আমাদের বড় সমস্যা মূল্যবোধ নিয়ে। ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত শহর গ্রাম সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের সমাজকে একেবারে খেয়ে ফেলেছে। আমরা সকলে মুখে মুখে খুব মূল্যবোধের কথা বলি। ধরুন ভাব দেখায় আমার মধ্যে মূল্যবোধের কোন ঘাটতি নাই। কিন্তু কি তাই!
কিভাবে মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়া যায়। অনেকে অনেক কিছু বলেন। কেউ কেউ বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধের বিষয় অনুপস্থিত। কেউ কেউ বলেন, আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা নাই বলে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। আবার কেউ কেউ বলেন, আমাদের পরিবার থেকে, বাবা মা থেকে মূল্যবোধ শিক্ষা অনুপস্থিত বিধায় আমাদের সমাজে মূল্যবোধের চর্চা বা চরিত্রের মধ্যে আমরা ধারণ করতে পারছি না।
মূল্যবোধের একটি ঘটনা আজ পাঠকের জন্য আমি তোলে ধরার চেষ্টা করছি। তবেই আমরা বুঝতে পারবো ‘মূল্যবোধ’ কে কিভাবে, কোথায় থেকে আমাদের চরিত্রে আসে।
আন্তর্জাতিক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ান দৌড়বিদ ‘আবেল মুতাই’ ফিনিশ লাইন শেষ করার ঠিক কয়েক ফুট আগে দৌড় বন্ধ করে দিল। তার ধারণা ছিল যে, সে ফিনিশ লাইন শেষ করে ফেলেছে এবং সে জিতে গেছে।
আবেলের ঠিক পিছনেই ছিল স্প্যানিশ দৌড়বিদ ইভান কারনান্দেজ। সে চিৎকার করে আবেলকে বলতে লাগলো, “হে, তুমি ফিনিশ লাইন শেষ করো নাই। তুমি দৌড় চালিয়ে যাও।”
আবেল কেনিয়ান হওয়ায় ইভানের স্প্যানিশ ভাষা বুঝতে পারছিল না। সে দাঁড়িয়ে রইল।
ইভান এটা বুঝতে পেরে আবেলকে ধাক্কা দিয়ে ফিনিশ লাইন পাড় করে দিল। তারপর কেনিয়ান দৌড়বিদ ‘আবেদ’ জিতে গেল। প্রথম হল।
প্রতিযোগিতা শেষে এক সাংবাদিক ইভানকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এমনটা করলে কেন?”
ইভান বলল, “আমার স্বপ্ন ছিল একদিন আমাদের একটি কমিউনিটি লাইফ থাকবে।”
সাংবাদিক : “তা তো বুঝলাম, কিন্তু ঐ কেনিয়ান আবেলকে কেন জিতিয়ে দিলে?”
ইভান আবারও বললো, “আমি তো তাকে জিতিয়ে দেইনি। সে তো জিতেই যাচ্ছিল।”
সাংবাদিক : “তুমি নিজেই তো জিততে পারতে, কারণ তুমি তো ঠিক তার পরেই ছিলে?”
ইভান, সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল। “দেখ, সত্যিই আমি জিততে পারতাম। কিন্তু, এই জেতার মূল্য কী হতে পারত, কী সম্মান আমি পেতাম। হয়তো একটি মেডেল পেতাম। তা দিয়ে আমি কি করতাম? আর, এ রকম জেতায় আমার মা’ই বা আমাকে কী ভাবত!”
মানুষের মুল্যবোধ (Values) এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশন স্থানান্তরিত হয়। ইভান তার মায়ের কাছ থেকে যে মূল্যবোধ পেয়েছিল : তা হল-আরেকজনকে ঠকিয়ে সে যেন জিতে না আসে।
আমরা আমাদের বাচ্চাদের কী মূল্যবোধ শিক্ষা দিচ্ছি? আমরা কি আমাদের বাচ্চাদেরকে মুল্যবোধ শিক্ষা দিচ্ছি? আমরা কি আমাদের বাচ্চাদের যে কোনভাবেই জিতে আসার শিক্ষাটাই দিচ্ছি না তো?
মূল্যবোধ বলতে কি বুঝিঃ আমরা মূল্যবোধ বলতে কি বুঝি? মূল্যবোধের অভাব আমাদের সমাজে সব চেয়ে বেশী। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের সঠিক মুল্যবোধ শিক্ষা দিতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আমাদের পিতা মাতাগণও সন্তানদের মূল্যবোধের শিক্ষাগুলো তাদের চরিত্রে বিকাশমান করতে বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অথচ শিক্ষার মুল বিষয় হচ্ছে মূল্যবোধ শিক্ষা, মানবতার শিক্ষা, মানুষের প্রতি মানুষের মায়া, দয়া, উপকার করার সদিচ্ছা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. এ আ খান তাঁর গ্রন্থে মূল্যবোধ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে Ethics of Marley শীর্ষক নিবন্ধে বলেন, Morality of ethics deals with human relationship how human feats other beings to promote mutual welfare, growth, creativity and meaning in striving for good over bad and right over wrong. Some philosophers like to distinguish ethics from morality in their view morality refers to human conduct and values and ‘ethics’ refer to the study of these areas. ‘Ethics’ does of course, denote an academic subject, but in everyday parlance we interchange ethical and moral to describe people we consider good and actions we consider right. And we interchange unethical and immoral to describe what we consider bad people and wrong actions:
অনেকে মনে করেন মূল্যবোধ শিক্ষা একমাত্র উপায় হচ্ছে স্কুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। স্কুল জীবনে একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থে মুল্যবোধ শিক্ষা নিয়ে তার জীবনযাত্রা শুরু করে। স্কুল জীবনের শুরু থেকে শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে পারেন। স্কুলই মূল্যবোধ শিক্ষার উপযুক্ত ক্ষেত্র। কিন্তু গবেষক মনে করেন মূল্যবোধ শিক্ষার উপযুক্ত স্থান হচ্ছে পরিবার, মসজিদ, মন্দির, গির্জা। নিজ পরিবার মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়ার প্রাথমিক ও প্রধানতম প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে স্ব স্ব ধর্মীর প্রতিষ্ঠান থেকে উক্ত শিক্ষার্থী মুল্যবোধের মৌলিক শিক্ষা লাভ করে থাকে। কিন্তু অন্যদিকে অনেক গবেষক মনে করেন মূল্যবোধ শিক্ষার উপযুক্ত স্থান হচ্ছে যেখানে একজন শিক্ষার্থীর মৌলিক শিক্ষা দেয়া হয়, যেমন পড়া, লেখা ও অঙ্ক পাঠ দান।Howward Kirschenbaum মতে Schools in a democratic society must teach such as values hard work, honesty, fairness, cooperation, tolerance, and respect.
কিভাবে মূল্যবোধঃ মানুষ মানুষের সঙ্গে কিরূপ আচরণ, কিভাবে ভাল আচরণ করবে তাহাই মূল্যবোধ। নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে অন্যের সঙ্গে ভাল ব্যবহার নিশ্চিত করা মূল্যবোধের অংশ। মানুষ মানুষকে ভালবাসবে। মানুষের সাধারণত জীবের প্রতি দয়া, মায়া, মমতা থাকা স্বাভাবিক। এটাই মূল্যবোধ। মানুষ বা কোন প্রাণীর সঙ্গে মানুষের ব্যবহার, আচরণ, কথাবার্তা, লেনদেন প্রভৃতি মূল্যবোধের বহিপ্রকাশ।
পিতা মাতা তার সন্তানকে শৈশব কাল থেকে ভাল মন্দের শিক্ষা দেয়। পিতা মাতা শিশুকে বলে দেয় এইটি ভাল, এইটি ভাল নয়। এই কাজ করবে, এই কাজ করবে না। পিতা মাতা শিশুকাল থেকে সন্তান শিক্ষা দেয় ছোটদের স্নেহ করবে, বড়দের সম্মান করবে। অন্যকে তার কাজের জন্য অগ্রাধিকার দেবে। নিজে সংযত হয়ে চলবে। ভাল ব্যবহার করবে।এইভাবে শিশু তার ঘর থেকে মূল্যবোধের শিক্ষা লাভ করতে থাকে।
মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষা : আমরা অনেকে মনে করি ধর্ম আমাদেরকে মুল্যবোধ শিক্ষা দেয়। অবশ্যই তাই। সকল ধর্মে ভাল মন্দের পরামর্শ দেয়া হয়। সকল ধর্ম মানুষকে শিক্ষা দেয় সত্য কথা বলবে, মিথ্যা বলবে না অন্যের সাথে খারাপ আচরণ করবে না, অন্যের প্রাপ্য থেকে তুমি অন্যকে বঞ্চিত করবে না। সকল ধর্মই ছোটদের স্নেহ করতে, বড়দের সম্মান করতে শিক্ষা দেয়। ইসলাম ধর্মে মূল্যবোধের শিক্ষা শুরু থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত। ইসলাম নিজেই মূল্যবোধ সম্পন্ন ধর্ম। ইসলামকে তাই জীবন বিধান বলা হয়। জীবনের সকল স্তরে, কিভাবে চলতে হবে, কি করা যাবে, কি করা যাবে না ইসলামে পবিত্র কোরআন পাকে ও রাসুলে করিম (সাঃ) হাদীসে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। কোন জাতি ইসলাম ধর্মকে সঠিক অর্থে পালন করলে, সে হবে একজন আদর্শ মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ। তাই দেখা যায় শুধু নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতি ধর্মী বিধান সমূহ পালনের মাধ্যমে প্রকৃত মুসলিম হওয়া গেলেও সত্যকার মোমিন, ভাল মানুষ, মূল্যবোধের মানুষ কতটুকু তার বিচারে তিনি সত্যিকার ভাল মানুষ। আমরা হযরত ওমর (রাঃ) একটি উক্তি এই ক্ষেত্রে স্মরণ করার মত। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, “কারও নামায-রোজা দেখেই তার বিচার করো না, তার জ্ঞান ও সাধুতার দিকে লক্ষ্য রেখো।
আমরা মনে করি কোন এক ব্যক্তি নিয়মিত নামাজ পড়েন রোজা রাখেন, যাকাত দেন, হজ্বও করেছেন। তিনি একে বারে মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ। ভাল মানুষ। মোমিন ব্যক্তি। কিন্তু না। শুধু নামাজ, রোজা, হজ্ব, দান ছদকা দেখে কোনভাবেই একজনকে সৎ মানুষ বলা যাবে না। দেখতে হবে তার জ্ঞান, তার চরিত্র, তার ব্যবহার। তার সততা, ইনসাফ, ন্যায় পরায়নতা। দেখতে হবে তিনি কতটুকু মানুষের প্রতি, জীবের প্রতি, প্রতিবেশীর প্রতি দয়াবান সকল মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব তিনি পালন করছেন কিনা। আমাদের সমাজে বহু ব্যক্তিকে আমরা নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত দিতে দেখতে পাই। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে সৎ নয়, সমাজ জীবনে সততার পরিচয় নাই। অন্যের হক আদায়ে তিনি সচেতন নন। মানুষের দুঃখে তিনি দুঃখী নন। মানুষের অভাব অভিযোগে তিনি এগিয়ে আসেন না। তাই বলে ঐ ব্যক্তি কোনক্রমেই মোমিন নয়। তিনি কোন ক্রমেই মূল্যবোধ সম্পন্ন ভাল মানুষ নয়। তার Morality আছে বলে আমরা কোনভাবে চিন্তা করতে পারি না। এই ক্ষেত্রে মহানবী (সাঃ) একটি হাদীস আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন, “ব্যক্তি ঈমানদার নয় যে তৃপ্তি সহকারে খানা খায় অথচ তার প্রতিবেশী তার পাশে পড়ে থাকে অভুক্ত অবস্থায়।”
এটাই তো মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়ার জন্য আমাদের নিকট যথেষ্ট। ভাল ব্যবহার, মানুষের উপকার করা, অভাবীকে সাহায্য করা,অভুক্তকে খাদ্য দান প্রভৃতি গুণাবলী মুল্যবোধ শিক্ষার মূল বিষয়। তাই ইসলাম ধর্ম সত্যিকার অর্থে মূল্যবোধ(Values) শিক্ষা দেয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ধর্ম। মানুষের প্রতি মানুষের মর্যাদা, সমান, কল্যাণ কামনা অন্য কোন ধর্ম নির্দেশ দেয়ার নমুনা খুবই কম। কিন্তু আমরা মুসলমানগণ ধর্মের মুল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। শুধু নামাজ, রোজা, হজ্ব পালন করেই মনে করছি ঈমানদার হয়ে গেলাম। কিছু লোক দেখানো গরীব মিসকিনকে জাকাত শাড়ি বন্টন করে ইসলামের দাবি করছি। কিন্তু এইটি ইসলামের শিক্ষা নয়। (এটাই মূল্যবোধের আচরণের বিপরীত আচরণ)।
মূল্যবোধ ও প্রাথমিক শিক্ষা : শিশু জন্মের পর তার মাকে প্রথম দেখতে পায়। মা কে চিনতে পারে। মা বাবার পর নিকট আত্মীয় স্বজনকে শিশু অনুকরণ করে। মা বাবা যে সব আচরণ করবেন, সন্তান সেই আচরণ শিখবে। মা বাবার ঘরের পর শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মক্তব থেকে শিক্ষকের নিকট থেকে মূল্যবোধ (Morality) শিক্ষা পায়। একজন শিক্ষক একভাবে কথা বলেন, কিভাবে ছোটদের সঙ্গে ব্যবহার করেন, কিভাবে বড়দের সম্মান করে কথা বলেন প্রভৃতি শিশু মনে খুব রেখাপাত করে। শিশু শৈশব থেকে শিক্ষকের সেই ভাল বা মন্দ ব্যবহার সহজে রপ্ত করে। তাই শিক্ষক সৎ, চরিত্রবান, বিনয়ী ও ভাল আচরণধারী না হলে শিশুমনে শিক্ষকের খারাপ কিছু দেখতে পেলে তাই শিক্ষা করে।
কিন্তু আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক আকারে মূল্যবোধ শিক্ষার পাঠ্যসূচীর খুবই অভাব। শিক্ষকগণের সদাচরণ অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় হয় না। তাই আমাদের দেশে শিশুরা প্রাথমিক স্কুল থেকে সুশিক্ষা, ভাল শিক্ষা, ভাল ব্যবহার, পরোপকার করার চিন্তা, অন্যের হকের প্রতি মর্যাদাবান হওয়ার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। স্কুলে বা বক্তব্যে একজন শিশু পাশের শিশুর নোট থেকে, লেখা থেকে অনুকরণ করে বা দেখে পরীক্ষা দেয়া যে অন্যায়, খারাপ কাজ, মূল্যবোধ বিরোধী কর্ম এই শিক্ষা শিশুকালে প্রাথমিক স্কুল থেকে দিতে হবে। এই শিক্ষা দেবেন শিক্ষক। আর বাড়িতে এই শিক্ষা দেবেন তার পিতা মাতা। তাই পিতা-মাতা ও শিক্ষককে হতে হবে শিশুর আদর্শ, অনুকরণীয়।
মূল্যবোধ : স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে : মূল্যবোধ, মানবতা, ভাল ব্যবহার, অন্যকে সম্মান ছোটদের স্নেহ করা প্রভৃতি আমরা পিতা মাতার পর প্রাথমিক বিদ্যালয় বা বক্তব্য থেকে শিক্ষা লাভ করে থাকি। শিশুকালে উল্লিখিত বিষয় আদব শিক্ষা না হলে হাইস্কুল, হাই মাদ্রাসা, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে একজন শিক্ষার্থী মূল্যবোধ সম্পন্ন ভাল মানুষ হওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। শিশুকালে মা যেমন শিশুকে শিক্ষা দেন অন্যায়ভাবে, বিনা পরিশ্রমে, বিনা কষ্টে, সহজে কোন কিছু পেতে চাওয়া ঠিক নয়। তা কখনও করবে না। অন্যের পাওনাকে নিজের পাওনা কখনও বানিয়ে নেবে না। কিন্তু আমাদের হাইস্কুল, হাই মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচীর বাহিরে শিক্ষকগণ তেমন কোন কিছু শিক্ষা দিতে পারেন না। যদি উক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সৎ না হন, চরিত্রবান না হন, বিবেকবান না হন, দায়িত্বশীল না হন তাহলে ছাত্রছাত্রীগণ কোন ভাল কিছুই শিখতে পারে না। শুধু তোতা পাখির মত পাঠ্যসূচি পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে বের হয়ে আসবে। তাই আমাদের সমাজে মূল্যবোধের এত অবক্ষয়। সমাজ থেকে যেন এই বিষয়টি একেবারে তিরোহিত হয়ে গিয়েছে। করোনায় এত মানুষ মৃত্যুবরণ করছে তারপরও মানুষের মধ্যে মানুষের প্রতি দয়া, মায়া, মমতা সৃষ্টি হচ্ছে না। মানুষ শুধু অন্যায় করছে। চুরি করছে, ঘুষ খাচ্ছে, অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয় প্রীতিতে সমাজ এখন সয়লাব। দুর্নীতি করে, অন্যায় করে ধনি হলে আমাদের মানুষ যেন তাকে প্রশংসা করছে। দুর্নীতিবাজের যেন রাজত্ব। দুর্নীতি, ঘুষখোর ব্যক্তিদের যেন সমাজ। এর কারণ প্রকৃত মনুষত্ব আমাদের মধ্যে থেকে বিদায় নিয়েছে। সম্পদকে আমাদের একমাত্র বিষয় মনে করছি।
মূল্যবোধ ও ব্যবসায়িক লেনদেন : পণ্য বিক্রি কোন মুদ্রার বিনিময়ে হয়ে থাকে তাকে আমরা ব্যবসা বলে থাকি। নির্দিষ্ট চুক্তির ভিত্তিতে একজন অন্যজনের নিকট তার পণ্য বিক্রি করে থাকে। বর্তমানে আমরা যা এলসি হিসাবে চিহ্নিত করি। দেশে বিদেশে আজকাল পণ্য বিনিময় হয় এলসির মাধ্যমে। এই সকল এলসিতে নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন উল্লেখ থাকে। এই লেনদেনকে ব্যবসা হিসাবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সঠিকভাবে পণ্যের ওজন দেয়া, সংখ্যা ঠিকমত গননা করা, সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করা বা রপ্তানি করা। ঠিক সময়, চুক্তি অনুযায়ী পণ্য রপ্তানীকারকের মূল্য পরিশোধ করা। এই সকল হচ্ছে ব্যবসায়িক মুল্যবোধ। ড. এ আ খান বলেন, “Man is basically animals without morality. Social values Justice & Cove Fussiness ethics wake their behavior mutually beneficial when based on these.”
মূল্যবোধ নিয়ে নানা গবেষক নানা কথা বলেছেন। এর ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ অনেক করা যাবে। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে আমরা বলতে পারি Morality as a code of conduct can be distinguished from morality in the broader sense of the values, ideals and aspirations that shape a person’s life.
ব্যবসায় মূল্যবোধ না থাকলে সে কখন সফলকাম হতে পারে না। এক সময় এসে মূল্যবোধের অভাবে উক্ত ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় ভাটা পড়ে বসবে। যারাই সকল ব্যবসায়ী তারা মুল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ। জীবনে বেঁচে থাকেন তারা। তাদের ব্যবসায় উন্নতি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে। সততা, নিষ্টা, ন্যায়পরায়নতা ব্যবসার মূল স্তম্ভ।
মূল্যবোধও Social Responsibility বাড়ায় : মানুষ সমাজবদ্ধ জীবন। মানুষের মাঝে মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কতব্য কি তা আমরা আমাদের শিক্ষা জীবন থেকে পেয়ে থাকি। সমাজ ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। সমাজ আমাদেরকে ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে বড় করে। মানসিকভাবে বড় করে। অর্থ সম্পদ দিয়ে আমাদের মনকে গড়ে দেয়। আর অনেক গুলো মানুষ একত্রে, একই আদর্শে, একই চিন্তা চেতনা নিয়ে যেখানে বসবাস করে সেইটি সমাজ। সমাজ যেহেতু আমাকে সম্পদশালী করে, জ্ঞানী করে, চিন্তাশীল মানুষ তৈরি করে, তাই সমাজের প্রতিও আমাদের অনেক অনেক দায়িত্ব রয়েছে।
Davis Keith 1960 সালে Social responsibility বুঝতে গিয়ে বলেন, Management decisions and actions taken for reasons at least practically beyond the organization’s direct economic or technical interest.”
শুধূ অর্থ উপার্জন মানুষের একমাত্র বিষয় হতে পারে না। মানুষ নিজে কতদিন বাঁচবে, কতটুকু একজন মানুষের ভোগের জন্য প্রয়োজন। তা খুবই কম। অনেক সীমিত। কিন্তু মানুষের উপার্জনের উপর সমাজের মানুষের ‘হক’ রয়েছে। সেই দায়িত্ব একজন ব্যবসায়ীকে অবশ্যই পালন করতে হবে। আর তা করার অর্থ হচ্ছে আমি আমার মূল্যবোধের শিক্ষাকে কাজে লাগালাম। যেমন আমি সরকারকে কর দিই। মিথ্যা তত্ত¡ দিয়ে কর ফাঁকি দিব না। এটাই সরকারের প্রতি আমার দায়িত্ব পালন। এটাই মূল্যবোধের শিক্ষা।
শেষ কথাঃ মানুষের মূল্যবোধ (Values) এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশনে স্থানান্তরিত হয়। যেমন ইভান তার মূল্যবোধ শিক্ষা পেয়েছেন নিজের ‘মা’ থেকে। ‘মা’ তাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন সে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেছে। তাই শুধু পুথিগত শিক্ষা, শিক্ষা নয়। মূল্যবোধ অর্জন ও তা নিজের জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে সত্যিকার মানুষ হওয়ার মধ্যে গৌরব।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
ভালো লেখা তথ্যপূর্ণ বিশ্লষণাত্মক।