আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পখাতের বড় বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও কানাডা। জাপান জার্মানী, অস্ট্রেলিয়াতে তৈরি পোশাক শিল্পের সীমিত পরিমাণ বাজার রয়েছে। চীন ও ভারতে আমাদের বাজার খুবই কম। তবে ইউরোপের প্রায় সকল দেশেই আমার পোশাক রপ্তানি হয়।
কিন্তু আরব দেশ সম্বন্ধে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার খুবই সামান্য। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে দামী পোশাকের চাহিদা অনেক বেশি। আমরা কম দামী পোশাক তৈরি করি এবং রপ্তানি করি। তবে আরব আমিরাত (ইউএই) ও সৌদি আরবে আমাদের দেশ থেকে কিছু কিছু সস্তা মূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) মধ্যপ্রাচ্যের একটি ধনি দেশ। এই দেশে মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ৪৩ হাজার মার্কিন ডলারের অধিক। সৌদি আরবে মাথা পিছু আয় ২০ বাজার ১১০ ডলার। কুয়েতে মাথা পিছু আয় ৩২ হাজার ৩৭৩ ডলার, কাতারে ৫০ হাজার ৮০৫ ডলার, বাহরাইনে ২৩ হাজার ৪৪৩ ডলার, ওমানে ১৫ হাজার ১২৭ ডলার। উল্লিখিত মাথা পিছু অধিক আয় সম্পন্ন দেশসমূহে তৈরি পোশাক শিল্পের বেশ চাহিদা রয়েছে। তাও দামি পোশাকের চাহিদা। এ রকম মাথা পিছু আয়ই বলে দিচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় সহযোগিতা জোটের (জিসিসি) তালিকাভুক্ত এই ছয়টি তেল সমৃদ্ধ দেশে তৈরি পোশাকের বড় বাজার রয়েছে। কিন্তু বাজারটিতে বাংলাদেশের হিস্যা একেবারেই অতি তলানিতে রয়েছে।
জিসিসিভুক্ত দেশগুলো ২০২০-২১ অর্থবছরে অন্তত এক হাজার কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। বাংলাদেশী মূল্যে তার পরিমাণ হচ্ছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। সেখানে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ৩৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন হাজার কোটি টাকা। উক্ত রপ্তানির মধ্যে ১৮ কোটি ৮২ লক্ষ ডলার নিট পোশাক এবং ১৭ কোটি ৯২ লক্ষ ডলারের ওভেন পোশাক।
মধ্যপ্রাচ্যের বাজার সাধারণত দামি পোশাকের। মূলত চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) ও সৌদি আরবে তুলনামূলকভাবে সস্তা পোশাক রপ্তানি হয়। সৌদি আরবে অনেক বাঙালী থাকেন, তাদের প্রয়োজনে আমাদের পোশাক রপ্তানি। প্রকৃত সৌদি নাগরিকদের জন্য এখনও আমাদের পোশাক রপ্তানি খুবই সীমিত। তাছাড়া রপ্তানির বড় অংশ স্টকলট পণ্য। তবে জিসিসির বাজার খুবই সম্ভাবনাময়। দীর্ঘ ৫০ বছরে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে পোশাক রপ্তানির কোন বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ইউরোপ, আমেরিকা কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশের রপ্তানি ভাল থাকার কারণে আমাদের দেশের পোশাক রপ্তানিকারকগণ উক্ত দেশসমূহে বিপণনের কোন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেনি। তবে এখন সময় এসেছে, চিন্তা করার। তবে বিশ্বের অন্যান্য বাজারের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে জিসিসিভুক্ত দেশের পণ্য কিছুটা ভিন্ন। এখানে জোব্বা আল খাল্লার মতো পোশাক বেশি চলে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে কি ধরনের পোশাক পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সেইটি আমদের খুঁজে বের করতে হবে নতুন করে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এই সকল দেশে পোশাক রপ্তানিকারকদের ও ইপিবিকে পর্যবেক্ষনের জন্য এই সকল দেশে নিবিড় ভ্রমণের প্রয়োজন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী করোনা মহামারির মধ্যেও বিগত ৩০ জুন ২১ শেষ হওয়া ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩ হাজার ১৫৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় তার আগের ২০১৯-২০ অর্থ বছরের ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলারের চেয়ে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে মোট পোশাক রপ্তানির ৬১ দশমিক ৭৭ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ), ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে, ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ কানাডায় এবং ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ নতুন বাজারে গেছে।
বাংলাদেশী পোশাকের বৃহত্তম বাজার ইইউ থেকে জিসিসির বাজারে পোশাক রপ্তানি হয়। পরিমাণ ও একেবারে কম নয়। গত বছর ২০২০ সালে ইইউ থেকে সৌদি আরবে ২৫ কোটি ইউরোর পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল ৩৯ কোটি ইউরোর পোশাক। এ ছাড়া গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ইউএইতে ৩৮ কোটি, কাতারে ১০ কোটি, বাহরাইনে ৯ কোটি ও ওমানের ৬২ লক্ষ ইউরোর পোশাক রপ্তানি করে ইইউভুক্ত দেশগুলো।
২০২০-২১ অর্থ বছরে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৪৩৯ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশ ছিল দশমিক ১৪ শতাংশ বা ২২ কোটি ৫৯ লক্ষ ডলার। একই অর্থবছরে সৌদি আরবের ৩০২ কোটি ডলারের পোশাক আমদানির মধ্যে বাংলাদেশের অংশ মাত্র দশমিক ২৪ শতাংশ বা ১২ কোটি ৮০ লক্ষ ডলার।
অবশ্য ইউএই কিংবা সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক বেশি। গত অর্থবছরে ইউএই থেকে ৭২ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ২৯ কোটি ডলারের। এর মধ্যে পোশাক ছিল ২২ কোটি ডলার। সৌদি আরব থেকে ১০৯ কোটি ডলারের আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ২৬ কোটি ডলার। এর অর্ধেকই পোশাক।
এখন প্রয়োজন : অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে জিসিসিই জোটভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি ভাল বাজার হতে পারে। তবে এ সকল দেশে আমাদের তৈরি পোশাকের ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোগক্তাদের উক্ত দেশে প্রচুর বাণিজ্যিক ভ্রমণ করতে হবে। আমাদের কমার্শিয়াল কাউন্সিলারদের এই জন্য বেশ কাজ করতে হবে। তাদের দৈনিক কাজের মধ্যে তৈরি পোশাক বাণিজ্য করার জন্য একটা সময় ব্যয় করতে হবে। ঐ সকল দেশে পোশাকের নিয়মিত প্রদর্শনী করতে হবে। বিদেশে আমাদের দেশের তৈরি পোশাকের ঝমকালো মেলার আয়োজন করতে হবে। এই আয়োজন হতে হবে নিয়মিত।
এই ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এই সকল দেশে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য তথা নতুন বাজার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকার ১০ শতাংশ হরে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদানের একটি স্কিম চালু করতে পারে। তাতে উৎসাহী হয়ে তৈরি পোশাকের রপ্তানি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত প্রসার লাভ করবে।
তৃতীয়ত দেশে ছোট বড় তৈরি পোশাক শিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সকল কারখানা নিজে নিজে রপ্তানি আদেশ গ্রহণ করতে পারে না। অন্যের উপর নির্ভর করে অধিকাংশ পোশাক শিল্প রপ্তানি আদেশ গ্রহণ করে থাকে। তাতে লাভেরর সঙ্গের একটি কমিশন পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়। এই কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করে সরসারি রপ্তানি আদেশ লাভের জন্য সরকারের প্রতিষ্ঠান ইপিবিকে ভূমিকা পালন করা উচিত। এই জন্য ইপিবিকে তার বাণিজ্যিক শাখাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সকল দেশের আমাদের কূটনৈতিক অফিসকে বাণিজ্যিক অফিসে রূপান্তর করতে হবে। এই সকল অফিসে বাণিজ্যিক কর্মকর্তাকে শুধু মাত্র তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ লাভের জন্য নিয়মিত, পরিকল্পিত কাজ করতে হবে। আর আমাদের বিজিএমইকে নিয়মিত এই সকল কূটনৈতিক অফিসের বাণিজ্যিক দায়িত্ব থাকা কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতে হবে। বিজিএমই অফিসে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য দুই জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।