দুর্নীতির সূচকে বিশ্বে দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ : আমাদের করণীয়

জীবন থেমে থাকে না। চলতে থাকে। কখনো ভালো ভাবে, কখনো খারাপ ভাবে। তেমনি রাজনীতিতে ভাল-মন্দ সবসময় রয়েছে। কখনো রাজ প্রসাদে, কখনো বা জেলে। তবে অপকর্মের জন্য সাজা রাজনীতিতেও ইদানিং বেশ বেড়ে গিয়েছে। ২৮শে ফেব্রুয়ারী’২১ মানব পাচার ও অর্থ পাচারের মামলায় লক্ষ্মীপুরে সংসদ সদস্য কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলকে কুয়েতের এক আদালত চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। এইটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম ঘটনা, কোন সংসদ সদস্য বিদেশের আদালতে সাজা পেলেন। দেশের সম্মান, মর্যাদা আজ ভূলুণ্ঠিত। মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। মানুষ খুবই মর্মাহত। সংসদ সদস্যদের নিকট থেকে জাতি এ রকম উদাহরণ কখনো আশা করে না।


আদালতের বিচারক চার বছর কারাবাসসহ ১৯ লক্ষ কুয়েতি দিনার অর্থাৎ বাংলাদেশি ৫৩ কোটি ২১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন। এই প্রথম একজন বাংলাদেশের কোনো সংসদ সদস্য বিদেশের আদালতে দণ্ডিত হলেন।
এদিকে একই দিনে টিআই অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপারেন্সি দুর্নীতির সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছেন। দুর্নীতিতে বাংলাদেশ দুই ধাপ পিছিয়ে ১৪৬তম স্থানে অবস্থান করছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২০ সালে অধ:ক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১২তম। ২০২০ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র আমাদের সমানে মিডিয়ার মাধ্যমে এসেছে। দুর্নীতি পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে টানা তিন বছর বাংলাদেশের স্কোর হচ্ছে ২৬। অর্থাৎ তিন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের কোন পরিবর্তন নাই। করোনাকালে স্বাস্থ্যখাত সহ দেশের বিভিন্ন দপ্তরে যে দুর্নীতির চিত্র আমরা পেয়েছি তারই প্রতিফলন এই রিপোর্টে ঘটেছে। বাংলাদেশের এই অবস্থান এশিয়ানর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ দক্ষিণ সুদান ও সোমালিয়া এবং সবচেয়ে কম ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড।


জার্মান ভিত্তিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা-ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২০ সালের প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্য সমূহ উঠে এসেছে। বিগত ২৭ জানুয়ারি ২০২০ সালে একযোগে বিশ্বব্যাপি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতি বছর এই ধরনের রিপোর্ট নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে টিআইবি প্রধান ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে নানা বক্তব্য রাখেন। দুর্নীতিরোধে দেশের কি করণীয় তা-ও সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়েছে। টিআইবি উল্লেখ করেন বাংলাদেশের দুর্নীতির লাগামকে শক্ত হাতে দমন করতে হলে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ১. দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা রাজনৈতি দলসমূহের থাকতে হবে। ২. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)কে আরও বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। ৩. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জরুরি। ৪.সচেতন নাগরিক সমাজকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও বেশি বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। ৫। দেশে দুর্নীতি বিরোধী এক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।


সংবাদ সম্মেলনে এক পর্যায়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে অস্বীকার করা হয়। এমন কোন দুর্নীতি সম্পর্কে সত্যিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমে বেশ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে দেশে দুর্নীতিবাজেরা বেশ উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাজনীতিবিদদের প্রতিস্রুতি ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতার অভাব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেওয়া। এছাড়া গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও তদের বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই। (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর ২৯ জানুয়ারি, ২০২১)।


প্রতিবেদনে বাংলাদেশের দুর্নীতির সূচক স্কোর অপরিবর্তিত। তবে তা বৈশ্বিক গত ৪৩-এর চেয়ে অনেক কম। এটি অতন্ত বিব্রতকর ও হতাশাব্যঞ্জক। দেশে ক্ষেত্রবিশেষ দুর্নীতির ঘটনা অস্বীকার কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনের কঠোরতম প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিকে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি কার্যকরী সমানতালে হচ্ছে না। কারণ যারা দুর্নীতির রশিকে টেনে ধরবেন তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্নীতিকে সহযোগিতা করছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ঘোষণাই থেকে যাচ্ছে। সমাজে দুর্নীতির সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত শক্তিশালী। রাজনৈতিকভাবে তাদের শিকড় বহু গভীরে অবস্থান করছে। তাই সমাজে সর্বত্র দুর্নীতি দ্রæত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্নীতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।


জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করছে বাংলাদেশ। সে কারণে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের জন্য স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক আইনে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকার বাধ্য। কিন্তু দেশে দুর্নীতি পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান যেরূপ, সেই অনুযায়ী প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক এই সকল তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক, শাস্তিমূলক পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বড় সমস্যা। স্বাধীনভাবে আর্থিক খাত কাজ করার সুযোগ থেকে অনেকটা বঞ্চিত। তাই দুর্নীতি নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া যে সংস্থাটি তথা দুর্নীতি দমন কমিশন অতিব দুর্বল। রাজনৈতিক আনুগত্যে ভরপুর। তাদের মধ্যে চারিত্রিক দৃঢ়তার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতাও যেন নাই বলা যায়। আবার মনে হয় কেন, কারো নির্দেশের অপেক্ষায় সবসময় দুদক সময় ক্ষেপণ করছে।


দুর্নীতি পরিস্থিতি উন্নয়ন স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬ হয়েছে। এক্ষেত্রে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ একই অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু বিশ্বের সবগুলো দেশের বড় স্কোর ৪৩। বিশ্বের গড় স্কোর থেকে বাংলাদেশ ১৭ ধাপ পিছিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি ব্যাপক, অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিন্তু সরকার প্রধান বার বার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। বিচার করার চেষ্টা করছেন। বিচারও হচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতির ঘোড়া থামছে না। সকল উন্নয়ন যেন দুর্নীতির ঢামাঢোলে চাপা পড়ে যাচ্ছে। এটি সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। বড় কারণ। বড় বড় সকল অর্জন দুর্নীতির কবলে বিলীন হতে দেয়া উচিত হবে না।


দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এ ছাড়া এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশের মতো একই স্কোরে সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক এবং উজবেকিস্তান। বিশ্বের বেশ কিছু দেশের নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশেও সেই রোগে আক্রান্ত। আবার যে সকল দেশে গণমাধ্যম ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কম সুরক্ষা পায়, সেই সব দেশেও দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।


প্রতিবেদন অনুযায়ী কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। তৃতীয় অবস্থানে যৌথভাবে রয়েছে সিঙ্গাপুর, সুইডেন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে সর্বনিম্নে অবস্থান করছে সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদান। এর পরই রয়েছে সিরিয়া, ইয়ামেন, ভেনিজুয়েলা। ভূটান হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে। ভূটানের অবস্থান ৬৮তম। ভূটানের পর রয়েছে ভারত ৪০, শ্রীলঙ্কা ৩৮, পাকিস্তান ৩১, মালদ্বীপ ৪৩ এবং আফগানিস্তান ১৯তম অবস্থানে।


দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষ দিন দিন কেমন যেন বিরক্ত হচ্ছে। নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমে যেন দিন দিন দুর্নীতির ব্যাপারে খেই হারিয়ে ফেলছে। গা সহা হয়ে পড়ছে। এই লক্ষণ খুবই খারাপ। মানুষের কণ্ঠস্বর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বড়ই প্রয়োজন। ডিজিটাল আইনে বাক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তা সংশোধন হওয়া জরুরি। আসন্ন বাজেট অধিবেশনে এই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার সংবাদ রয়েছে।

সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ এখন যেন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তাতে দুনৃীতি বৃদ্ধিতে সহযোগিতা হচ্ছে। দেশের সকল ট্রেড বডি এখন সরকার দলীয় নেতা কর্মীদের হাতে মুঠোতে। তাই ব্যবসার স্বার্থে কথা বলার আওয়াজ ক্ষীন হয়ে পড়েছ। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহ যোগ্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তাই এই সকল ক্ষেত্র থেকে দুর্নীতি উৎসাহিত হচ্ছে। সূচকে এই সকলের প্রভাব পড়েছে।


উক্ত প্রতিবেদন ২০১৯-২০২০ পর্যন্ত তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলিতে মূলত ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চিন্তার প্রতিফলন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই জরিপে আটটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ ব্যবহার করা হয়েছে। তা হচ্ছে- বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, গেøাবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বাটেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল’ পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট ডাটাসেট রিপোর্ট।


এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টিআইবির কোন ভূমিকা নেই। নিরপেক্ষভাবে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
দুর্নীতি হ্রাসে উপায় কি? :বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি আছে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো এত ব্যাপক হারে নয়। দুর্নীতিতে নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে। কেমন করে এই সকল দেশে দুর্নীতি নাই বা কম হচ্ছে – তা আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। এমন কি ভুটান ও পাকিস্তান আমাদের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থানে। তবে আমরা কেন পারবো না। পারবো। তবে কিছু কঠোর, কঠিন, স্বচ্ছ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।


১। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, হ্রাস বা বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে বড় উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান সরকার। সরকারকে এইজন্য কঠিন ও কঠোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সরকার প্রধান বার বার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কান দিচ্ছি না। আমাদের কান দিতে হবে। সকলকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘না’ বলতে হবে। যেমন মাদককে ‘না’ বলতে হবে তেমনি দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে হবে একযোগে, এক সাথে। সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘না’ সূচক সূচি গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের মধ্যে দুর্নীতি মুক্ত থাকার ঘোষণা দিতে হবে। তবেই দেশে, সমাজে রাষ্ট্রে দুর্নীতির সংক্রামক হ্রাস পেতে থাকবে।


২। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, কঠোর ভূমিকা গ্রহৎণ করতে হবে। বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বিচার বিভাগের ভূমিকা আমাদের নিকট অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও দৃশ্যমান হবে।


৩। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি মজবুত, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। দেশের সকল পর্যায়ে নির্বাচনকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সঠিকভাবে করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার ভূমিকার রাখতে হবে। জবাবদিহিতামূলক নির্বাচন না করতে পারলে নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে জবাবদিহিতা আসবে না। জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা, ভয় ও জবাবদিহিতা না থাকলে কখনো দুর্নীতি হ্রাস পাবে না। এই ক্ষেত্রে স্বচ্ছ, যোগ্য, সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। রাজনৈতিক দলের ইঙ্গিতে কমিশন কাজ করা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ভারত, আমেরিকার নির্বাচন কমিশনের অনুসরণ করতে হবে।


৪। সকল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ, সৎ ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রশাসনকে সবসময় নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। প্রশাসন জনগণের জন্য। কোন রাজনৈতিক দলের নয় – তা মনে করতে হবে। তবেই দুর্নীতি দমনে প্রশাসনের ভূমিকা দৃশ্যমান হবে। দুর্নীতি হ্রাসে একমাত্র বড় শক্তি প্রশাসনের কর্তাদের সততা, নিষ্ঠা ও চেষ্টার উপর।


৫। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে মানুষের জন্য আরও বেশি কাজ করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের দক্ষতা, সততা, নিরপেক্ষতার উপর সকল পর্যায়ে দুর্নীতি হ্রাসে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। নিজ নিজ দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করার জন্য সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সত্যিকার অর্থে নিশ্চয়তা দিতে হবে। শুধু মুখে বলা নয়, বাস্তবে নিশ্চয়তা দেয়ার মাধ্যমে দেশে দুর্নীতি হ্রাস করে উন্নয়নের সূচককে আমরা এগিয়ে নিতে পারি। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পৌছতে হলে দুর্নীতিকে অবশ্যই আমাদের অতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে ২০৪১ সালের উন্নত দেশে উন্নয়ন হওয়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। সকল উন্নয়ন আমাদের দৃশ্য থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তা অবশ্যই আমরা কেউ চাই না।


৬। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি দমনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিগত এক বছর ধরে শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতির যে চিত্র আমরা দেথকে পেলাম তাতে পুরো জাতি হতবাক। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের দুর্নীতির সংবাদ আমাওেদর শিক্ষামহলে হতাশা এনেছে। কিন্তু কোন অভিযোগের এখন পর্যন্ত সুরাহা হয় নাই। তাই দুর্নীতি শিক্ষা বিভাগে বেগমান রয়েছে। মাত্র কয়দিন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিনজন শিক্ষকের অনিয়ম, অনীতি ও চৌর্যবৃত্তির জন্য সাজা কিছুটা দিয়েছে। কিন্তু এ সাজা খুবই নগণ্য। তাদেরকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে শাস্তি দেয়া উচিত। তা হলে দুর্নীতি কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।


আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ আইনের সংশোধন করে শিক্ষক রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন শিক্ষক রাজনীতি রাজনৈতিক দলসমূহের লেজুর বৃত্তিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা চর্চা, গবেষণা এখন বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষার মানও কমেছে।
অন্যদিকে শিক্ষাকে গণমূিখ, বাস্তবমূখি ও জীবনভিত্তিক করার জন্য সকল স্তরে কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হবে। তাতে শিক্ষায় মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম কমে আসবে। জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে উন্নত বাংলাদেশ আশা করা কঠিন হবে। দুর্নীতি সূচকে উন্নয়নের স্বার্থে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে শিক্ষা নীতি ও ব্যবস্থায় ব্যাপক বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। উন্নত দেশের আদলে শিক্ষানীতিকে নতুন করে তৈরি করা প্রয়োজন।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments