আমাদের বহু বছর ধরে প্রাপ্ত তিস্তার পানি ভারত দিতে পারছে না। সব সময় তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে হচ্ছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিয়ে আসা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে ভারত থেকে আমাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সংবাদটি সকল মহলে তুমুলভাবে আলোচিত। বর্তমানে সোস্যাল মিডিয়ায় তিস্তা চুক্তির বিষয় যুব সমাজকে চরমভাবে ব্যাথীত করেছে, জাগ্রত করেছে।
আমাদের সরকার বেশ কয়েক বছর পূর্ব থেকে বুঝতে পেরেছেন ভারত তিস্তার পানি দিবে না বা দিতে গড়িমসি করবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার পানি সমস্যা সমাধানে বিকল্প হিসাবে ‘তিস্তা প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প আজ থেকে তিন বছর পূর্ব থেকে গ্রহণ করেছিলেন। তিন বছর পূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-কে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বে বহুল পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়োনো নদীকে চীন যেভাবে চীনের আশির্বাদে পরিণত করেছে ঐ একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতি বছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়।
তিস্তা প্রকল্পে কি করা হবে ?
তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন করা হবে। খননের মাধ্যমে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে বেশ কমিয়ে আনা হবে। সঙ্গে সঙ্গে নদী শাসনের মাধ্যমে অনেক নদী উদ্ধার করা হবে। উক্ত জমিতে বিশাল আকারে চাষের উপযোগী করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ-কাম রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করার সঙ্গে সঙ্গে বর্ষাকলে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে শুষ্ক মৌসুমে নদীর দুই তীরের জমিতে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। তিস্তা নদীর উভয় তীরে বিশাল বিশাল শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হবে। তেমনি দৃষ্টিনন্দন নগরায়ন সুবিধা সৃষ্টি করে দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধিত করা হবে। কর্মসংস্থানের এক মহা নগরে পরিণত হবে। বিপুল মানুষের চাকরি সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাঞ্চল হয়ে উঠবে শিল্প নগরীতে ও অর্থনৈতিক নগরীতে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষের জীবনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সচিব ও মন্ত্রীগণ প্রকল্পটি সম্পর্কে অনেক আশাবাদ ব্যক্ত করে আমাদের উৎসাহ বাড়িয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে ভারত তিস্তা প্রকল্পটি যাতে বাস্তবায়িত না হয় তার জন্য প্রচণ্ড রকমের চাপ বাংলাদেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভারত মনে করছে এই প্রকল্প ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হবে বলে এই প্রকল্প না করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে নিরবে বাংলাদেশকে সরাসরি চাপ দিয়ে চলেছে।
ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডোরের ‘চিকেন নেকে’র এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্প কয়েক হাজার চীনা নাগরিকের অবস্থান ভারতের জন্য কোনক্রমেই শুভ হবে না। তাই তাদের বিরোধীতা করার মূল কারণ। অন্য দিকে ভারত বাংলাদেশকে পরপর আশ্বাস দিচ্ছে নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের সরকার নরেন্দ্র মোদি গঠনের পর পর তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি করবে। তখন তিস্তার এই প্রকল্পের কোন প্রয়োজন হবে না। বিগত অক্টোবর’২০ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা- বাংলাদেশ সফরের সময় হয়তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এ ধরনের প্রস্তাব দিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আবারও তৃনমূল কংগ্রেসই জয়লাভ করেছেন। এদিকে বাংলাদেশের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিক্রম দোরাইস্বামী ১৫ই ফেব্রæয়ারি’২১ ঢাকায় ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) এর এক সভায় দাবি করে বলেছেন ‘ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে দাদাগিরি’ করে না। কিন্তু তিস্তা প্রকল্প না করতে দেয়া কি ‘দাদাগিরি’ নয়? এই ধরনের অপতৎপরতাকে আমরা কি বলতে পারি? চীনের টেকনিশিয়ান কেন ভারতের জন্য ক্ষতিকর হবে? আমাদের ভূখণ্ডে চীনা শ্রমিকেরা কাজ করবে, তাতে ভারতের আপত্তির কি কারণ হতে পারে? তাছাড়া শিলিগুড়ি চিকেন নেক করিডোর আমাদের প্রস্তাবিত প্রকল্প থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া কয়েকশত মাইল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চীনা কর্মীদের কিভাবে গোয়েন্দা তৎপরতা চালাবে? তিস্তা নদীর দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ভাটি থেকে যতই প্রকল্পের কাজ এগোবে ততই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব বাড়তে থাকবে।আমাদের মতে, ভারতের এ ধরনের আবদার বরং একটি চমৎকার ‘ক্ল্যাসিক দাদাগিরি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভেটো দিয়ে চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় নির্মিতব্য গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি ভেস্তে যায়। তবে ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ মহেশখালীর মাতার বাড়িতে একটি বিকল্প গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় এখন জাপানের অর্থায়নে ঐ বন্দরের নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ভারত সবসময় চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে ভাল চোখে দেখে নাই। এখনও একই অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ চীন থেকে দুইটি সাবমেরিন কেনার ব্যাপারটিকেও ভাল চোখে দেখতে পারে নাই।
২০১৭ সালে ৭-১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় ভারত একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চেষ্টা করেছিল। বাংলাদেশ কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। ভারত আঞ্চলিক ‘দাদাগিরি’ দীর্ঘদিন থেকে করার চেষ্টা করছে। ভারতের অসহযোগিতার কারণে এই অঞ্চলের বলিষ্ঠ সংগঠন ‘সার্ক’ কার্যত অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। অথচ এই সার্কের মাধ্যমে এই অঞ্চলের ভাগ্যের অনেক পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ কোনক্রমেই ভারতের নিকট অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কিংবা সামাজিক কোন দিক থেকেই নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনভাবেই ভারতের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর খয়রাতের উপর নির্ভরশীল নয়্ এখন আমরা উন্নয়নশীল দেশের পথে উন্নীত হয়েছি। আমাদের দেশ এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনেও সমৃদ্ধ। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ৪৩ বিলিয়ন অতিক্রম করেছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি ভারতের চেয়ে বেশি। করোনাকালেও বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে সব দিক দিয়ে এগিয়ে। করোনা মোকাবেলায়ও আমরা ভারতের চেয়ে সফল।
ভারত থেকে বাংলাদেশে রফতানি বার্ষিক প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বিলিয়ন ডলার। আর আমাদের রফতানি ভারতে মাত্র ৬৮ কোটি ডলার। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীগণ বিভিন্নভাবে ভারতে চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছে। কিন্তু ভারত থেকে কোন রেমিট্যান্স বাংলাদেশে আসে না। ভারতের বিনিয়োগও বাংলাদেশে নাই বললে চলে।
তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতিকর এবং খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী, যার বন্যার কারণে গড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে এই অঞ্চলের মানুষ মরুভ‚মির দেশের মত জীবন বাঁচাতে হয়। তিস্তা নদী উজানে পশ্চিম বঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ায় তিস্তা নদী বাংলাদেশের অংশে বছরের বেশিরভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকে। আমাদের পরম বন্ধু ভারত। স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতার জন্য আমরা সবসময় ভারতকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, স্মরণ করি। আমরা তখনকার ভ‚মিকার জন্য ভারতের নিকট ঋনী। কিন্তু দীর্ঘ তিন দশকের ক‚টনৈতিক আলোচনার পর যখন ভারত বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি ২০১৯ সালে এসে তিস্তা চুক্তি চুড়ান্ত হওয়ার কথা, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার অসহযোগিতার কথা বলে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হলো না। আজও হয়নি। কখন হবে তারও কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তিস্তা চুক্তির সঙ্গে আমাদের তিস্তা প্রকল্পের কোন সমস্যা নাই, বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। তিস্তা চুক্তি হলেও আমাদের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন দেশের স্বার্থে করতে হবে।
কিন্তু ভারত ‘তিস্তা চুক্তি’ মুলা ঝুলিয়ে আমাদের মূল ‘তিস্তা ব্যারেজ’ প্রকল্পের গতি কমিয়ে দিয়েছে। এর রহস্য কি? কি কারণে আমরা আমাদের নিজেদের প্রকল্প বাস্তবায়নে চুপ করে থাকবো। তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক তিন্তা ব্যারেজ প্রকল্প দেশের স্বার্থে, জনগণের জীবন ও জীবিকার বৃদ্ধির জন্য বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তিস্তা পানি চুক্তি হলে হয়তো আমরা শুষ্ক মৌসুমে কিছু পানি পাবো। কিন্তু বন্যার হাত থেকে বাঁচার কোন ব্যবস্থা হবে না। তিস্তা পানি চুক্তি হওয়ার পর বন্যার হাত থেকে বাঁচার কোন নিশ্চয়তা আমাদের নাই। অন্যদিকে পর্যাপ্ত পানিও যে পাবো তারও কোন নিশ্চয়তা দেখছি না। তবুও তিস্তা পানি চুক্তি ভারতকে দ্রুত করা উচিত। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোন একটি প্রদেশের বাধার কারণে একটি স্বাধীন দেশের সঙ্গে অন্য একটি স্বাধীন দেশের চুক্তি আটকে থাকবে তা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না।
তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন নামের এই প্রকল্পের ব্যয় প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছে আনুমানিক আট হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি পুরোপুরি চীনরে আর্থিক সহযোগিতায় বাস্তবায়নের কথা। চীন বাংলাদেশকে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিযেছে। এখন শুধু আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। আমরা আশা করি আমাদের দূরদর্শী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে যেভাবে পদ্মাসেতু করছেন, ঠিক তেমনিভাবে তিনি উল্লেখিত প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবেন। যত দ্রুত একনেকে প্রকল্পটি পাশ করে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ আমাদের সমস্যা আমাদের সমাধান করতে হবে। আমাদের উন্নতি, আমাদের ভালো-মন্দ আমাদেরকে বুঝতে হবে। সেই বুঝবার ক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। শীঘ্রই আমরা এই প্রকল্পের দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখতে পাবো।
‘তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে’ এ খবরে উত্তরাঞ্চলের তিস্তাপাড়ের মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। সরকার একমাস আগে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে চীন সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে সহজশর্তে অর্থের জোগান দিতে বলেছে। এ খবর প্রচার হওয়ার পর তিস্তা পাড়ের মানুষ দারুণ খুশি। নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট থেকে শুরু করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে যেন লেগে গেছে ঈদের খুশি। চীনের তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভাগ্যের চাকা বদলে যাবে। অর্থনৈতিকভাবে চরের মানুষ স্বাবলম্বী হবে। এ জন্য তারা বেজায় খুশি। জানা গেছে, তিস্তা প্রকল্পে সহজ শর্তে অর্থের জোগান সংক্রান্ত চিঠি দেয়ার পর দুই দেশের ক‚টনৈতিক পর্যায়ে সফলভাবে আলোচনা চলছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার যেমন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী; তেমনি চীন সরকারও অর্থ দিতে প্রস্তুত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিস্তা প্রজেক্টের কাজ শুরু হচ্ছে এই খবর নদী পাড়ের মানুষ ‘ঈদেরচাঁদ’ দেখার মতো করেই প্রচার করছে। হাট-বাজার, ট্রেন-বাস এবং যেখানে যাকে পাচ্ছেন তিস্তাপ্রজেক্ট হচ্ছে এ খবর দিচ্ছেন। কেউ কেউ আগবাড়িয়ে জানতে চাচ্ছেন ভারতের দাদাগিরিকে থোরাই কেয়ার করায় উত্তরাঞ্চলের মানুষের শেখ হাসিনা ইতিহাস হয়ে থাকবেন। কিন্তু সরকারের‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রæতা নয়’ নীতি কঠোর হওয়ায় এ প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে। এটা উত্তরাঞ্চলের দুই কোটি মানুষের ভাগ্যের চাকা পাল্টে দেবে। সে জন্যই সবাই খুশি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্য পীড়িত উত্তরাঞ্চলের জেলা গুলোকে অর্থনৈতিকভাবে স্থায়ী সমৃদ্ধশালী করতে তিস্তা নদীকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে- ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা ও নদী পর্যবেক্ষণ কাজ দুই বছর ধরে করছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার ও চায়না রিভারইয়েলো। তিস্তা প্রকল্পটি হবে আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও যুগোপযোগী। উত্তরাঞ্চলের ‘পাগলানদী’ খ্যাততিস্তা ড্রেজিং করে কোটি কোটি মানুষের দুঃখ ঘুচানো হবে। এ প্রকল্পে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দু’পাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালুসরিয়ে কৃষি জমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করা হবে। শুধু তাই নয়, এ প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে। চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা।
চীনের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। তিস্তা নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। বন্যায় উসলেভাসাবেনা গ্রাম-গঞ্জ জনপদ। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাবে না। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নৌ -বন্দর এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগাড, সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাস্প স্থাপন করা হবে।
জানা গেছে, তিস্তা প্রকল্পে পূর্ব চীনের জিয়াং সু-প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলেতিস্তার দুই পারে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তিস্তা নদীর পাড়ের জেলা গুলো নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চায়নার তিনটি প্রতিনিধি দল কাজ করছেন। তারা এসব কাজের পরামর্শ দিয়েছেন। মূলত এ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লংড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এ রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদী পাড়ের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে- হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দরগড়ে তোলা হবে। তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে- পূর্ব চীনের জিয়াং সু- প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী।
উত্তরাঞ্চলে ডালিয়ায় তিস্তা সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে ভারত এই প্রকল্পের ৬৫ কিলোমিটার উজানে কালী গঞ্জের গজল ডোবায় সেচ প্রকল্প তৈরি করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত তিস্তা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে তিস্তা পাড়ে প্রতি বছর বন্যা ও খরা দেখা দেয়। নদী ভাঙনে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর গৃহ হারাচ্ছেন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন থেকে ভারত ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে তিস্তা পাড়ের লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতে বর্তমান সরকার নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার আর্থিক সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নেবে। মানুষ কাজ পাবেন। পাল্টে যাবে এসব জেলার মানুষের জন জীবন। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই তিস্তা পাড়ের মানুষের দুঃখের দিন শেষ হয়ে যাবে ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চীনের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগে একটি চক্র-এর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে। তাদের মতে, চীনের অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়, এটি বাংলাদেশের একটি উন্নয়ন প্রকল্প। বিশ্বের সকল দেশকে এখানে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়। চীন এগিয়ে এসেছে।
চীনের টাকায় তিস্তা প্রকল্প হচ্ছে কয়েক মাস আগে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভারত বাগড়া দেয়। ভারতের গণ মাধ্যম নানা ভাবে প্রচার করে তিস্তা প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশ ভারতের হাত ছাড়া হয়ে যাবে। দিল্লির সাউথ বøক এখন ঢাকাকে যা করতে বলছে তাই করছে। চীন তিস্তায় বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবে ভারতের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ভারতের বাধা উপেক্ষা করেই তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মিজানুর রহমান জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে তার দফতরকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা, ড্রইং, ডিজাইন করেছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় সব কিছু বিশ্লেষণ করেছে। তারা চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমান সরকারের আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এ বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ বলেন, তিস্তা বর্তমান সরকারের একটি বড় প্রকল্প। চীনের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্পের সব কিছু পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে করা হচ্ছে। আমার জানা মতে, পরিকল্পনা কমিশন থেকে অর্থায়নের বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।