Image source: Cowater International
দেশে উচ্চ শিক্ষার জোয়ার বহে যাচ্ছে। সরকার প্রতিটি জেলায় জেলায় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়ে চলেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে-৫৩টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা রয়েছে ১১৪ টি। সরকারি প্রকৌশল ও কলেজ রয়েছে-৪৪ টি। সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৩৭ টি। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৭০টি ।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যা ৪৩,৬২,১৮৭ । বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যা ৩,২৮,৬৬৯ । সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৯০,০০০ । সরকারি মেডিকেল কলেজ র ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যা ৫,৩৮০ । বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ৬২৯৫।
দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা এখন অনেক বেশী। সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর পাশ করে বের হচ্ছে প্রায় ২৫ লক্ষ যুবক, যুবতী। দেশের কর্মসংস্থান সেই অনুযায়ী নাই। বেকার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কারিগরী শিক্ষা তথা নানা পেশায় শিক্ষিতের হার সেই অনুযায়ী অনেক কম। বিশেষ করে দেশে নার্স শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করলে পেশাজীবীদের এক নতুন তথ্য বের হয়ে আসবে।
আন্তজার্তিক নার্স দিবসঃ বিগত ২ মে’ ২৪ আন্তজার্তিক নার্স দিবস বিশ্বময় পালিত হয়েছে। আমাদের দেশেও পালিত হয়েছে। কিছু পত্র-পত্রিকায় নার্সদের সুবিধা অসুবিধা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা এসেছে। নার্স শুধু আমাদের দেশে নয় বিশ্বময় অতি গুরুত্বপূর্ণ্য পেশার মানুষ। মানব জীবনে উন্নতি ও সেবার জন্য নার্সের প্রয়োজন অনেক অনেক বেশী। আমাদের দেশে নার্সের অভাব রয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশেও নার্স এবং মিডওয়াইফের গুরুত্ব ও প্রয়োজন রয়েছে। নার্সদের সংখ্যা স্বল্পতার জন্য আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। উন্নত দেশের নার্সসের অভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগীরা উপযুক্ত ও যথাসময়ে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এবারের নার্স দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “ আমাদের নার্স, আমাদের ভবিষ্যৎ, সেবাই আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি”
দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে নার্সিং পেশাজীবীরা। সরকারিভাবে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানে এমএসসি ইন নার্সিং ডিগ্রি চালু আছে। বেসরকারিভাবে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও খরচ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ঘাটতিতে সেখানে এক-তৃতীয়াংশ আসন খালি থাকছে। অন্যদিকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ অনুযায়ী উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন বিষয়ভিত্তিক দক্ষ স্পেশালাইজড নার্স সংকটে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগীরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছে। যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে।
এমন পরিস্থিতিতে আধুনিক নার্সিংয়ের জনক ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজ বিশ্বের সকল দেশেও পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নার্স দিবস-২০২৪।’‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস’ (আইসিএন) এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে-‘আওয়ার নার্সেস, আওয়ার ফিউচার, দ্য ইকোনমিক পাওয়ার অব কেয়ার’ অর্থাৎ ‘আমাদের নার্স, আমাদের ভবিষ্যৎ, সেবাই আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি।’ দিবসটি উপলক্ষ্যে নার্সিং ও মিউওয়াইফারি অধিদপ্তরের উদ্যোগে সচেতনতামূলক শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নার্সিং কলেজ ও হাসপাতালে সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে।
দেশে নার্স শিক্ষা: সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সামরিকভাবে পরিচালিত ৩২টি প্রতিষ্ঠানে চার বছর মেয়াদি বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সে ২১০০ আসনে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া দশটি প্রতিষ্ঠানে দুই বছর মেয়াদি বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সে ৭২৫টি ও দুটি প্রতিষ্ঠানে দুই বছর মেয়াদি এমএসসি ইন নার্সিং ডিগ্রির ২৭০টি আসন রয়েছে। এর বাইরে ২১টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১,৬৩০টি আসনের অনুমোদন থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এক-তৃতীংশ আসন খালি পড়ে থাকছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন রোগীকে সুস্থ করতে চিকিৎসকের মতো নার্সরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা ২৪ ঘণ্টাই রোগী সেবায় নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু বিষয়ভিত্তিক ও উচ্চতর ডিগ্রিধারী নার্স সংকটে রোগীদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
নার্সদের উচ্চ শিক্ষা: নার্সদের উচ্চশিক্ষা বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন (এমএসসি ইন নার্সিং) ডিগ্রি অর্জনে সরকারিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর মুগদায় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ৬টি বিশেষায়িত বিষয়ের জন্য ১২০টি আসন থাকলেও মাত্র ৬০টি আসনে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। এছাড়া কলেজ অব নার্সিং (শেরেবাংলা নগর) এমএসি কোর্স চালুর অপেক্ষায় রয়েছে।
সম্প্রতি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ৯টি বিশেষায়িত বিষয়ে ৩টি করে মোট ২৭টি আসন চালু হয়েছে। বেসরকারিভাবে ২১টি প্রতিষ্ঠানে নার্সিংয়ে এমএসসি ডিগ্রি চালুর অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়া নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষায় এমএসসি বা পিএইচডি করার সুযোগ নেই। তবে ২২ জন নার্স দেশে সরকারিভাবে পিএইচডি ইন কমিউনিটি/পাবলিক হেলথ সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া বিদেশে পিএইচডি ইন নার্সিং করেছেন ১৬ জন। বর্তমানে ৮ জন নার্স বিদেশে পিএইচডি অধ্যয়নরত।
নার্সের সংখ্যাঃ সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস (এসএনএসআর) তথ্যমতে, দেশে ১ লাখ ৩৬ হাজার রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের বিপরীতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা রেজিস্টার্ড নার্স ও মিডওয়াইফের সংখ্যা রয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ২১ জন। এর মধ্যে বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) ৭ হাজার ১৯২ জন এবং বিএসসি ইন পাবলিক হেলথ নার্স রয়েছে ১ হাজার ৬১৮ জন। সবমিলে চার বছর মেয়াদি বিএসসি পাশ রেজিস্টার্ড নার্সের সংখ্যা ১০ হাজার ১৫১ জন।
অভিজ্ঞদের বক্তব্যঃ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সাবেক ডিপিএম এবং সিবিএনএস, জাইকা প্রজেক্টের সিনিয়র কনসালটেন্ট ড. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশে চিকিৎসা বিভাগের মতো বিষয়ভিত্তিক নার্সিং স্পেশালিটি থাকলেও বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। নার্সদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ তৈরিতে পিছিয়ে রয়েছে। সম্প্রতি দশটি পুরাতন নার্সিং কলেজে উচ্চতর ডিগ্রি চালুর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে।
কিছু পরামর্শঃ
১. দেশের বিকাশমান নার্স শিক্ষাকে আরও বেশী ও কার্যকরী পদক্ষেপে নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রয়োজন কত সংখ্যক নার্স তা আমাদের নির্ধারণ করা দরকার। সে অনুযায়ী নার্স শিক্ষাকে সাজাতে হবে।
২. দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে নার্সকে সুশিক্ষিত করে বিদেশে কর্ম সংস্থানের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। তা হলে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন এক ক্ষেত্র পাবো।
৩. বিদেশি উপযোগী নার্স তৈরির জন্য আমাদের শিক্ষার কার্যক্রমকে বিদেশি, উন্নতদেশের চাহিদানুযায়ী তৈরি করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি নার্স কলেজ সমূহের শিক্ষাকার্যক্রম নতুন করে সাজাতে হবে। শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোউপযোগী করে গড়তে হবে। নিম্মমানের শিক্ষক ও শিক্ষা কারিকুলাম দিয়ে বিদেশে, উন্নত দেশের নার্সের চাহিদা পূরণ করা যাবে না। উন্নত দেশের আদলে নার্সের শিক্ষাকে গড়ে তোলতে হবে। দেশে জেলা ভিত্তিক চাহিদানুযায়ী নার্স শিক্ষাকে গড়ে তোলতে হবে। প্রতিটি জেলায় নার্স কলেজ উন্নত মান অনুযায়ী গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি বাজেটে সরকারের কর্ম পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
৪. বেসরকারিখাতে নার্স কলেজ , ইন্সিষ্টিটিউট স্থাপনে সরকারকে নীতিসহযোগীতা আরও বেশী করে দিতে হবে। তবে গুণগত মান রক্ষার ক্ষেত্রে বেশী যত্নশীল হতে হবে।
৫. নার্স কলেজ সমূহে পড়ার ধরণ , পদ্ধতি ও কৌশল আধুনিক দেশের শিক্ষা থেকে গ্রহন করতে হবে। সনাতন শিক্ষায় নার্স শিক্ষায় বেশী এগিয়ে নেওয়া যাবে না। শিক্ষকের মান বাড়াতে হবে শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। বিদেশি ও উন্নত দেশের শিক্ষা পদ্ধতি এই ক্ষেত্রে অনুকরণ করতে হবে। তবেই শিক্ষিত নার্সগণ বিদেশে উচ্চমূল্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে
৬. নার্স কলেজ ও ইন্সিষ্টিটিটিউট : বিদেশি কারিকুলামে কর্মসংস্থান সুবিধার জন্য ছাত্র- ছাত্রীদেরকে বিদেশি কয়েকটি ভাষা অবশ্যই শিখতে হবে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইংরেজি, জাপান, আরবী, ফ্রাান্স ও জার্মানী। ভাষা শিক্ষার জন্য কারিকুলামে অর্ন্তভূক্তি রাখতে হবে, যাতে এই সকল উন্নত দেশে তাদের কর্মসংস্থানে কোন অসুবিধা হবে না। উক্ত নার্সে বেচেলর ডিগ্রীধারী উল্লেখিত যে কোন দুটি ভাষার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যাতে করে দুটি ভাষা ঐ দেশে নার্সের চাকুরী জন্য আবেদনকারী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।