Abdul Mannan Syed

আব্দুল মান্নান সৈয়দ : আপাদমস্তক একজন কবি, সাহিত্যকর্মী

Photo source : Daily Inqilab

বহুমুখি লেখালেখির মধ্যে আব্দুল মান্নান সৈয়দের কবি চরিত্রটি প্রধান। অন্যান্য বিচিত্রগামী লেখার মধ্যে নির্দ্বিধায় একটি জিনিস পরিষ্কার হয় যে কবিতার প্রভাব অন্য মাধ্যমগুলো নিশ্চিতে গ্রাস করে রাখে। সে কারণেই গল্প উপন্যাস সম্পাদিত গ্রন্থ, গবেষণামূলক গ্রন্থ, নাটক ইত্যাদি বিচিত্র রচনার স্রষ্টা হওয়া সত্বেও আমরা তাকে শেষ পর্যন্ত ‘কবি’ অভিধায় ভূষিত করতে পারি। তবে, কবিতায় যেমন তার সফল পদচারণা তেমনি অন্য রচনাসমূহেও তার ঈর্ষণীয় সাফল্য লক্ষ্যণীয়। আমরা তার সামগ্রীক সাহিত্যকাজের মধ্যে একটি সমগ্র সৃষ্টিকেই দেখতে পাই।


তার বিচিত্র রচনাসমূহের প্রতিটি থেকে অভিনব কিছু করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যা পূর্বে হয়নি। সে কারণেই কবিতার ভাষা, গদ্যের ভাষা, সম্পাদনার ভাষা, গবেষণার ভাষা, রচনাপুঞ্জের ভাষায় প্রতিনিয়তই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নতুন কিছু করার প্রবণতা ভাবে শব্দে ঐশ্বর্যে প্রকাশমান।


আব্দুল মান্নান সৈয়দের জন্ম ৩ আগস্ট ১৯৪৩। চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত। মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০, ঢাকা। ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার সময় তার পিতা সৈয়দ এম এম বদরুদ্দোজা সপরিবারে পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং গোপীবাগ বসবাস শুরু করেন। মাতা কাজী আনোয়ারা মজিদ। ছয় ভাই চার বোন। তার স্ত্রীর নাম সায়রা সৈয়দ রানু। একমাত্র কন্যা জিনান সৈয়দ চম্পা।


১৯৫৮ সালে আব্দুল মান্নান সৈয়দ নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, ১৯৬০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, ঢাকা কলেজ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৬৪ সালে স্নাতকাত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।


শিক্ষা জীবন শেষে তিনি একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে সিলেট এম সি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ফরিদপুর শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজ, ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন।
তাকে বলা হয়েছে সব্যসাচী লেখক। বাংলা সাহিত্যের যে শাখায় তিনি চর্চা করেছেন, সাফল্য ও কীর্তি ধরা দিয়েছে অবলীলায়। এ দেশে তার মতো পরিশ্রমী লেখক দ্বিতীয় নেই।


সাহিত্য জীবনের প্রস্তুতি পর্ব সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আমার জীবনে লেটো পিরিয়ড আছে। নজরুলের মতো। পিরিয়ডটা হলো আমার ক্লাস সেভেন এইট থেকে এম এ পাস পর্যন্ত। আমি বিরামহীন লেখালেখি করতাম আর ছবি আঁকতাম। কিন্তু আমার আব্বা, কলিকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন; চাচাও মেধাবী ছাত্র; আমাকে পড়ালেখায় বাধ্য করেছেন যেন আমি এম এ পাস করি। এই জন্য ১৯৬৫ সালকে আমি ধরি আমার আত্মপ্রকাশের বছর।”
বাংলা ভাষায় তিনি সেই একজন কবি যিনি ষাটের দশকে সমকালীন কাব্যরুচিকে বদলে দেওয়ার অভিপ্রায়ে পরাবাস্তবতায় শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাক সাহিত্য বিভাগে ‘সোনার হরিণ’ শিরোনামে একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার জগতে তার আত্মপ্রকাশ হয়েছিল।


আব্দুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি এক অনুগত বান্দা। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাসে, গল্পে তার সেই আদর্শ চরিত্রের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। ‘সকল প্রশংসা তার’ শিরোনামে কবিতায় কবি বলেন-
“সকল প্রশংসা তাঁর যিনি ঊর্ধ্বাকাশের মালিক;
নক্ষত্রের চলাফেরা চলে যাঁর অঙ্গুলিহেলানে;
আমরা আশ্রিত তাঁর করুণায়: জীবনে, মরণে;
তাঁর আলো চন্দ্র-সূর্য, তারাদের আলোর অধিক
তাঁরই মুক্তা প্রজ¦লিত ঘন নীল রাত্রির ভেতরে;
তাঁরই হীরা দীপ্যমান দিবসের পূর্ণ ললাটে;
যুক্ত করেছেন তিনি তুচ্ছতাকে অসীম, বিরাটে,
সমস্ত সৌন্দর্য তাঁরই লোকাত্তর প্রতিভাস ধরে।
বিপর্যয় দিয়ে তুমি রহমত দিয়েছো তোমার
দুঃখের দিনের বন্ধু, হে পরোয়ারদিগার!
কষ্টের নিকষে তুমি আমাকে করেছো তলোয়ার,
সম্রাটেরও হে সম্রাট, হে পরোয়ারদিগার।
স্বপ্নের ঘোড়ার পিঠে আমাকে করেছো সওয়ার,
হে রহমানুর রহিম! হে পরোয়ারদিগার।”


আব্দুল মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্য সম্পাদক। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও নর্থ-সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের ‘পোয়েট ইন রেসিডেন্স’ ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকে বাংলা সমালোচনা সাহিত্য তার গবেষণাধর্মী অবদান ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনান্দদাস, কবি ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, বেগম রোকেয়া, আব্দুল গণি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধ চন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ও সম্পাদককে নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে তিনি ‘মান্নান সৈয়দ’ নামে সুপরিচিত ছিলেন।


আব্দুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় তেমন ছিল না। কিন্তু একজন সুপ্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক হিসাবে আমার জানা ছিল। তার কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকা থেকে পড়েছি। খুবই চমৎকার উন্নতমানের। যখন ২০০৯ সালে আমার প্রকাশনী ‘লেখালেখি’ শুরু করি তখন পুস্তক প্রকাশের তালিকায় আব্দুল মান্নান সৈয়দের নাম কিশোর কবি মনির ইউসুফ আমাকে দেয়। সে আমাকে বলে মান্নান সৈয়দের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে। তিনি আমাদের একটি নতুন, ভালো বই প্রকাশের জন্য পাণ্ডুলিপি দিবেন। তাই আমিও সম্মতি দিলাম। আব্দুল মান্নান সৈয়দ আমাদেরকে তার ‘রবীন্দ্রনাথ থেকে শহিদুল জহির’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি দিলেন। কিন্তু অনেক কষ্ট করে, অন্যের সহযোগিতা নিয়ে অবশেষে তার মৃত্যুর পর ২০১১ সালে একুশে বই মেলায় বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। বই প্রকাশের জন্য মনির ইউসুফকে ধন্যবাদ।
‘রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির’ গ্রন্থের ভ‚মিকায় আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেন,
“বাংলা সাহিত্যের সবিশেষ স্বাতন্ত্র চিহ্নিত
শক্তিমান লেখকদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে
শহীদুল জহির গ্রন্থটি প্রণীত হয়েছে। বিষয়
মূলত ছোট গল্প ও উপন্যাস হলেও এখানে
ধৃত লেখকদের একটি স্বাতন্ত্রীক ও
সামগ্রিক মানসালেখ্য বিবৃত করতে
প্রয়াস পেয়েছি। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে
আমার বেড়ে ওঠা জীবনের শৈশব-কৈশোর
আমার কয়েকজন বন্ধু, শিক্ষক ও সমকালীন
সাহিত্য মেধাদের প্রসঙ্গ ও চকিতে উল্লেখিত
হয়েছে- অনেকটাই আনুষঙ্গিকতার
অনিবার্য সাপেক্ষ।’
গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন বর্তমান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক করি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমার স্নেহের সন্তান আবির। গ্রন্থটি প্রকাশের পর লেখক বেঁচে ছিলেন না। তার হাতে বইটি তুলে দিতে না পারার বেদনা আমার রয়ে গিয়েছে।


লেখক আব্দুল মান্নান সৈয়দ কবির চেয়ে সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে নতুন পরিচিত। কিন্তু কবিতায় তিনি ছিলেন অনেক শক্তিধর। তার কাব্য রচনায় স্বার্থকতা বাংলা সাহিত্যের কবিদের আজও মোহিত করে। তার স্পষ্ট কবিতা, কবিতার বৃন্দ, কাব্য, কাহিনী অত্যন্ত আধুনিক, প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠককে সব সময় আকৃষ্ট করে।
কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ গ্রীনরোড বসবাস করতেন। গ্রীন রোডের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাই কবিকে ‘গ্রিনরোড’ নানাভাবে আকৃষ্ট করেছে। তিনি ‘গ্রিনরোড’ শিরোনামে কবিতাটিতে বলেন-
“একদিন কুলিরোড ছিলে।
হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
হড়হড় যেতে একদিন দেখেছিলেন তরুণ খরগোশ
যেন কোনো প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
বিদ্যুৎচমক তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন মটরশুঁটির খেতে।
লাল কালো কুঁচফল পেয়েছি একদিন সান্ত্র ঝোপ থেকে
দেখেছি ধান ধানক্ষেত, কাময়, গভীর খোড়ল
কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
কৌতূহলে। তারপর সন্তুষ্টির নৈশ সংকেত
আম গাছ, জাম গাছ, কাঠাল গাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ-বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাম, উঠে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে
যে পাতার শিকল
ধরত্রীরই কোনোখানে যেসব রয়েছে অবিকল
অনশ্বর, আবচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম।’


আমাদের নিকট সবচেয়ে বেশি সুপরিচিত আব্দুল মান্নান সৈয়দ একজন সাহিত্য সমালোচক হিসেবে। তাই লেখক রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
‘কেন্দ্রীয় কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কেন্দ্রীয় উপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের কোনো সাযুজ্য নেই। কবির সহযোগ যেখানে আছে, অনেক সময় বরং উপন্যাসের জন্য তা ক্ষতিকর হয়েছে। যেমন ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস হিসেবে দুর্বল। যেমন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ভাষা সময় সময় কাব্যিক হয়ে উপন্যাসের বিষয়কে জখম করে। রবীন্দ্রনাথের অতিরিক্ত উপমা-উৎপ্রেক্ষিত ইমেজ ব্যবহার এবং তা তার ঔপন্যাসিক স্বভাবকে যেমন উদঘাটিত করে তার চেয়ে করে তার কবি স্বভাবকে। যেমন, পাত্র-পাত্রী নির্বিশেষে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের চরিত্রের ভাষাতেই কথা বলে। কিন্তু তারপরও ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ আর কবি রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন দুই মানুষ এবং সেখানেই উপন্যাসিক হিসেবে তার সাফল্য।’
সূত্র: রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শহীদুল জহির, পৃষ্ঠা: ১১ গ্রন্থ থেকে।


রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, কবিতা নিয়ে যেমন আলোচনা, সমালোচনা আব্দুল মান্নান সৈয়দ করেছেন, তেমন কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য নিয়ে আরও বেশি আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। নজরুল সমগ্র রচনায় তার অবদান জাতি আজীবন মনে রাখবে। ‘কাজী নজরুল ইসলামের সুহোলাকা’ শিরোনামে এক সাহিত্য সমালোচনায় আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেন-
‘কবি হিসেবে নজরুল কোনো আদর্শে স্থির থাকেননি। ঔপন্যাসিক হিসেবেও। এক অবিরল চালষ্ণুতাই তার আত্মিক ও সাহিত্যিক চরিত্র। নজরুলের ঔপন্যাসের আলোচনায় তাই একথা সতত স্মরণীয় তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রেসের দ্বারা আন্দোলিত অভিভ‚ত হয়েছেন, কিন্তু প্রেমকেই জীবনের ধ্রুবতারা করেননি। বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে আলোড়িত হয়েছেন, ধার্মিক আধ্যাত্মিক ব্যাপারে লিপ্ত হয়েছেন; তার শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপ্লববাদে ঝুঁকে ছিলেন এবং তার বন্ধু মুজজাফর আহমদের দ্বারা উদ্বোধিত হয়ে সাম্যবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন- কিন্তু কোথাও নোঙর ফেলেননি।’


এভাবে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনান্দদাস প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম তিনি মূল্যায়ন করেছেন। একজন দক্ষ সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তিনি সফলতার উজ্জ্বল নমুনা সাহিত্যাঙ্গনে রেখে গেছেন।
জীবনান্দদাসের (১৮৯৯-১৯৫৪) সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে ‘জীবনান্দদাসে গল্প’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে আব্দুল মান্নান সৈয়দ বলেন-
“বুদ্ধদেববসু জীবনানন্দের স্বভাব ও কবিতায় একটি সুদৃঢ়তা ও দীপবর্তীতা ছিলো। তার সাক্ষ্য দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু, অরুণ কুমার সরকার ও নরেশ গুহ। কিন্তু একই সঙ্গে সংলগ্নতা ও যুক্ততাও ছিলো। তা দেখিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা লাবন্য দাস, সুচরিতা দাস ও অশোককানন্দ দাস এবং তার শেষ জীবনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু সুবোধ রায়। প্রকাশ্যে তিনি একটি দূরত্বের আবরণ রচনা করেছিলেন; কিন্তু মর্মত, জীবনানন্দ সন্ন্যাসি ছিলেন না- ছিলেন সর্বতোভাবেই গৃহী, যুক্ত, সম্ভোগী। জীবনানন্দের কবিতাতেও ঐ আনন্দ ও যন্ত্রণার সফেন অংশীদার, জ্বলেপুড়ে যাবে যার মর্ম পৃথিবী বিশ্বাস অবিশ্বাসের অবিরল করাতের মতো দোটানায়, সে কী সন্ন্যাসি? সে তো লিপ্ত, যুক্ত, আসক্ত।’


জীবনান্দদাসকে তিনি বলেছিলেন, ‘শুদ্ধতম কবি’ কার্যত নিজ জীবনেও তিনি ছিলেন ‘শুদ্ধতার সঠিক।’ দীর্ঘ শালপ্রাংশু অবয়ব। কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া কেশগুচ্ছ, সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন রীতিমতো সুদর্শন সুপুরুষ। তিনি আপাদমস্তক একজন কবি, সাহিত্যকর্মী।
তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
কবিতা:
জন্মান্ধ কবিতা গুচ্ছ (১৯৬৭)
জ্যোৎসা রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯)
ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪)
কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২)
পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮৪)
পার্ক স্ট্রিট এক রাত্রি (১৯৮৩)
মাছ গিরিজ (১৯৮৪)
সকল প্রশংসা তার (১৯৯৩)
আমার সনেট
উপন্যাস:
পরিপ্রেক্ষিতের দাস-দাসী
অ-তে অজর (১৯৮২)
কলকাতা (১৯৮০)
ক্ষুধা প্রেম আগুন (১৯৯৪)
পোড়া মাটির কাজ,
হে সংসার হে লতা
ছোট গল্প:
সত্যের মতো বদমাস
চলো যাই পরোক্ষে (১৯৭৩)
মৃত্যুর অধিয় লাল ক্ষুধা
নেকড়ে হায়েনা
তিনি পরী
প্রবন্ধ:
বিবেচনা পুনর্বিবেচনা
দশ দিগন্তের দ্রষ্টা
নির্বাচিত প্রবন্ধ
করতলে মহাদেশ
আমার বিশ্বাস
ছন্দ।
স্মৃতিকথা: ভেসেছিলাম ভাঙা ভেলায়
প্রণীত জীবন
গবেষণা গ্রন্থ: কালান্তরের যাত্রী
জীবনী:
নজরুল ইসলাম : কবি ও কবিতা
বেগম রোকেয়া
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
ফররুখ আহমদ
শাহাদাত হোসেন
জীবনানন্দদাস
প্রবোধ চন্দ্র সেন
আব্দুল গণি হাজারী
সৈয়দ মুতাজা আলী।
সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ। জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থ লিখেছেন বেশ কয়েকটি।
সাহিত্যকর্মের স্মৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮১
আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ১৯৯১
নজরুল পুরস্কার, পশ্চিম বঙ্গ ১৯৯৮
কবি তালিমা হোসেন পুরস্কার ২০০০
নজরুল পদক ২০০১
অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার ২০০২
একুশে পদক প্রভৃতি।
ছোটবেলা থেকেই তিনি চিত্রকলায় আগ্রহী ছিলেন। ষাটের দশকে বেশ এঁকেছেন। আলোক সৈয়দ ছন্দনাম ব্যবহার করতেন তিনি। খেয়া সাময়িকীর ২৫তম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় আগস্ট ২০০৮ দীর্ঘ চার যুগের ব্যবধানে তার আঁকা ছবি মুদ্রিত হলে চিত্রকর পরিচয়টি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।


আব্দুল মান্নান সৈয়দ তার প্রকাশ রীতির জন্য একটি বিশেষ গদ্য ভাষা আবিষ্কার করেছিলেন। তার বাক্য পদ সংস্থাপনার ক্রম ছিল অভিনব এবং সমাসবদ্ধের ব্যবহার ছিল অকাতরে। ফলে তার ভাষা ছিল কিছুটা জটিল ও দুর্বোধ্য। তবে সার্বিকভাবে এ ভাষা ছিল প্রকাশ ক্ষমতায় ঋদ্ধ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সহজ ভাষায় লেখা শুরু করেছিলেন।


জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে জীবনকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করেন। জীবন দর্শন নিয়ে তাই শেষ জীবনে বলেন-
‘একটা বয়সে এসে বুঝতে পারছি, আমি চারিপাশে তাকাইনি। দ্বিতীয়বার হৃদরোগে পরে, দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থেকে আমি আমার আশপাশের মানুষেরে দেখলাম- আমার পাড়ার মানুষ, বাজারের লোকজন, খুব সাধারণ মানুষ। বুঝতে পারছি, যাদের নিয়ে আমার জীবন চলেছে, তাদের জন্য আমি কোনো কিছু করিনি’।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments