Sheikh Saadi

আল্লামা শেখ সা’দী (রঃ) : আধ্যাত্মিক জগতের মহাপুরুষ

গগনের উদারতা ও স্বর্গেও শান্তির বাণী নিয়ে সময় সময় যে যে সবল মহাপুরুষ মর্ত্যরে দ্বারে আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং জগতের কিঞ্চিত যথার্থ কল্যাণ সাধন দ্বারা মানুষের স্মৃতিপটে অক্ষয় পদচিহ্ন রেখে যান, শেখ সা’দী (রঃ) তাঁদের মধ্যে অন্যতম।


বিশ্ববিখ্যাত তাঁর ভ্রমণ কাহিনী তিনি তাঁর গুলিস্তা ও বোস্তা সকল পাঠকের অতিপ্রিয়। গুলিস্তায় তিনি লিখেছেন:
“দও আফসায়ে আলম বগাশতাম ব’সে,
বসর বোরদাম আ’য়াসে বহর কা’সে,
তামাত্তায়া যে হরলোশা ইয়াফতাম,
যে হর খিরমানে খোশা ইয়াফতাম।”
অর্থাৎ
“ভ্রমিয়াহি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রদেশ,
মিলিয়াছি সর্বদেশে সবাকার সনে,
প্রতি স্থানে জ্ঞানে রেণু করি আহরণ,
প্রতি মৌসুমে শস্য করেছি ছেদন। ”


স্যার আউসরী এর মতে ১১৭৫ খৃষ্টাব্দে পারস্যের ফারেস প্রদেশের সিরাজ নগরে আল্লামা শেখ সাদী (রঃ) জন্মগ্রহণ করেন। আয়ু ছিল ১২০ বছর। তবে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু সাল নিয়ে নানা মত রয়েছে। কারো কারো মতে তাঁর জন্ম সাল ১১৯৩ এবং আয়ু ১০২ বছর। তবে মুজাফফর উদ্দীন আতাবেক সা’দ বিন জঙ্গির রাজত্বকালে যে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাতে কোনো দ্বিমত নাই।


বাল্যকালে তাঁর নাম ছিল শেখ মোসলেহ উদ্দীন। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ফারেসের শাসনকর্তা আতাবেক সা’দ বিন জঙ্গির রাজত্বকালে তিনি যখন কবিতা লিখতেন তখন আপন নামের সঙ্গে ‘সাদ’ লিখতেন এবং এ নামেই তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। সা’দীর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ সিরাজী (রহঃ)। তিনি সিরাজের তৎকালীন বাদশাহ শায়াখ সা’দ জঙ্গি রহঃ এর অধীনে চাকরি করতেন। তাঁর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল বেশ ঘনিষ্ঠ। তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন। ফলে শৈশবকাল থেকে সা’দী ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে গড়ে ওঠেন। কোন অসৎ সঙ্গ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। শৈশবেই তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় অসাধারণ প্রতিভা। শিক্ষালাভের জন্য তার ছিল অস্বাভাবিক আগ্রহ।


কিন্তু শৈশবেই সা’দীর পিতা ইন্তেকাল করেন। তিনি এতিম ও অসহায় হয়ে পড়েন। পিতার আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর তিনি সিরাজনগরে গজদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি সিরাজনগর থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের ইচ্ছায় বাগদাদে চলে যান। বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসা ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শেখ সা’দী বাগদাদে এসে অনাহারে-অর্ধাহারে এবং আশ্রয়ের অভাবে দিনের পর দিন পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহযোগিতায় স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষা লাভ শুরু করেন। তাঁর প্রতিভা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং শিক্ষা লাভে তার অসাধারণ পরিশ্রমের প্রেক্ষিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর প্রতি শিক্ষকদের সুদৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এরপর তিনি বাগদাদে নিযামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষা লাভ শুরু করেন। তাঁর প্রতিভা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং শিক্ষা লাভে অসাধারণ পরিশ্রমের প্রেক্ষিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর প্রতি শিক্ষকদের সুদৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এরপর তিনি বাগদাদ নিযামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিখ্যাত আলেম আল্লামা আবুল ফাতাহ ইবনে জওজী (রঃ) এর নিকট তফসির, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করেন। অতি অল্পদিনের মধ্যে তিনি মাদ্রাসার সেরা ছাত্রে পরিগণিত হন এবং মাসিক বৃত্তি লাভ করেন।


মাত্র ৩০ বছর বয়সে শেখ সা’দী তফসির, হাদিস, ফিকাহ, সাহিত্য, দর্শন, খোদাতত্ত্ব ও ইসলামের বিবিধ বিষয়ে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-লাভে সন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের প্রতিও তাঁর অনেক বেশী আগ্রহ ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, শেখ সা’দীর জন্মের ১০ বছর পূর্বে ১১৬৫ খ্রষ্টাব্দে, হিজরি ৫৬১ পৃথিবীর বিখ্যাত জ্ঞানতাপস শেখ আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁর অলৌকিক জ্ঞান প্রভাবের কথা সমগ্র বিশ্ব জানে। শেখ সা’দী (রঃ) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের পর অবসর সময়ে এই সকল জ্ঞানী পুরুষের আশ্রমে গিয়ে অতীন্দ্রয় জগতের তথ্য সংগ্রহ করতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি তৎকালীন জ্ঞান তাপস শেখ শাহাবুদ্দিন (রঃ) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই জ্ঞান তাপসের সঙ্গ লাভ করে অতিদ্রæত তিনি ধর্মগত প্রাণ তত্ত¡জ্ঞান ও পুণ্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন।


সুদীর্ঘ ৩০ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের পর তিনি শুরু করেন ভ্রমণ জীবন। তখনকার সময় দেশ ভ্রমণ অতি কঠিন ছল। ছিল না এখনকার মতো উড়োজাহাজ, ট্রেন, বাস প্রভৃতি। পদব্রজে অধিকাংশ সময় ভ্রমণ করতে হতো। কোথাও কোথাও উট, ঘোড়ার সাহায্য ছাড়া অন্য কোনো বাহন ছিল না বললে চলে।


স্যার আউসরী’র মতে দ্রাব্য জগতে সুবিখ্যাত ইবনে বতুতার পরে পরিব্রাজক হিসেবে যার নাম সবার শীর্ষে তিনি হবে শেখ সা’দী (রঃ)। তিনি সমগ্র পারস্য, এশিয়া মাইনর, আরবভূমি, সিরিয়া, মিশর, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্থান, ফিলিপাইন, ইরাক, কাশগড়, হাবস, ইয়ামন, শ্যাম, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, হিন্দুস্থানের সোমনাথ ও দিল্লিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। এই সুদীর্ঘ সফরের ফলে তিনি বিশ্বের ১৮টি ভাষার পাণ্ডিত্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি পদব্রজে ১৪ বার হজ সম্পাদন করেছেন। তার এই সুন্দর অথচ কঠিন ভ্রমণ কাহিনী গুলিস্তা ও বোস্তা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।


তিনি ভ্রমণ সম্পর্কেও তার নানা দিক নিয়ে গুলিস্তায় লিখেছেন। তবে গ্রন্থের শুরুতে বলেন:
“বালাগাল্ উলা বি কামালিহী,
কাশাপাদ দুজা বি জামালিহী।
হাছুনাত জামিউ খেছোয়ালিহী,
ছল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।”
অর্থ: হযরত শেখ সা’দী (রঃ) বলেন, তাঁর অনুপম চরিত্রের পরিপূর্ণতায় সম্মানের উঁচু আসনে তিনি উপনীত হয়েছেন এবং তাঁর সৌন্দর্যের আলো বিকশিত হয়ে পড়েছে।


তাই তাঁর সমস্ত বৈশিষ্ট্যই প্রশংসনীয়। অতএব, সকলে তাঁর ওপর দরুদ পাঠ করুন এবং তার পরিবার-পরিজনের জন্য আল্লাহর নিকট রহমত কামনা করুন।


বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে শেখ সা’দী (রঃ) অর্জন করেছিলেন বিবিধ জ্ঞান। তাঁর চোখের সামনে ঘটেছিল নানা ঘটন, তিনি অবলোকন করেছিলেন জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস। সা’দী (রঃ) নিজ চোখে দেখেছিলেন দুর্ভিক্ষের হাহাজার। মিশর ও পারস্যের দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ হানিতে তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল। ১২৫৮ সালে হালাকু খান এক বিরাট তাতার বাহিনী নিয়ে বাগদাদ আক্রমণ করেছিল। তাদের আক্রমণে ইসলামের শেষ খলিফা মোতাসেম বিল্লাহ নির্মমভাবে নিহত হন। বাগদাদ তাদের আক্রমণে এক মহাশ্মশানে পরিণত হয়। ইবনে খালদুন লিখেছেন, বিশ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ষোল লক্ষ লোক এ আক্রমণে নিহত হয়েছিল। শেখ সা’দী (রঃ) গুলিস্তার প্রথম অধ্যায়ে এ সকল জালেমদের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী পরিচালনা করেন। তাঁর পুরো কাব্য গ্রন্থেও ভেতরই জালেম বাদশাহ্ও উপর তাঁর শ্লেষ বাক্য ও অবজ্ঞার চিহ্ন বিচ্ছুরিত দেখতে পাওয়া যায়।
“নিমে নানে র্গ খোরদ র্মদ খোদা,
বজলে বরদেশাঁ কুনাদ্ নিমে দিগার।
মুলকে একলিমে বগিরাদ বাদশাহ’
হামচুঁনা দর বন্দে এক নিমে দিগার। ”
অর্থ হচ্ছে:
যদি কোনো দরবেশ অর্ধেক রুটি খায়, তবে বাকী
অর্ধেক আবার অন্যকে দান করে। আর যদি কোনো
বাদশাহ একটি রাজ্য দখল করে, তদুপরি সে ঐ রকম
আর একটা রাজ্য দখলের চিন্তায় মত্ত থাকে।


শেখ সা’দী (রঃ) জীবনকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ৩০ বছর শিক্ষা লাভ, দ্বিতীয় ৩০ বছর দেশ ভ্রমণ, তৃতীয় ৩০ বছর গ্রন্থ রচনা এবং চতুর্থ ৩০ বছর আধ্যাত্মিক চিন্তা ও সাধনা।


শেখ শা’দী (রঃ) প্রথম যখন কবিতা রচনায় মনোযোগ দেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর। তিনি পরবর্তী জীবনে বহু কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর এ সকল কাব্যে রয়েছে মানুষের নৈতিক ও চরিত্র গঠনে অমূল্য বাণী। শেখ সাদীর অলঙ্কারময় ভাষা ও প্রকাশে যাদু পাঠকদের মনকে বিস্ময় বিমুগ্ধ করে রাখত।


শেখ শা’দীর কাব্যের সুর, ভাষা, লহড়ি আজও মানুষকে মুগ্ধ করে। গুলিস্তা ও বোস্তায় যেমন তিনি লেখেন: নানা উপদেশমূলক লেখা। যেমন:
‘গর গুজান্দাত রছদ তাহাম্মুল কুন,
কে যআফু আজ গুনাহ পাক শবি,
আয় বেরাদরে চু আকেবাত খাকাস্ত
খাক শো পেশে আজাঁকে খাক শবি।’
অর্থ হচ্ছে:
যদি কেউ তোমাকে কষ্ট দেয়, তবে তুমি তা
নিজ গুণে সহ্য করবে। কেননা, তাকে ক্ষমা
করে দিলে, তোমার গুনাহ হতে পাক হবে।
হে ভাই, যখন শেষ পরিণাম মাটি, তাহলে
মাটির খাদ্য হওয়ার পূর্বে মাটি হয়ে যাও।


আজও তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ কারিমা, গুলিস্তা ও বোস্তা বিশ্বের বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসায় পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা পবিত্র কোরআন শিক্ষার পরই তাঁর রচিত কাব্য কারিমা, গুলিস্তা ও বোস্তা শিক্ষা লাভ করে থাকে। তাঁর সকল রচনা অতি সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত। আলেম সমাজ বিভিন্ন বক্তব্যে ও ওয়াজমাহফিলে শেখ সা’দীর কবিতা আবৃত্তি করে থাকেন। তাঁর কবিতা ছাড়া ওয়াজ মাহফিল কোনোভাবেই জমে না। শিশুরা অতি সুললিত কণ্ঠে শেখ সা’দীর কারিমা কাব্যগ্রন্থ থেকে পাঠ করতে থাকে-
‘কারিমা ব-বখশায়ে বর হালে মা
কে হান্তম আসীরে কামান্দে হাওয়া।
না দারেম গায়ের অযতু ফরিয়াদ রাস্
তু-য়ী আসীয়াঁরা খাতা বখশ ও বাস।
নেগাদার মা’রা যে রাহে খাতা
খাতা দার গোযার ও সওয়াযম নমা।’
অর্থ হচ্ছে:
হে দয়াময় প্রভু! আমার প্রতি রহম কর। আমি কামনা
ও বাসনার শিবিরে বন্দী। তুমি ব্যতীত আর কেউ
নেই, যার নিকট আমি প্রার্থনা করব। তুমি ব্যতীত
আর কেউ ক্ষমাকারী নেই। তুমি আমাকে পাপ থেকে
রক্ষা কর। আমার কৃত পাপ ক্ষমা করে পুণ্যের পথ প্রদর্শন কর।


শেখ সা’দী গুলিস্তা ও বোস্তা বিশ্ব কাব্য ও সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। গুলিস্তা ও বোস্ত ব্যতীত বিশ্বে এমন গ্রন্থ খুব কমই আছে যা বহু যুগ ধরে বিপুলভাবে পঠিত হয়ে আসছে।


১৬৫১ সালে জেল্টায়াস নামক এক ব্যক্তি ল্যাটিন ভাষায় আমষ্টারডাম নগরে ‘ ‘রোসারিয়াম পলিটিকান’ নাম দিয়ে গুলিস্তার অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১৭৪৭ সালে এটি প্রথম ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। বর্তমান ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শেখ সা’দীর গুলিস্তাসহ অন্য গ্রন্থ ইংরেজি, ফরাসি জার্মান, আরবি, ডাচ, উর্দু, তুর্কি, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে।


শেখ সা’দী (রঃ) উল্লেখিত গ্রন্থসমূহছাড়া নসিহত অল মলুক, রিসাল্লায়ে আশকিয়ানো, কিতাবে মিরাসী, মোজালেসে খামসা, তরজিয়াত, রিসালায়ে সাহেবে দিউয়ান, কাসায়েদল আরবী, আৎ তবিয়াত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
মহান সাধক, জ্ঞানী, প্রকৃত ইমানদার ব্যক্তি শেখ শা’দী সব সময় আল্লাহ পাকের ভয়ে অস্থির থাকতেন। আল্লাহ পাকের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও আমল ছিল অচিন্তনীয়। আল্লাহ পাকের দেওয়া সামান্য সম্পদে তিনি থাকতেন অধিকতর সন্তষ্ট। লোভ-লালসা, সম্পদ, আরাম-আয়েশ কোনো কিছুই তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারে নাই। দুনিয়ার সুখ-শান্তিকে তিনি প্রকৃত শান্তি মনে করতে না। তাই তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন:
‘খোদারা নাদানাস্ত ও ত্বয়াত্ না করদ,
কে বরবখতে রুজী কানায়াত না কারদ।
কানায়াত তাওয়াঙ্গার কুনাদ্ মরদেরা
খবর কুন্ হারিছে জাহাঁ গে’রদেরা।’
অর্থ হচ্ছে:-
শেখ সা’দী (রঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর দেওয়া রিযিকের ওপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে না, সে আল্লাহকে চেনে না এবং তাঁর ইবাদত বন্দেগিও করে না। অল্পতে সন্তুষ্ট প্রকাশ করলে আল্লাহ তাঁকে আমীর করে দেন। তুমি তালাশ করে জেনে নাও, যারা লোভে পড়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়, তারা কখনোও শান্তি লাভ করতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন,
‘হে অশান্ত মানুষ। স্থির হও। গড়ান পাথরের ওপর কখনও ঘাস হয় না।
যদি তুমি জ্ঞানী ও চালাক হও, তবে শরীর পূজারী হয়ো না; যতই তাকে আদর-যতœ করবে ততই ধ্বংস হবে।
জ্ঞানীরা নিপুণ হয়, শরীর পূজারী অজ্ঞান হয়। খাওয়া ও নিদ্রা পশুর কাজ। ঐভাবে জীবনযাপন করা বোকার লক্ষণ। আল্লাহ্র মারেফতের সম্বল অর্জন কর। যাদের নিকট আল্লাহর সত্য প্রশংসা প্রকাশ পেয়েছে, তারা অসত্য পছন্দ করে না। যে ব্যক্তি আলো এবং অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না, তার নিকট ভ‚ত এবং হুরের চেহারা একরকমই মনে হয়।’


শেখ শা’দী (রঃ) পারিবারিক জীবন সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত জানার সুযোগ আমার কম হয়েছে। জ্ঞান তাপস এই দুনিয়া বিমুখ আধ্যাত্মিক ব্যক্তি শেখ সা’দী জীবনে দুইবার বিয়ে করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি তাকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। পুত্রটি কৈশোর বয়সে হঠাৎ মারা যায়। কন্যাটি তাঁর বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।


সুসাহিত্য সমাজ পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার। এ বাক্যমুখের বুলি হিসেবে ব্যবহার করলেও সাহিত্য থেকে সমাজ উপকৃত হোক; চরিত্র সংশোধন করুক, নীতিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করুক এটা কেউ আমলে নিচ্ছে না। অযথা নারী-পুরুষের অশ্লীল প্রেমলীলা আর মনের পরিতৃপ্তি মেটানোর মতো বিষয়গুলোই সাহিত্যের মূল ধারায় রূপান্তরিত হতে চলেছে।
আজ সমাজের তরুণ-তরুণীরা খুঁজে পায় না সৎ চরিত্র গঠনমূলক নীতিজ্ঞানপূর্ণ কোনো সাহিত্য। সেই যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদের জীবন কাহিনী, তাদের নীতিবাক্য এসবের অভাবে তাদের মন-মানসিকতার বিকৃতি ঘটেছে। হারিয়ে যাচ্ছে নিজেদের পুতপবিত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ।


তাই আজ প্রয়োজন ইতিহাস ঐতিহ্য পরিপূর্ণ সেই সুসাহিত্যিক শেখ সা’দী (রঃ), মওলানা রূমী (রঃ), কবি হাফিজ, আল্লামা ইকবালের ন্যায় কবি সাহিত্যিকদের লেখা, তবে তা যুবসমাজের মন মানসিকতার ওপর কিছু না কিছু রেখাপাত করবে। তারা নিজেদের জীবনধারাকে মূল্যবোধের স্বর্ণোজ্জ্বল গতিধারায় সজ্জিত করতে পারবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যুব ও তরুণ সাহিত্য সমাজ আজ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে সাহিত্য থেকে মুক্তা খুঁজে বের করতে।


আজ আমাদের মাঝে শেখ সা’দী (রঃ) বেঁচে নেই। কিন্তু তার সাহিত্য, আদর্শ, চরিত্র, উপদেশাবলী এখনও জীবন্ত। তা থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে আনন্দময়, যোগ্যময় করে গড়ে তুলতে পারি।
শেখ সা’দী (রঃ) জীবনের শেষ বয়সে মাতৃভ‚মি নগরের এক নির্জন আশ্রমে জীবনযাপন করতেন। সেই স্থানে অধিকাংশ সময় তিনি গভীর ধ্যানমগ্ন থাকতেন। মাঝে মাঝে দর্শনপ্রার্থীদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাতের জন্য আশ্রমে বাইরে আসতেন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, এমন কী রাজ প্রসাদের বহু ব্যক্তি সাক্ষাতের জন্য সমবেত হতেন।


শেখ সা’দীর বাল্যকাল থেকে ধর্মের প্রতি অগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। ধর্মকে তিনি জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেন। সব সময় চার পাঁচ ঘণ্টা পবিত্র কোরআন তেলোয়াত করতেন। তিনি কখনো বেনামাজি চাকর বা সহযোগী নিয়োগ দেন নাই। জীবনের সব সময় ইসলামের মৌলিক আমলসমূহ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করে গিয়েছেন।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন একবার তেহরান সফরে গিয়ে বলেছিলেন, জাতিসংঘের সদরদপ্তরের প্রবেশপথে রয়েছে জমকালো দৃষ্টিনন্দন একটি কার্পেট। আমার মনে হয় জাতিসংঘের যত কার্পেট আছে, তার মধ্যে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড়। এটি জাতিসংঘের দেওয়ালকে সুশোভিত করে রেখেছে। কার্পেটটি ইরানের জনগণের দেওয়া প্রীতি ভালোবাসার উপহার। ঐ কার্পেটের পাশেই উৎকীর্ণ রয়েছে ফরাসি সাহিত্যের মহান কবি শেখ সা’দীর চমৎকার নান্দনিক একটি কবিতা বর্ণোজ্জল পংক্তিসমূহ

All human beings are members of one frame,
Since all, at first from the same essence come.
When time afflicts a limb with pain
The other limbs at rest cannot remain.
If thou feel not for other’s misery
A human being is no name for thee.

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sk Md Bakhtiar Hossain
Sk Md Bakhtiar Hossain
8 months ago

Salam. Alhamdulillah.Amazing!