ্জ্বলতররূপে প্রস্ফুটিত হইয়া উঠে। ইহাই বাঞ্ছনীয়Ñ এই ক্ষেত্রে অনুশাসন সুফল প্রসূহ নহে।”
১৯৩০ সালে বেগম রোকেয়ার জন্য স্মরণীয় ঘটনা। ঐ বছর তাঁর স্বপ্নের স্কুল শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল দশম শ্রেণি পর্যন্ত পূর্ণ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। পরবর্তী বছর তথা ১৯৩১ সালে বেগম রোকেয়ার অন্যতম উপন্যাস ‘অবরোধবাসিনী’ কলিকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। একই বছর তাঁর ছোট বোন হোমায়রা তোফাজ্জল হোসেনের মেয়ে নুর উম্মেদের অকাল মৃত্যু ১৮ই এপ্রিল ঘটে। তাতে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। মর্মাহত বেগম রোকেয়া পয়ারছন্দে চৌপদী শোকগাথা রচনা করেন-
‘বলে গেল নুর উম্মেদ যাবার বেলায়
ভুল করে এসেছিনু এ ঘর ধরায়
ভাঙ্গিয়াছে ভুল আজি দাও মা বিদায়
ক্ষম মম ভ্রম আজি যে আছ যেথায়।”
‘অবরোধ বাসিনী’ উপন্যাসে লেখিকা তাঁহার চারিপাশের যে সমাজ অবরোধ বন্দিনী নিগৃহীতা নারী সমাজ, তাহারই অজ্ঞানতা ও নির্জীবনতার বেদনা তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। কবি, সাহিত্যিক, আবদুল কাদির ‘বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কীর্তি’ শিরোনামে অবরোধ বাসিনী উপন্যাস সম্পর্কে বলেনÑ
“তাঁর ‘অবরোধ বাসিনী’ গ্রন্থে ৪৭টি অবরোধ সম্পর্কিত দুর্ঘটনার উপাদেয় কাহিনী আছে অতুনলীয় শ্লেষ ও লিপিকুশলতার সঙ্গে তিনি সেগুলি বর্ণনা করিয়াছেন। বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে নারী ঐঁসড়ঁৎরংঃবিরল, সেদিক দিয়ে ‘অবরোধ বাসিনী’ উল্লেখনীয়। কিন্তু নিশ্চয়ই। তিনি পর্দা চাহিয়াছেন, কিন্তু তিনি বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন নাই, বলিয়াছেন ‘ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে। তাঁর মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দমতার চাইতে এই যে সংযম ও মমত্ববোদের প্রাচুর্য্য তার মুলে রহিয়াছে তাঁর নারী প্রকৃতি।”
বেগম রোকেয়ার গ্রন্থ সংখ্যা বেশ কম। কিন্তু যা প্রকাশিত তা আলোড়ন সৃষ্টিকারী। সকলের সুপাঠ্য। নারী জাগরণের ব্যক্তিত্ব তিনি। তার চিঠিপত্র, বক্তৃতা, লেখা সকল কিছুর মূল লক্ষ্য ছিল নারী সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, শিক্ষিত হতে হবে, সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে হবে। নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হবে। নারী জাতির সমাজের রাষ্ট্রের অর্ধেক। নারী উন্নয়ন, নারীর অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব নয়Ñতাই তিনি বিশ্বাস করতেন।
তাই বেগম রোকেয়ার লেখার চেয়ে রোকেয়া জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখার সংখ্যা বাংলা সাহিত্যে অধিক। তাঁর কর্মময় জীবনের উপর লেখা নারী জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। স্বাধীন বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার কর্মকাÐের সাহিত্যের প্রভাব অনেক বেশি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম ‘রোকেয়া হল’ নামকরণ করা হয়। ১৯০০ সালে বাংলাদেশ সরকার ৯ই ডিসেম্বরকে রোকেযা জন্মশতবার্ষিকী পালনের মাধ্যমে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
বেগম রোকেয়ার আর্দশের প্রচার, অনুসরনের জন্য বাংলাদেশ সরকার বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ৯ই ডিসেম্বরকে বেগম রোকেয়া ডে হিসাবে পালন করা হয়। ‘বেগম রোকেয়া পদক’ ১৯৯৫ সাল থেকে চালু করা হয়। বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল সেন্টার গঠন করা হয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঢাকায় ‘বেগম রোকেয়া সড়ক’ নামকরণ করা হয়। ১৯৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিন বার ‘বেগম রোকেযা রচনাবলী’ বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশ করা হয়। ১৯৩১ সালে বৃটিশ ভারত শাসন আমলে ঊফঁপধঃরড়হ রফবধষং ঃড় ঃযব গড়ফবৎহ ওহফরধহ এরৎষ এবং ১৯৩৭ সালে এড়ফ মরাবং গধহ জড়নংপ্রবন্ধ বইটি সাড়া ভারতবর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করে তিনি আজও আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন।
আজ পর্যন্ত কোন নারী বেগম রোকেয়ার মত সাহিত্যে, কর্মে, আদর্শে ভারত ও বাংলাদেশ অনুপ্রেরণার জ্যোতি হিসাবে উদিত হয়নি। তিনি অমর, আদর্শ, অনুকরণীয় নারী জাতির প্রেরণার সকল উৎস।
বেগম রোকেয়ার ‘পিপাসা’ প্রবন্ধের শুরুতে কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করে এই মহিয়সী নারীর সম্পর্কে ক্ষুদ্র লেখাটির সমাপ্তি টানছি-
কাল বলেছিলে প্রিয়! আমারে বিদায়
দিবে, কিন্তু নিলে আজ আপনি বিদায়!
দুঃখ শুধু এই ছেড়ে গেলে অভাগায়
ডুবাইয়া চিরতরে চির পিপাসায়!
যখন যেদিকে চাই, কেবলি দেখিতে পাই,
“পিপাসা পিপাসা” লেখা জ্বলন্ত ভাষায়।
শ্রবণে কে যেন ঐ ‘পিপাসা’ বাজায়।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।