“বহু সুকৃতি জ্ঞানীগুণী মহান ব্যক্তি সন্দ্বীপের মাটিতে জন্ম গ্রহণ করে আপন আপন কৃতিত্বের গুনে সমগ্র দেশে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে গেছেন। কিন্তু তাদের জীবনচরিত সুপরিকল্পিতভাবে লিপিবদ্ধ না থাকায় অনেকের পূণ্য গাঁথা বিস্কৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনুসন্ধান করা হলে এই সব বিচিত্র প্রতিভাসম্পন্ন মনীষীদের সম্পর্কে নানা মূল্যবান তথ্য অবগত হওয়া যাবে। এই সকল মহাত্মগণের সাধ্য-সাধনা, উত্থান-পতন প্রভৃতি ঘটনাবলী ও চরিত্রাবলী হতে ভবিষ্যত বংশধরগণ বিশেষ শিক্ষা ও আদর্শ গ্রহণ করতে পারেন।”
বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, সন্দ্বীপের কৃতি সন্তান এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী লেখা ‘সন্দ্বীপের কৃতী সন্তান যাঁরা আজ নেই’ গ্রন্থের ভূমিকায় উপরের অংশটুকু। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি এই বই প্রকাশ করেছেন ২০০৮ সালে। আজকে ২০২০ সাল।
কয়েকদিন পূর্বে হঠাৎ করে সন্দ্বীপের বিশিষ্ট ডাক্তার লেখক, রুমি আলম আমাকে টেলিফোন করলেন। বললেন এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে তার উপর একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হবে। ‘আপনি ছিদ্দীক চৌধুরী’ সম্পর্কে একটি লেখা দেবেন।
দেশে এখন করোনা কালীন সময় চলেছে। বিগত ২৪শে মার্চ ২০২০ সাল থেকে সরকার প্রায় দু’মাসের মত সব কিছু ‘লকডাউন’ করে করোনা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছেন। তাই অনেক দিন ধরে বেশী সময় বাসায় আমাদের সময় কাটাতে হয়।
এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর সঙ্গে কবে, কখন, কিভাবে আমার পরিচয় ঘটেছে, তা এখন মনে নাই। তবে পরিচয় হওয়ার পর থেকে নিয়মিত আমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। একজন লেখক, গবেষক, জ্ঞানী ব্যক্তির কারণে তাকে আমার অফুরন্ত শ্রদ্ধা সব সময় ছিল, আছে, থাকবে।
এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর জন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৩৫ সাল। বাবার নাম মোহম্মদ ইছমাইল চৌধুরী, মা বেগম আফরোজ চৌধুরী। তার বাবা একজন ভিলেজ হেডম্যান ছিলেন। একসময় তিনি বরিশালে শহাবাজপুরে শেরে বাংলা এক কে ফজলুল হকের এস্টেটে চাকুরী করতেন। বাবা অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। সন্দ্বীপ উপজেলা বাউরিয়া ইউনিয়নে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর জন্ম স্থান। তখন বৃটিশ শাসন আমলে
নিজের গ্রামে বাউরিয়া বোর্ড স্কুলে তার শিশু শিক্ষা শুরু হয়। হরিশপুর বোর্ড স্কুল থেকে তিনি তৃতীয় শ্রেণী পাশ করেন।
১৯৪৩ সালে ছিদ্দীক চৌধুরী হুগলি জেলায় আরামবাগ মহকুমায় তার ভগ্নিপতি মোহাম্মদ আমিন উল্ল্যা মিয়ার সঙ্গে চলে যান। ঐখান থেকে তিনি চতুর্থ শ্রেণী পাশ করেন। ১৯৪৫ সালে ফের সন্দ্বীপে এসে সন্দ্বীপ হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫১ সালে ঐ স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন।
১৯৫৩ সালে ছিদ্দীক চৌধুরী ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজে বিএ ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে বিএ পাশ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি কোর্স সমাপ্ত করেন।
স্কুল জীবন থেকে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী রাজনীতি সচেতন ছিলেন। স্কুল জীবনে সন্দ্বীপ টাউনে থাকা কালীন তিনি মুসলিম লীগের উদ্যোগে পাকিস্তান আন্দোলনে মিছিল-মিটিং যোগন দিতেন। সক্রিয় কর্মী হিসাবে মিছিলে শ্লোগান দিতেন বেশ চমৎকার ভাবে।
জগন্নাথ কলেজ পড়ার সময় রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। ২১শে ফেব্রæয়ারি ১৯৫২ সালে জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় উপস্থিত ছিলেন।
১৯৫৪ সালে বিএ ভর্তি হওয়ার পূর্বে ছিদ্দীক চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী সৈয়দ আবদুল মজিদের পক্ষে সন্দ্বীপে প্রায় ছোট বড় মিলিয়ে ত্রিশটি জনসভায় বক্তৃতা করেন। তিনি ছিলেন তখন ঐ সময় একমাত্র ছাত্র বক্তা। তার বক্তব্য শোনার জন্য মানুষের বেশ আগ্রহ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ল’ পাশের পর ১৯৬০ সালে পাকিস্তান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগে অডিটর পদে চাকুরী শুরু করেন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার হিসাবে চাকুরী শেষে অবসরে যান।
১৯৬৬ সালে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী গাছুয়া ওয়াহিদুল মাওলা চৌধুরীর মেয়ে সবিতা খুরশিদ চৌধুরীর সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সিফাত শারমীন চৌধুরী বিএ (অনার্স) এমএসএস করে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে একটি কলেজে অধ্যাপক। ছেলে ইবরু-আল কায়েস চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত। ছোট মেয়ে ইফফাত শারমীন চৌদুরী বর্তমান আমেরিকাতে পিএইচডি করার পর কর্মরত আছেন।
ছিদ্দীক চৌধুরী ছিলেন একজন সফল সরকারি কর্মকর্তা। ছাত্র জীবনে করেছেন পাকিস্তান আন্দোলন আর ভাষা আন্দোলন। তাই তিনি একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন। যদিও সেই হিসাবে তাকে আমরা সেই মর্যাদা দিতে পারি নাই। ১৯৭১ সালে ছিলেন একজন একনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিক। নিজকে আজীবন নানা সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত রেখেছেন। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তার বড় পরিচয় হলো তিনি একজন সফল ইতিহাসবিদ। সন্দ্বীপের ইতিহাসের একজন নিমগ্ন গবেষক। অতীত খুঁড়ে তুলে এনেছেন নিজের জন্মভূমির ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধ ইতিহাস। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে রেখে গেছেন তাদের অনেক ঠিকানা। এভাবে নিজেকে তুলে এনেছেন সমকালীন সন্দ্বীপের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনন্য অধিকার।
সন্দ্বীপের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা কর্মকান্ডে নিবেদিত প্রাণ এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী। জড়িত ছিলেন জীবনের শুরু থেকে সন্দ্বীপের নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সংগঠনের সঙ্গে। সন্দ্বীপকে নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আন্দোলনে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণকর্মী। তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন ঐতিহাসিক গবেষক হিসাবে। বিশেষ করে সন্দ্বীপকে নিয়ে তার সমগ্র গবেষণার ফসল। তার সবচেয়ে বেশী সমৃদ্ধ, তথ্য নির্ভরশীল গ্রন্থ ‘শাশ্বত সন্দ্বীপ’। এই গ্রন্থের পাÐুলিপি তিনি তৈরি করেন ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৬ সালের জন্যে। তবে বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে।
আমরা যখন স্কুল, কলেজের ছাত্র ছিলাম, তখন সন্দ্বীপের ইতিহাস নিয়ে কথা উঠলে ছিদ্দীক চৌধুরীর কথা জানতাম। সন্দ্বীপের ইতিহাস একজন লিখেছেন, তিনি হচ্ছেন বাউরিয়া নিবাসী এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী। তবে বইটি অনেক বড় আমার পড়ার সুযোগ হয়েছিল।
তাই ছিদ্দীক চৌধুরী বলতেন, “সাহিত্যের পরিধি ব্যাপক। এর অনেক শাখা-প্রশাখা, অনেক বৈচিত্র্য। এমনি এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দিক হচ্ছে জীবন চরিত বা জীবন কাহিনী। সাহিত্যের অন্যান্য শাখা-প্রশাখায় যেমন আনন্দের বিচিত্র সমারোহ, তেমনি জীবন কাহিনীর মধ্যেও আনন্দের স্পর্শ বিদ্যমান। তাই অন্যান্য সাহিত্যের মতই জীবন চরিত পাঠ করে আনন্দ লাভ করা যায়, অনেক তথ্য জানা যায়, অনেক ইতিহাস জানা যায়, তবে অপরাপর সাহিত্য সৃষ্টির চেয়ে জীবন কাহিনীর বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য ভিন্নতর এবং পাঠকের নিকট তার আবেদন ও গুরুত্বপূর্ণ। জীবন চরিত বা জীবনী রচনা করা হয় কোন আদিম মানুষের কর্মময় জীবনের কাহিনী অবলম্বন করে। যে কোন মানুষের জীবনী রচনা করা চলে না। যার জীবনের ঘটনা প্রবাহ থেকে কোন কিছু শিক্ষণীয় থাকে না, অথবা যার জীবনে অনুকরণীয় কোন আদর্শ নেই তার জীবনী অবলম্বনে সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে যে মানুষের আদর্শ জীবন পরবর্তীকালে মানুষের নিকট শিক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে সেই আদর্শ জীবন চরিত্র রূপায়িত হয়ে উঠে এবং তা পাঠ করে পরবর্তীকালে মানুষ যথেষ্ট শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়। লেখকের সন্দ্বীপের কৃতী সন্তান যারা আজ নেই গ্রন্থের ভূমিকা থেকে পাঠকের সুবিধার জন্য উদ্ধৃতি করা হলো। এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী কি মানুষের মানুষ ছিলেন, কি ধরনের চিন্তা করতেন, গবেষণা করতেন, তা তার ক্ষুদ্র অংশ থেকে আমরা বুঝতে পরি।
২০১০ সাল থেকে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ আলাপ। একত্রে আমার অফিসে বসা। চা পান করা। কখনো দুপুরের খাওয়া ও আমরা একত্রে আমার ইয়ূথ টাওয়ার, ৮২২/২ রোকেয়া স্মরণী অফিসে একত্র হওয়া সুযোগ হয়েছিল। অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদা মাটা মানুষ ছিলেন। ২০১০ সালে যখন চিন্তা করলাম সন্দ্বীপের সব সময় মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে লেখা হয়, বই হয়, আলোচনা হয়। কিন্তু জীবিত গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে তাদের জীবন কালে কেউ লেখে না, বই প্রকাশ করে না ইত্যাদি। তাই আমার চিন্তায় আসলো সন্দ্বীপের জীবিত গুণী ব্যক্তিদের জীবন চরিত নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করা যায় কিনা! নানা ব্যক্তির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। এক সময় ছিদ্দীক চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি আমাকে বেশ উৎসাহ দিলেন। বললেন সব ধরনের সহযোগিতা করবেন। আমার প্রায় দুই বছর লেগেছিল ‘সন্দ্বীপের শত ব্যক্তিত্ব” বইটি গুণীজনদের জীবন-চরিত সংগ্রহ করতে। তাই বইটি ছাপা হয়েছে এপ্রিল ২০১২ লেখালেখি প্রকাশনী থেকে। বইটিতে ১০৩ জনের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির জীবন চরিত রয়েছে। তবে বইটির নাম দেয়া হয়েছে ‘সন্দ্বীপে শত বক্তিত্ব’। উক্ত বইটিতে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী চমৎকার একটি জীবন কাহিনী ছাপানো হয়েছে।
উক্ত গ্রন্থে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর জীবন চরিতে শুরুতে যা লেখা হয়েছে:
“সন্দ্বীপে স্বাধীন রাজা দেলোয়ার খাঁ ওরফে দিলাল রাজার ছিলেন এক ছেলে আর দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম মুছা বিবি আর ছোট মেয়ের নাম মরিয়ম বিবি। মুছা বিবির বিয়ে হয়েছিল পরগণা সন্দ্বীপের ইজারাদার চাঁদ খাঁর সঙ্গে। তাদের চার ছেলে। জুনুদ খাঁ, মুকিম খাঁ, সোরুল্ল্যা খাঁ আর নোরুল্ল্যা খাঁ। তৃতীয় ছেলের সপ্তম অধ:স্থন পুরুষ হলেন বর্তমান সন্দ্বীপের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী।”
কাজেই আমাদের বুঝতে কোন কষ্ট হচ্ছে না যে, ছিদ্দীক চৌধুরী উঁচু বংশের সন্তান ছিলেন। সন্দ্বীপের বিশিষ্ট, ঐতিহাসিক বংশধর সম্পন্ন পুরুষের ঘরে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর জন্ম, বেড়ে উঠা, আমাদের মাঝে দীর্ঘ দিন বেঁচে থেকে ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছেন।
এ ব্যক্তিটি সন্দ্বীপের এক কোণে জন্ম নিয়ে বেশ আলো ছড়িয়েছেন। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে আমরা তাকে সম্মান করতে পারি নাই। এমন কি আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রামে সন্দ্বীপের নানা সমিতি, সমাজ কল্যাণ সমিতি, সাহিত্য সংগঠন গুলোও জীবিত থাকা অবস্থায় এই ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখাতে পারে নাই। তাই আমরা লজ্জিত।
এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর অসাধারণ জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তি ছিলেন। আজীবন সন্দ্বীপ নিয়ে ভেবেছেন, গবেষণা করেছেন, লিখেছেন, অনেক বই ও ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন।
তার রচিত মৌলিক গ্রন্থ সমূহ হচ্ছে: শাশ্বত সন্দ্বীপ (১৯৮৮), মুক্তিযুদ্ধে সন্দ্বীপ (১৯৯৮), সন্দ্বীপের বৈচিত্র্যময় লোক সাহিত্য (২০০৪), সন্দ্বীপের কৃতি সন্তান যারা আজ নেই (২০০৮), অতীতের এক টুকরো (২০০৯), গণ মানুষের দরদী এ. কে. এম রফিকুল্ল্যাহ চৌধুরী (২০১১), ইতিহাস ঐতিহ্যের কালা পানিয়া (২০১২), বাউরিয়া ইউনিয়নের ইতিবৃত্ত (২০১৩), সন্দ্বীপে ইসলাম (২০১৪)।
এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর সম্পাদিত গ্রন্থ সমূহ হচ্ছে: ৭০ বর্ষে সন্দ্বীপ মডেল হাইস্কুল (২০০৪), ৭৫ বর্ষে সন্দ্বীপ মডেল হাই স্কুল (২০০৮), উচ্ছ¡াস (২০০৯), মুহাম্মদ আমিন উল্যাহ স্মারকগ্রন্থ (২০১০), মৌ মোঃ আলি আকবর বিএবিটি জন্ম শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ (২০১৩), ৮০ বর্ষে সন্দ্বীপ মডেল হাই স্কুল (২০১৩)।
তিনি কিছু সংকলনেরও সম্পাদক ছিলেন। যেমন: একজন বাঙালী মুসলমান বীর (২০১১), উড়িরচর: অতীত ও বর্তমান (২০১৩)।
ঢাকাস্থ সন্দ্বীপ সমিতির বার্ষিক ম্যাগাজিন তিনি অনেক বর্ষ ধরে সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তখন ঢাকাস্থ সন্দ্বীপ সমিতি অত্যন্ত মার্যাদাবান সংগঠন ছিল। সকল শ্রেণীর, শিক্ষিত, সকল পেশার মানুষ সন্দ্বীপ সমিতি, ঢাকার সভায় অংশ গ্রহণ করতো। এটি অনেক দিন পর্যন্ত সকলের প্রিয় সংগঠন ছিল। তখন এতে কোন রাজনীতি ছিল না। সমিতি নিয়ে কেউ তখন রাজনৈতিক ফায়দা লাভেরও চেষ্টা করতো না। ‘রূপসী সন্দ্বীপ’ নামে উক্ত ম্যাগাজিনের প্রকাশনার দায়িত্বে এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তখন এই পত্রিকা অত্যন্ত মানসম্পন্ন সামাজিক ম্যাগাজিন ছিল। সন্দ্বীপের সমস্যা, সংস্কৃতি ইতিহাস নানা কিছু নিয়ে প্রতি বৎসর বের হতো।
যখন ২০০১ সালে সন্দ্বীপ সমিতির ঢাকার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করি। অর্থাৎ সভাপতির দায়িত্ব পালনকালীন সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ‘রূপসী সন্দ্বীপ’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনেক দিন পর বের হয়। আর এ পর্যন্ত ২০২০ সালে সন্দ্বীপ সমিতি, ঢাকা কোন সাময়িকী প্রকাশিত হয়নি। তবে ‘সন্দ্বীপ উন্নয়ন ফোরাম লিঃ প্রতি দুই বছর পর পর আমি ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা এর দায়িত্ব পালন করি। ‘রূপসী সন্দ্বীপ’ সম্পাদনা দায়িত্ব আমি পালন করি।
এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী সত্যিকার অর্থে একজন নিবেদিত ইতিহাস গবেষক ছিলেন। বিশেষ করে সন্দ্বীপ নিয়ে ছিল তার মূল গবেষণা। নানা বিষয়ে নানা সময় তিনি সন্দ্বীপ নিয়ে লিখে গেছেন। তার বিখ্যাত গবেষণা ধর্মী বই ‘সন্দ্বীপে ইসলাম’ এর ‘উপস্থাপনা’ শিরোনামে লিখেন, “এ কথা নিশ্চিত যে, বাংলার সমুদ্র উপকুলবর্তী অঞ্চলের সাথে আরবদের প্রাচীন সম্পর্ক রয়েছে। সিন্ধুদেশ, মালদ্বীপ, লঙ্কাদ্বীপ, সন্দ্বীপে, যারা, সুমাত্রা বোর্নিও ও মালয় উপকুলে যে রূপ আরবীয় বণিকগণ ইসলামের বাণী বহন করে নিয়ে যান, বাংলাদেশেও তেমনই তারা মুসলিম শাসনের বহু পূর্বে ইসলামের বাণী বহন করে এসেছিলেন। বাংলার যে অংশের সাথে আরবীয় বণিকদের প্রাচীনতম সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, তার ফলে পূর্ব ভারতের চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, সমন্দর আরবদের একটি বিশ্রাম স্থানও উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল।”
এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর আরও একটি গবেষণা ও তথ্য সমৃদ্ধ বই হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধে সন্দ্বীপ’। ১৯৯৮ সালে বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। উক্ত গ্রন্থে লেখা ‘সন্দ্বীপের পরিচিতি, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, পাক বাহিনীর সন্দ্বীপ হানা, গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যাত্রা, মাইট ভাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্প আক্রমণ, সন্দ্বীপ থানা ও টেলিগ্রাম অফিস আক্রমণ, গুপ্তছড়া ঘাটে সংঘর্ষ, বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, মুক্তিযুদ্ধের গান প্রভৃতি শীর্ষক বেশ কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে। চমৎকার ভাবে তিনি দেশের ১৯৭১ সালের প্রতিযুদ্ধ ও সন্দ্বীপবাসীর ভূমিকা ইতিহাসের জন্য চিত্রিত করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শীর্ষক নিবন্ধে সন্দ্বীপের কৃতি সন্তানদের বাহাদুরী ও সাহসের বর্ণনা দিয়েছেন।
‘মুক্তিযুদ্ধে সন্দ্বীপ’ গ্রন্থের ‘আমার কথা’ শিরোনামে লেখক এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী খুবই চমৎকারভাবে সন্দ্বীপের মানুষের চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তোলে ধরেছেন অতীত ইতিহাস থেকে সন্দ্বীপের মানুষের স্বাধীনচেতা চরিত্রের। বিদ্রোহের আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার মৌলিক ইচ্ছা গুলোকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি গ্রন্থের এই অংশে বলেন:
“সন্দ্বীপের লোকেরা যুগে যুগে মগ, পর্তুগীজ হার্মাদ, অত্যাচারী তালুকদার, জমিদার, চৌধুরী, আড়তদার, বন্দোবস্তকারী, বিয়াল্লিশ সালের (১২৪২ বঙ্গবদ) জরিপ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, মোগল ও বৃটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্যে। সে সব সংগ্রামে তারা কখনও জয়ী হয়েছে আবার কখনও কখনও হয়েছে পরাজিত। সন্দ্বীপবাসী উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আবার গর্জে উঠে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে। সেদিন সন্দ্বীপের অকুতোভয় সন্তানেরা জীবনবাজী রেখে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, দুর্গম পাহাড় পথ, নদী-নালা, খাল-বিল অতিক্রম করে ভারতে ছুটে যায় গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য। তখনকার সেই সংগ্রামী চেতনা, উৎসাহ উদ্দীপনার ইতিহাস ভুলবার নয়। জাতি মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্যবীর্য ও দেশপ্রেমের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে চিরদিন স্মরণ রাখবে।”
এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরীর সর্বশেষ বই ‘সন্দ্বীপের লোক সাহিত্য’ একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, ইতিহাস সমৃদ্ধ, সাহিত্যের মূল খোরাক হিসাবে সাহিত্য মহলে সমাদৃত। তিনি তার অমর কৃর্তির জন্য চিরদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। যদিও তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে অপারে ১৫ই আগস্ট ২০১৭ সালে। এবিএম ছিদ্দীক চৌধুরী নিজের লেখালেখি সম্পর্কে আমি একবার জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: “আমি মনের আনন্দে লিখি। বাঁচার জন্যে লিখি। নিজে যা জানি, তা অন্যদের জানানোর ইচ্ছে থেকেই লিখি।“
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।