Emajuddin Ahmed

কালের জ্যোর্তিময় শিক্ষক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ

“আমাদের আদর্শিক পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য ব্যক্তি ও পেশাগত সত্তার বিকাশের জন্য উচ্চতর নৈতিক ও মানবিক আদর্শের উপমার জন্য আমাদেরকে বার বার ফিরে যেতে হবে ‘কালের জ্যোর্তিময় শিক্ষক’ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীনের কাছেই।”আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে কিছু লিখতে পারা আমি নিজকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। বিশাল এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু কথা, শুভ কামনা পাঠক সমাজে তুলে ধরতে পেরে আমি তাঁর ছাত্র হিসাবে অহংকার বোধ করছি। শুরুতে যে বক্তব্যটি অধ্যাপক, কবি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মাহফুজ পারভেজ সঠিক সত্য কথাটি বলেছেন। আমাদের জীবন চলার সমাজ গঠনে রাষ্ট্র পরিচালনায় এমাজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা গুরুর চরিত্র, জীবন, কর্মকৌশল, চলার পথের কার্যাবলী জাতির জন্য অত্যন্ত শিক্ষনীয়।


তাঁর অর্জন ও কর্মকীর্তির জায়গাটিকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় দীর্ঘ জীবনের সামগ্রিক গতিময়তার দিকে তাকালে এবং তাঁর সৃজন ও মননের প্রাণময়তার ঐশ্বর্যের জন্য বিপুল ও বিশালতার জন্য যুগ পদ বিস্মিত ও আনন্দিত হতে হয়।
রাষ্ট্র ও সামাজিক বিষয়ে বিদ্যায়তানিক সংগ্রামশীলতা নান্দনিক গবেষণা আর জ্ঞান চর্চার আধুনিক বিদ্যাবংশের প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের কালের জ্ঞান মার্গের শেষ ধ্রুপদী মুগল অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন ও অখন্ড বাংলার অন্যতম গৌরবময় জনপদ গৌড়ে ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৩২ অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর উত্তর বঙ্গের অবিভক্ত মালদহ জেলার কালিয়াচক থানার কালিনগরে।


অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সঙ্গে পরিচয় সম্পর্ক তাঁর বিশাল কর্মময় জীবনের তুলনায় খুবই সামান্য সময়। আমার কর্মজীবন শুরু হয় সরকারি চাকরি দিয়ে ১৯৮১ সালে। পরবর্তীতে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলাম। শুধু দুর্নীতি, অন্যায়, ঘুষ বাণিজ্যের প্রতিবাদে সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি গ্রহণের মাধ্যমে আমার কর্মজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু। ১৯৮৩ সালে বেসরকারি চাকরি ছেড়ে তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমার ব্যবসায়ী জীবনের যাত্রা শুরু হয়। আজও অবদি ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা, সমাজ চেতনার কাজে নিজকে নিয়োজিত রেখেছি।


আমার মুল বক্তব্য শুরুর পূর্বে অধ্যাপক ড.এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘সংবর্ধনা গ্রন্থ’ আমাদের চিন্তার জগতে বিশাল দ্বার খুলে দিয়েছে। উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, “অভিভাবকত্ব কতটা দায়িত্বশীল হতে পারে, তাঁকে না দেখলে আমরা জানতে পারতাম না। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে তাঁর মধ্যে মিলে মিশে একাকার হয়েছে পিতার হৃদয়। বিনয় ও কোমলতার মিলিত জোসনা তাঁকে দিয়েছে অতল গভীরতার স্নিগ্ধতা। তিনি দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। মেধা ও প্রতিভা তাঁর প্রকৃতিলব্ধ। তিনি প্রেমময় স্বামী। স্নেহময় দাদু। তিনি ধীর বিচক্ষণ ও প্রকান্ত। সহজ এবং অনাড়ম্বর কিছু ইস্পাতের দৃঢ়তা শিরায়। সঙ্কটে তিনি সকলের আশ্রয়, আশ্বাস। তাঁর আত্মার পরতে পরতে মিশে আছে এক পাললিক মানচিত্র, বাংলাদেশ তাঁর আশা ও আনন্দ। বাংলাদেশের সঙ্কট যেন তাঁর ব্যক্তিগত সঙ্কটের অন্য নাম। দেশের স্বার্থই যেন তাঁর ব্যক্তি স্বার্থের পরিপূরক।”


ড. আকবর আলী খান অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদকে ‘এমাজ ভাই’ বলে ডাকতেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম পরিচয় ঘটে ড. আকবর আলী খানের সঙ্গে সুদূর কানাডায় কিংশটন শহরে। ড. আকবর আলী সকলের ‘এমাজ ভাই’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বাঙালিদের মধ্যমণি ছিলেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন সকলের এমাজ ভাই। অসাধারণ অমায়িক ও অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল এই ব্যক্তিত্ব ছিলেন সকলের পরামর্শদাতা। সকলের বিপদে আপদে তিনি সকলের আগে এগিয়ে আসতেন। হাসি মুখে তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। বাঙালীদের বাহিরে ভারতীয় ও পাকিস্তানী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।”
ড. আকবর আলী খান এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে স্মৃতি চারণ ও আলোচনা করতে গিয়ে আরও নানা বিষয়ের অবতারণা করেন। তিনি বলেন, “অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের একটি বড় কৃতিত্ব হলো এই যে, তিনি একজন অত্যন্ত সফল পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা।”


“সৌভাগ্যবশত অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের মধ্যে পাণ্ডিত্য ও বাংলাপ্রীতির মণিকাঞ্চন সংযোগ ঘটেছিল। তাই তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তক সমূহ বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।”অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে ভূয়সী বক্তব্য রাখেন। তাঁর লেখা “এমাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব” শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেন, “প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদকে আমি বন্ধু হিসাবে জানি, তিনিও আমার ধারণা সেভাবেই আমাকে দেখেন।


এমাজউদ্দীন আহমদের অনেক গুণ, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর আন্তরিকতা ও স্বাচ্ছন্দ্য। মুখে সব সময বলেন না, কিন্তু আন্তরিকতাটা সব সময় টের পাওয়া যায়। আর আছে স্বচ্ছন্দে সব কিছু বক্তব্যেচমৎকার বলার ক্ষমতা। তিনি অধ্যাপনা করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন প্রশাসনিক, লিখেন,সভা সমিতিতে কথা বলেন, তিনি গ্রন্থমনস্ক কিন্তু তাঁর সব কাজে একটা নীরব ও সহজ স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষ্য করি। তাঁকে অনেক সঙ্কট পার হতে হয়েছে, আমাদের সময় ও সমাজে কেই বা সঙ্কটমুক্ত নয়। কিন্তু আমি তাঁকে কখনোই শান্ত প্রাণবন্ততা ছাড়া দেখিনি। তাঁর মতো মিষ্টভাষী মানুষও কম পাওয়া যায়।”


অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এর নিকট আমরা তাঁর সন্তান তুল্য। তিনি আমাদেরকে তাঁর সন্তানের মত স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। যখনি কখনও কোন প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কোন অসুবিধা হয়নি। যে কোন বিষয়ে পরামর্শ নেয়া আমার নিয়মিত কাজ ছিল। মাঝে মাঝে কাঠাল বাগান বাসায় গিয়ে দেখা করতাম।
১৯৯০ সালের পর থেকে নানা সভা সেমিনার তাঁর মুল্যবান বক্তব্য শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের সভায় তিনি হয়তো সভাপতিত্ব করছেন নতুবা প্রধান অতিথির বক্তব্য রেখেছেন। অল্প কথায় যুক্তিপর্ণ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তিনি রাখতেন। তাঁর বক্তব্য শুনার জন্য সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। ২০০৮ সালে আমার প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী লেখালেখির যাত্রা শুরু হয়্ প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে আমি বহু বছর ধরে জড়িত। আমার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক প্যানোরমা’ বহু বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। বেশ কিছু দিন পূর্ব থেকে “দৈনিক আজকের আওয়াজ” সম্পাদনা করছি। তাও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। লেখালেখির জন্য এমাজউদ্দীন আহমদ এর নিজস্ব লেখা বই প্রকাশের জন্য একটি পান্ডুলিপির জন্য অনুরোধ করলে খুবই সহজে দ্রæত সময়ের মধ্যে একটি বাংলায় ও অন্য একটি ইংরেজী বই এর পান্ডুলিপি আমাকে প্রদান করেন। যা পরবর্তীতে ২০০৯ সালে একুশে বই মেলায় ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’ এবং Bangladesh From East Pakistan নামে দুইটি বই লেখালেখি থেকে প্রকাশিত হয়।


মুক্তিযুদ্ধের উপর লিখিত বাংলা ও ইংরেজি লেখা বই দুইটি এক অনন্য মাত্রায় প্রকাশনা শিল্পের স্বল্প সময়ে বের হয়েছে।আকর্ষণীয় অসাধারণ লেখা বই দুটি। খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তথ্য, ডাটা চিন্তা চেতনার এক অপূর্ব সংযোজন।
রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তরে পাস পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস অত্যন্ত বিধুর। উপেক্ষা বঞ্চনা এবং নীপীড়নের বিরুদ্ধে প্রথমে প্িরতবাদ, তারপরে প্রতিরোধ এবং মার্চ শেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ অভিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হন। এই ছোট্ট বইটিতেউল্লেখিত হয়েছে যেভাবে পাকিস্তান অদূরদর্শী শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকে পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী জনসমষ্টির স্বার্থ বিরোধী নীতি অনুসরণ করেছেন এবং কিভাবে সেই বঞ্চনা জনসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত করে এবং চূড়ান্তপর্বে অনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে সুশাসন এবং স্বশাসনঅর্জনের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। এই অর্জন ছিল জনগণের অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিল জনগণের বিজয়। সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে, হাজারো ধারার রক্ত ঝরিয়ে, দীর্ঘ নয় মাসের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে জনগণ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন স্বাধীনতার রক্তরঞ্জিত পতাকা। প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এত চমৎকার সুন্দর তথ্যবহুলভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ বাংলা ভাষায় দ্বিতীয় কোন বই নাই। ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এবং Bangladesh From East Pakistan। বই দুটির উপর গবেষণা করা উচিত। আগামীতে নিশ্চয় শুধু মাত্র এই বইটির উপর পিএইচডি করার জন্য অনেক শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবেন।

লেখক এমাজউদ্দীন আহমদ তাঁর লেখা বই পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের মূল রহস্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন জন্মক্ষণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রাকৃতিক, জনমিতিক ও ভাষাগত বিভিন্নতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অর্থনৈতিক অবস্থান বিশেষ করে জনগণের প্রত্যাশা সংক্রান্ত যে কাঠামোগত ভিন্নতা তাই ১৯৭১ সালের বিস্ফোরণের প্রেক্ষাপট রূপে কাজ করেছে।”


আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধূমাত্র ৬ দফার মাধ্যমে সংঘটিত হয় তা নয়, নানা কারণ তার মধ্যে রয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের আলাদা দেশের প্রয়োজনীয়তা জাতি এক সময় অত্যন্ত সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। তাই পুরো জাতির ঐক্যবদ্ধভাবে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে এক সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়তে উৎসাহিত হয়েছিল। লেখক মাত্র ৮৪ পৃষ্ঠায় লিখিত গ্রন্থটিতে তীর্যক ভাষায় সুনির্দিষ্টভাবে যুক্তিপূর্ণ আকারে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট পাঠকের নিকট সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটিতে ৬টি বড় শিরোনামে সাজানো হয়েছে। প্রতিটি শিরোনামের অধীনে বেশ কয়েকটি উপ শিরোনামের খুবই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। উপ শিরোনামের সংখ্যাও মাত্র ৩২টি। বইটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্য চিন্তার খোরাক। গবেষকদের জন্য একটি অনন্য সৃষ্টি।


‘একজন কীর্তিমান পুরুষ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, “অনেক সময় অপরিচিত মানুষও নিজের নিকটবর্তী মানুষ হয়ে উঠেন। ঘনিষ্ঠতা একজন মানুষকে সব সময নিজের প্রার্থিত স্থানে নিয়ে না এলেও কাছাকাছি নিয়ে এসে জানার সুযোগ করে দেয়। এর প্রধান কারণ আন্তরিক অনুভূতি। মানুষ সামনে অগ্রসর হওয়ার পথে মাঝে মাঝে পিছনে তাকিয়ে সেই স্মৃতির চিত্র দেখে অভিভূত হয় অথবা খানিকটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তা সত্তে¡ও সেই রূপটি কোন ক্ষেত্রেই আর অস্পষ্ট থাকে না। এই স্মৃতি বিস্মৃতির আলোকে জড়িয়ে আছে চমৎকার অন্তরালে দুটো উজ্জ্বল চোখ আর মুখে স্মিত হাসি নিয়ে জীবনে তারুণ্য বিস্তৃতকারী একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ।’
“কর্মকে জীবনের প্রধান ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করায় কোন দায়িত্ব পালনে তাঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। সদা হাস্যময় একজন সফল এ্যাডমিনিসট্রেটর হিসেবে সর্বত্র তিনি দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনকে গতিময় করে তুলেছেন। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ,অধ্যাপক, পরিচালনা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে রেখে নিজের যে প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন, তার মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন স্বকীয় স্বরূপ বৈশিষ্ট্য নিয়ে।”


অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের আর একটি বড় গুণ তিনি একজন হৃদয়বান মানুষ। সবাইকে আপন করে নেয়া সবার জন্য কিছু করার সদিচ্ছা, কাউকে দূরে সরিয়ে না রেখে পরিবারের পিতার মত সকলকে কাছে টেনে নেবার যে বিরল মানসিকতা তা এ সমাজে সত্যি দুর্লভ।


আমি তাঁকে পিতার মত জানি। শ্রদ্ধা ও সম্মান করি পিতার মত। তাঁর পাণ্ডিত্য ও অন্তমুখি জ্ঞান প্রজ্ঞাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ গত ১৭ জুলাই,২০২০তারিখে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।যারা অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের বহুমুখী সৃজনশীলথা ও গবেষণা কর্মের সঙ্গে পরিচিত তারা একমত হবেন যে, তিনি সেই দুর্লভ বুদ্ধিজীবী যাঁর মন পৃথিবীর সব বৌদ্ধিক তর্ক-বিতর্ক জ্ঞানের দিকে খোলা, অথচ যিনি নিজের চিন্তনে স্বভূমিতে স্থিত, দেশজ সংস্কৃতির সব কিছু তাঁর প্রত্যয়ের অন্তর্গত। বৈশ্বিক ও দেশজ প্রাপঞ্চ ও অনুসঙ্গের ভারসাম্যপূর্ণ সেতুবন্ধন তিনি।


উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে একান্ত যোগ চিত্তের, যা সব জড়তা, মূঢ়তা কুপমন্ডুকতা এবং সকল উদাসীনতা ঘুচিয়ে এমন উন্নত বোধের বধন ঘটায়, যেখানে আনন্দ ও সত্য জাত ধরাধরি করে স্বপ্ন ও সুন্দরের পথে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে যায়।


অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা ও গবেষণাকে সত্য, সুন্দর ও আনন্দের বাইরে কল্পনাও করতে পারেন না। তাঁর কাছে শিক্ষক ও গবেষণা হলো সত্যের উপাসনা সুন্দরের প্রয়াস এবং আনন্দে অবগাহন। তিনি তাঁর এই সত্য সুন্দর আনন্দের কর্মযজ্ঞের নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশে তাঁর সকল উত্তর পুরুষকে আচ্ছন্ন ও আবিষ্ট করে রাখেন। তাঁর কথা মনে আমার স্মরণে এসে ঢেউ জাগায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় কয়েকটি উক্তি :

তিনি আমার স্বপ্নে কিছু কথা বলেন
তিনি আমার সঙ্গে শুধুই হেটে চলেন
তিনি আমার সমগ্রকে ভাঙতে দড়
তিনি আমার অকস্মাৎ ও পূর্বপর”


দেশের প্রতি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের ভালবাসা, দেশকে নিয়ে চিন্তা গবেষণা দেশের কল্যাণে প্রতি নিয়ত তাঁর ভাবনা সমূহ তাঁর লেখনি, বক্তৃতায়, চিন্তা চেতনায়, কাজে আমরা নিয়মিত খোঁজে পাই। চিন্তা চেতনায় সকল কর্মে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবতেন। দেশের মধ্যে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা তাঁর লেখনিতে সব সময মানুষের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে। তিনি একজন আলো, আলোকিত মানুষ।

আসলে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের এক অনন্য প্রতীক এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি এক আলোকবর্তিকা। তিনি অনুসরণীয় এক দৃষ্টান্ত। যতবার আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে ততোবারই দেখেছি নিজ অবস্থান থেকে তিনি তাঁর সঠিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্গতকারণেই বলতে হয় তিনি আমাদের গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী। দেশকে ভালবাসার চিন্তার ও গবেষণার স্বরূপ আমরা তাঁর লেখা আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ শিরোনামে লেখায় দেখতে পাই, “বাংলাদেশ আমার স্বপ্নের দেশ”।


এই দেশের মাটি আর মানুষকে ভালবাসি এবং খুব গভীরভাবে। এ দেশের মাটি সুরক্ষিত হোক আর এর অধিবাসীরা উন্নত জীবনের অধিকারী হোক এই স্বপ্ন নিয়েই তো বেঁচে রয়েছি। প্রায় চার হাজার বছর পর সর্বপ্রথম এদেশের শাসন কাজ পরিচালিত হচ্ছে এই মাটির সন্তানদের দ্বারা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এর পূর্বেও দেশ ছিল। দেশের মাািট ছিল। ছিলেন দেশের অধিবাসীবৃন্দ। কিন্তু কোন সময় এর নীতি নির্ধারিত হয়নি এ মাটির সন্তানদের দ্বারা। ১৯৭১ সালের পর থেকে নতুন অধ্যায়টির সূচনা হয়েছে। এই অধ্যায় অক্ষয় হোক। অমর হোক। চিরন্তন হোক। এই স্বপ্ন নিয়ে তো রয়েছি।”


দেশের বিবেকবান মানুষ মনে করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ তাঁর প্রাপ্য বা প্রত্যাশিত মূল্যায়ন পাননি।
দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি এর আতœ ত্যাগ, পরিশ্রম অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার ফলেও কেন যেন তিনি কৌশলে উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। ২০১০ সালে টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, এমাজউদ্দীন আহমদকে বর্তমান সরকার বা বর্তমান বিরোধী দল কেউই যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। রাজনীতি বিভক্ত এ সমাজে এ মূল্যায়ন অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য এ কারণে যে দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীর এ মূল্যায়নে রাজনীতি ক্ষেত্রে মতামত প্রদানে এমাজউদ্দীন আহমদের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ অবস্থানই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ফলে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সকল সরকারই ছিল রক্ষণশীল। এ দীর্ঘ জীবনে তাঁকে ঘিরে তাঁর ছাত্র, স্নেহভাজন ও শুভানুধ্যায়ীদের আবেগময় কর্মকান্ড দেখে মনে হয়েছে, হয়তো সরকারি স্বীকৃতি সে রকম তিনি পাননি, কিন্তু মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা তিনি যে পরিমাণ পেয়েছেন, তা অনেক তথাকথিত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মানুষ শুধু স্বপ্নেই পেতে পারেন, বাস্তবে তা নয়। সেই আমাদের প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক, গবেষক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments