Syed Al Faruk

সৈয়দ আল ফারুক
বাংলাদেশের শিশু সাহিত্যে একটি দীপ্র নাম

“তুমি তো সংসার ছেড়ে দু’বছর আলাদা বাড়ীতে
তবু কেন আমাকে ডাকোনি
প্রকাশ্যে, গোপনে যারা প্রাণপন তোমাকে চেয়েছে
কারো কথা গায়েও মাখোনি
নীরবে, নিভৃতে তুমি আছো একা সব ছেড়ে ছুড়ে
আমি কিন্তু কাউকে ছাড়িনি
গৌতম-বুদ্ধের মতো ধ্যানমগ্ন কাটাচ্ছো সময়
তুমি পারো, আমি তা পারিনি।”

কবিতাটি সৈয়দ আল ফারুক এর ‘অতুলনীয়’ কবিতা। কবি ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ এবং কবিতা সমগ্র-১ প্রথম কবিতা। বেশ সুন্দর কবিতা। নারীবাদী লেখক নারীকে নিয়ে লেখার কবিতাটি নিশ্চয় খুব প্রিয়। তা না হলে দুটি বৃহৎ গ্রন্থের প্রথম কবিতা হতো না।
সৈয়দ আল ফারুকের কবিতার বিষয় নারী, স্বপ্ন রমণী, রক্ত মাংসের নারী, স্বদেশ মাটি, সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ ও সমসাময়িক ঘটনা। স্কুল জীবন থেকে কবিতার প্রতি তার আগ্রহ, চর্চা, লেখ্ াপ্রথম কবিতা লিখেন কৈশোরে ১৯৬৯ সাল্ েতাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘উড়োখুড়ো মন’ ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর কবি হিসাবে তাঁর প্রতিষ্ঠা।
সৈয়দ আল ফারুক এর জন্ম ১৯৫৯ সালে ১২ই এপ্রিল। বাবা: সৈয়দ বদরুল আলম, মা : জাকিয়া আলম। ল²ীপুর জেলার টুমচর গ্রামে কবির জন্ম। বেড়ে উঠা শৈশবে গ্রামে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ অনার্স, এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ও প্রমান্য চিত্র নির্মাতা নাহিদ নাজিয়া ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে একই বিভাগ থেকে অনার্সসহ এমএ
ডিগ্রী অর্জন করেন। একমাত্র পুত্র অরণ্য সৈয়দ ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে হিস্ট্রি ও জার্নালিজমে অনার্স, আন্তর্জাতিক উপর মাস্টার্স, বর্তমানে গবেষণা ও লেখালেখিতে সময় পার করছেন।
আমার সঙ্গে সৈয়দ আল ফারুকের পরিচয় একজন তৈরি পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তা হিসাবে। যখন আমি বিজিএমই একজন শিল্প উদ্যোক্তা হিসাবে ১৯৮৪ সালে সদস্য হলাম, তার কয়েক বছরের মধ্যে কবি সৈয়দ আল ফারুকের সঙ্গে বিজিএমই অফিসে পরিচয়। তিনি একজন বড় মাপের তৈরি পোশাক শিল্পের বিনিয়োগকারী শিল্পপতি হিসাবে জানি। কিন্তু আজকের বিষয় আমাদের কবি সৈয়দ আল ফারুক।
কবি সৈয়দ আল ফারুক শুধু একজন কবি নন। তিনি একজন ভাল ছড়াকারক, গল্প লেখক, কিশোর উপযোগী গল্প লেখক। কি ছড়া, কি গল্প, কি কবিতা সব বিষয়ে উজ্জ্বল তাঁকে সত্তর দশকের একজন শীর্ষস্থানীয় শিশু সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিতি এনে দিয়েছে।
অশ্রæতপূর্ব শ্রæতিসুখকর অন্তমিল প্রয়োগ, বৈচিত্র্যময় আঙ্গিক রচনা, নিপুণ নিখুঁত ছন্দ সৃষ্টি সৈয়দ আল ফারুকের ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অসংখ্য স্মৃতিধার্য ছড়ার সৃষ্টিকর্তা, এ লেখকের আরও রয়েছে বিস্ময়কর স্মরণীয় কিশোর কবিতা।
কিশোর কবিতা, ছড়া-আমাদের নানা দিকে চিন্তার খোরাক জোগায়। ছোট মণিদের জন্য উপযোগী লেখা পড়লে মনটা কেমন যেন হালকা হয়ে আসে। লেখকের লেখা ‘যদি’ ছড়া আমাদের বেশ আনন্দ দেয়-

“ছোট্ট মুনা দেয়াল জুড়ে
আঁকছে ছবি বাঘের
একটু শুধু বাকি আছে
ডোরা কাটা দাগের।
বাঘটা যদি দেয়াল থেকে
লাফিয়ে বলে হালুম
মুনার তখন কী হবে তা
করতে পারো মালুম।”

কবি শুধু ছোটদের হাসির জন্য, আনন্দ দেয়ার জন্য ছড়া লিখেন নাই্ সমাজের নানা অনিয়ম, অসুন্দর বিষয়গুলোকে ছড়াতে এনে সমাজ সংস্কারের জন্য জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার ছড়া গ্রন্থ “সবার ওপরে মুক্তিযোদ্ধা” গ্রন্থে দুঃখী মানুষের জীবনযাপনের চিত্র ‘ফুটপাতে’ শীষৃক ছড়ায় লিখেন :

“চট গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকে ওরা
ফুটপাতে
ঘুমাতে পারে না হাজারও দশা
উৎপাতে
চটে তো আবার লেপের মতন
উস নেই
শুয়ে জেগে থাকে-দু চোখে ওদের
ঘুম নেই।”

সৈয়দ আল ফারুক একজন দক্ষ ছোট গল্প ছোটদের উপযোগী করে উত্তম লেখক। অভাবনীয় উপমা, মিষ্টি শব্দচয়ন, টুকরো চিত্রকল্প সব মিলিয়ে প্রতিটি কবিতাই স্বতন্ত্র, শক্তিশালী। বিচিত্র বিষয়, অপূর্ব বর্ণনা এবং মোহনীয় ভাষা তাঁর শিশু কিশোর গল্পগুলোর মুল প্রাণশক্তি। তাই লেখা বাহুল্য সৈয়দ আল ফারুকের প্রতিটি ছড়া, যে কোন কবিতা কিংবা সবগুলো গল্পই পাঠকের মনে তোলে পুতঃস্ফুর্ত তোলপাড়। সৈয়দ আল ফারুকের ছড়া কবিতা, গল্পের জগৎ এমন এক মোহনীয় জগৎ যেখানে কেবল ছোটদের নয়, সব বয়সীদের সমান প্রবেশাধিকার সমান আনন্দ।
শুধু শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়Ñ সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও এই সব্যসাচী লেখক ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ১৮টি ছোটদের বই, ১৯টি কাব্যগ্রন্থ মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থ সংখ্যা ৪২টি। ছোটদের বই মধ্যে রয়েছে : ছবির মধ্যে ছবি (১৯৯০), বদলে যেতে যেতে (১৯৯০), বাংলাদেশে বল দুটো (১৯৯৮), স্বপ্নের নাম সত্যি (১৯৯৮), সাহেবের মামা (২০০০), আমার আমি (২০০৮), সামনে থাকার মানে (২০২১)।
সৈয়দ আল ফারুকের কাব্য গ্রন্থের মধ্যে প্রধান প্রধান কয়টি উল্লেখ করছি। কাব্যগ্রন্থ : উড়োখুড়ো মন (১৯৮২), তুমি খাপ খোলা তলোয়ার (১৯৯৮), এক মিনিট ভালোবাসা পালন করুন (২০০২), চলে যাচ্ছি, বলে যাচ্ছি অপেক্ষায় থেকো (২০১২), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০৩), কবিতা সমগ্র-১ (২০১৪)।


সৈয়দ আল ফারুক কবিতা, ছড়া, ছোটদের গল্প প্রভৃতি লেখার পাশাপাশি কিছু প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা বেশ কম। চোখে পড়ার মত প্রবন্ধ আমার হাতে এসে পৌছেনি। তবে তাঁর কবিতা সমগ্র-১ একটি প্রবন্ধ দেখতে পেলাম। শিরোনাম ‘এ রকম চিঠি পাওয়া ভাল।’ তিনি লিখতে গিয়ে কবিতার মত করে লিখে ফেলেছেন। তাই প্রবন্ধের শুরুতে লেখক নিজেই লিখেছেন :
তোমাকে খুব লিখতে ইচ্ছে করছে। কতদিন থেকে লিখি না। কিন্তু কিছু লিখতে গেলেই তা কবিতা হয়ে যায়। ছন্দ খুব বিরক্ত করে আমাকে। ছন্দের জন্য, ভাবের জন্যে শান্তিমত আর চিঠি লেখা হয় না আমার। এর জন্য খারাপ লাগে আমার।”
তাই সৈয়দ আল ফারুককে নিয়ে আমরা কবিতা, ছড়া, ছোট গল্পে থাকি। তাতে সৈয়দ বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছেন।
সৈয়দ আল ফারুক নতুন নতুন দেশে বেড়াতে বেশ পছন্দ করেন। বেড়িয়েছেন অনেক দেশে। তবে বেশী সময় কলিকাতা ও লন্ডন গিয়েছেন নানা কারণে। ‘হিথ্রো এয়ারপোর্টে প্লেন ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে’ শিরোনামে কবিতাটি :

“লন্ডন, তুমি তো স্বাক্ষী
তুমি খুব ভাল করে জানো
আমি তাকে কতটুকু চাই
কতটুকু ভালবাসি
যাকে আমি রাজকন্যা ডাকি
লন্ডন, তুমি তো স্বাক্ষী
তুমি খুব ভাল করে জানো
কেন আমি ছুটে যাচ্ছি
কাকে আমি সোনামনি ডাকি
লন্ডন, তুমি তো স্বাক্ষী
তুমি তো ভাল করে জানো
তাকে আমি কতটুকু চাই
যাকে আমি পিচ্চি বলে ডাকি
লন্ডন, তুমিই বলো
কখন যে কাছে পাবো তাকে।”

সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি কবি সৈয়দ আল ফারুক সাংবাদিকতাও করেছেন। নব্বইয়ের সাড়া জাগানো ‘সাপ্তাহিক আকর্ষণ’ সম্পাদক, লন্ডন থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ‘কারি লাইফ’ এর এশিয়া এডিটর হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিল্পীদের প্রতিষ্ঠান মুলধারা এবং ছোটদের লেখক, প্রকাশক ও সংগঠনের প্রতিষ্টান শিশু সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের স্থাপনা সদস্য।
সত্তুর দশকের প্রধান কবি ও শিশু সাহিত্যিক হিসাবে নিজকে প্রতিষ্ঠা করলেও তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলা সংস্কৃতি বিকাশে ব্যাপক ভুমিকা রেখেছেন। মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। পাঠ অভিনয়েও পারদর্শী সৈয়দ আল ফারুক মঞ্চে ও ভার্চুয়াল মাধ্যমে সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, পরিচালনা ও পরিকল্পনায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।
ইতিমধ্যে সৈয়দ আল ফারুক তার সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে বিদেশে বহু সম্মানে ভুষিত হয়েছেন। যদিও এখনও একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক পান নাই। তবে অন্যান্য বহু পদক ইতিমধ্যে তার ঝুড়িতে এসে পড়েছে। তিনি পেয়েছেন ডাকসু সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), নাট্যসভা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০), শিমু উন্নয়ন পুরস্কার (১৯৯৭), শিশু একাডেমী অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৪০৪), নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩), কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (২০১৪), আনন্দ ধারা পুরস্কার, ইউকে (২০১৫), জীবনানন্দ দাস স্মৃতি পুরস্কার (২০১৬) পশ্চিমবঙ্গ, চ্যানেল আই সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮) প্রভৃতি।
সৈয়দ আল ফারুক নিয়মিত লিখছেন কবিতা, গল্প, ছড়া। কিন্তু কবিতা তার জীবন। কবিতাকে তিনি বেশী ভালোবাসেন। তিনি নারী, নারীর ভালবাসা ও নারী জীবনের রহস্য, নানা বিষয়ে তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে। তবে অধিক পরিমাণে দেখা যায় নারীর প্রতি ভালবাসার নানা বর্ণনা, নানা রূপ, কল্পনা। নারীর প্রতি যেমন ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতায়, তেমনি নারীর সম্মান মর্যাদা রক্ষায় তার কবিতা তীক্ষè বাক্য রয়েছে। যেমন তিনি ‘লোক লজ্জা সম্মানের ভয়ে কে করে প্রকাশ কবিতায় বলেন :
‘এ কেমন বাংলাদেশ অরক্ষিত নারীর শরীর।
এ কেমন বাংলাদেশ অরক্ষিত জীবন সম্ভ্রম’
এ কেমন বাংলাদেশ আলো অন্ধকারে আর কালো অন্ধকার
মালীরা ফুলের পরিচর্যা ছেড়ে পাপড়ি ছিঁড়ে যায়।”
শিশু সাহিত্যে সৈয়দ আল ফারুক বেশ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তার লেখা ছড়া, কবিতা ও শিশু কিশোর গল্প সমাজে বেশ জনপ্রিয়। তিনি শিশুদের খুব ভালবাসেন। শিশুদের নিয়ে চিন্তা করেন। শিশুদের ভবিষ্যত গড়ার পরিকল্পনা করেন। নানা সভায় শিশু বিকাশে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তাই তার শিশু বিষয়ক লেখা সকলের আগ্রহের কারণ। ‘আরো একবার শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন’। শিরোনামে কবিতায় বলেন :

“যুদ্ধ থেকে শিশুকে রক্ষা করুন
এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধ করুন
শিশু নির্যাতন ও শোষণ বন্ধ করুন
শিশুর কথা শুনতে হবে
শুনরে তিনি স্বাক্ষর করলেন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
আমাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েছেন বলে।”

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments