“এ যুগের দুশমনেরা আমাদের ঈমানে হাত দিয়েছে। এ যুগের দুশমনদের সাফল্য দেখলে যেকোন সচেতন মুসলমানের কান্না পাওয়ার কথা! আমাদের এ যুগের শোচনীয় ব্যর্থতার ইতিহাস বিশেষতঃ ঈমান অনুভ‚তির ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের লজ্জাজনক পরাজয় কাহিনী অবশ্যই পরবর্তীরা চিহ্নিত করবে! কি ভয়বহই না এই পরাজয়! আর প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি গ্রাম-মহল্লা বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন শয়তানী-বদমায়েশী জাতীয় বোধ-বিশ^াসের গোড়া কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা মুজাদ্দেদে আলফেসানী, জামালুদ্দীন আফগানী, মুফতি মাহমুদ, আল্লামা ইকবাল, আল্লামা আবুল হাসান নদভী, হাজী শরীয়তউল্লাহ, মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ প্রমুখ কালজয়ী মনীষীদের উত্তরাধিকারী হওয়ার দাবীদাররা একের পর এক বাতিলের নিকট আত্মসমর্পণ করে গা বাঁচানোর চেষ্টা করছে।”
“জীবনের খেলাঘরে” নামক বিখ্যাত আত্মজৈবনিক গ্রন্থে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ.) উপরের কথাগুলো বলেছেন।
বিংশ শতকে বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে যে ক’জন খ্যাতনামা মণীষী জ্ঞান, গবেষণা ও লেখনির সাহায্যে ইসলামকে জীবন ঘনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য একটি কালজয়ী জীবন দর্শন হিসাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন, মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চিন্তা-দর্শনের সফল উপস্থাপন, ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে মৌলিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, আরবী ও উর্দু ভাষার উৎকৃষ্ট ইসলামী রচনাবলীর বাংলায় ভাষান্তর ও বাংলায় ইসলামী সাহিত্যের অগ্রপথিক ‘মাসিক’ মদীনার’ তিনি ছিলেন রূপকার এবং বিংশ শতব্দীর এক অনন্য সাধারণ ইসলামী প্রতিভা। জীবনের প্রায় সবটুকু সময় তিনি এ মহৎ কাজের ব্যয় করে বিপুল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।
মাওলানা মহিউদ্দীন খানের জন্ম বৃটিশ শাসন আমলে ১৯৩৫ সালের ১৯শে এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলায়। মৃত্যুবরণ করেছেন ২০১৬ সালের ২ রা জুন, ঢাকায়।
১৯৫১ সালে আলীম, ১৯৫৩ সালে ফাজিল মাদ্রাসা থেকে পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকার আলীয় মাদ্রাসা থেকে হাদিসে কামিল ডিগ্রী লাভ করেন। এবং একই সময় তিনি কামিল ডিগ্রি ফিকাহ বিষয়েÑ অর্জন পর কর্মজীবন শুরু করেন। মাওলানা মহিউদ্দীন খান জীবন যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেনঃ
“একটু বয়স হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে, কিশোর বয়সে যে শোষক অপশক্তির বিরুদ্ধে চাকু হাতে লড়াই করার জন্য আমি সংকল্পবব্ধ হয়েছিলাম ওরা সংখ্যায় এক দুটি নয়, অগণিত। আর চাকু নিয়ে ওদের মোকাবেলা আমার দ্বারা অন্ততঃ সম্ভব নয়। চাকু চাইতে অনেক বেশী ধারালো ও কার্যকর অস্ত্রের অনুশীলন আমাকে করতে হবে। কর্মজীবনের শুরুতেই কলম হাতে সংবাদপত্রের জগতে প্রবেশ করার প্রেরণা, আমি কৈশোরের সেই অনুভ‚তি থেকেই লাভ করেছিলাম।
তাই দেখা যায় মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছাত্র জীবন থেকেই সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৬০ মাসিক দিশারী পত্রিকাও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ২৬ বছর বয়স ১৯৬১ সাল থেকে ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব আমৃত্যু পালন করে গিয়েছেন।
অনন্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব, সমকালীন চিন্তার নন্দিত নায়ক মাওলানা মহিউদ্দীন খান। দীর্ঘদেহী, মধ্যম গড়ন শরীর, শশ্রæমন্ডিত, কেতাদুরস্ত পায়জামা পাঞ্জাবী ও শেরওয়ানী অঙ্গে এবং জিন্নাহ টুপি বা চিন্তি টুপি শোভা পেতো মাথায়। হাতে ষষ্টি, পায়ে নাগরা বা চপ্পল। খান্দানী ভাব, মার্জিত রুচি ও পরিশিলীত বাচনভঙ্গী সবসময় অসাধারণ করে রাখতো তাকে। নজরকাড়া দ্যুতিময় নূরানী চেহারা, অনুসস্বর, আবেগময় ভাষা, সুস্পষ্ট বক্তব্য, সহজ সাবলীল প্রকাশভঙ্গি, অত্যন্ত গোছানো কথা, আন্তরিক ও বিনয়ীভাব, পরিপাটি চালচলন অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অকৃত্রিম ভালোবাসা সহজেই আপন করে নিতো সবাইকে।
মাওলানা মহিউদ্দীন খানের ক্ষুরধার কলম এটি তার হাতের একটি কুড়ালের ন্যায় ছিল। কুড়াল দিয়ে যেমন বন-জঙ্গল, ঝাড়-ঝোপ কেটে পরিস্কার করা হয়, তেমনি তিনি তার লেখনির মাধ্যমে সবধরনের আবিলতা, পঙ্কিলতা, বাতিল শক্তির চিন্তাধারা, বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, ইজম-মতবাদের আগাছা পরগাছা নিড়িয়ে ফেলতেন। শুধু তাই নয়, ইসলামী সাহিত্য রচনায় মাওলানা আবদুর রহীম (রহঃ) পর তিনিই ইসলামের সঠিকরূপ বাংলা ভাষাভাষিদের কাছে তুলে ধরতের সক্ষম হয়েছেন। তিনি দ্বীনের প্রত্যেক শাখায় তার কলম চালিয়েছেন। তাফসীর, হাদীস, ইতিহাস, সীরাত, ফিকহ কোন দিক বাদ দেননি। তার মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার ভাষা ছিল সাবলীল, বর্ণনা গতিময় এবং বিষয়বস্তু সুসস্পষ্টভাবে ও বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন অনন্য অসাধারণ।
বাংলা ভাষায় অনুবাদ জগতে তিনি এককভাবে এমন উচ্চতায় আরোহন করেছেন যা কল্পনার অতীত। ইমাম আবু হামেদ আল গাযযালীর কালজয়ী গ্রন্থ ইহইয়াউ উলুমমিদ্দীন, কিমিয়ায়ে সাআদাত, আলমুরশিদুল আমীন, ইমাম অয়ুতীর খাসায়েসুল কুবরা, আল্লামা শিবলী নোমানীর সীরাতুন নবী (সাঃ) ও আল ফারুক ইত্যাদি বিশ^বিখ্যাত গ্রন্থ তার শ্রেষ্ঠ অনুবাদ কর্ম।
এছাড়া তার বিখ্যাত গ্রন্থ সমূহ হচ্ছেঃ ইসলাম ও আমাদের জীবন, সিরাতুল মুস্তাকীম, মারেফুল কোরআন বাংলা অনুবাদ, জান্নাতের অমীয় ধারা জমজম, তজীদুল বোখারী, আযাদী আন্দোলন ১৮৫৭, মুমিনের জীবন যাপন পদ্ধতি, ও সহজ আরবী ব্যাকরণ, আল কাউসার, জীবনের খেলাঘরে প্রভৃতি।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহঃ) এর মৌলিক ও অমর কীর্তিগাঁথার নাম মাসিক মদীনা। একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা লক্ষাধিক সার্কুলেশন নিয়ে অর্ধশতাব্দীর চেয়ে বেশী সম ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, নির্ভরতা ও বিশ^াসযোগ্যতার মানদন্ডে টিকে থাকতে পারে, তার নজীর দুই বাংলার কোথাও নাই। এ পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা মহিউদ্দীন খান যুগ যুগ ধরে লাখ লাখ মানুষের ধর্ম, জীবন ও আশা-আকাঙ্খার সাথে সম্পৃক্ত শত সহ¯্র প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছেন, তা অনাগত দিনে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি উত্তম ফিকহ শাস্ত্রের দলিল হয়ে থাকবে।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান শুধু একজন ইসলামি সাহিত্য রচনায় পারদর্শী নন, তিনি সমাজ সংস্কারক ক্ষেত্রে বিশেষ ভ‚মিকা রাখেন। তিনি তার জীবনবোধ সম্পর্কে অতিশয় সচেতন ছিলেন। জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধি আমাদেরকে উৎসাহিত করে। তার কাছে কেউ কোন ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে গেলে, নীরব শ্রোতা হয়ে মনোযোগ সহকারে শোনতেন এবং কোরআন ও হাদীসের আলোকে সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি বলতেনঃ “সংসারে বেশীর ভাগ সময় নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করবে, বুঝতেই তো পারছোÑ ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নামে বর্তমানে সমাজ-সংসারে যা চলেছে, এত রঙ তামাশার জন্য আল্লাহ পাক আমাদেরকে সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টির মূল লক্ষ্য হলো সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করা। সুতরাং নিজের কর্মের প্রতি মনোযোগী হও। সব সময় লক্ষ্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখ। কখনো লক্ষ্যচুত হয়ো না।”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তার যোগ্য সন্তান আহম্মদ বদরুদ্দীন খান “আমার বাবা মহিউদ্দীন খান কেমন মানুষ ছিলেন” শিরোনামে লিখেনঃ
“তিনি সব সময় এ কথা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতেন যে, মদীনা নামের বরকতেই আল্লাহপাক আমাকে একেবারে শূন্য থেকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। এ কথা কয়টি উচ্চারণ করার সময় ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায় তার চোখে অশ্রæ টলমল করত।
সীরাত সাহিত্য অধ্যয়ন ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনোদন। কর্ম জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় তিনি সীরাতে রাসূল (সাঃ) এর বিভিন্ন দিকের উপর রচনা, অনুবাদ ও গবেষনায় ব্যয় করেছেন। বিশ^বিখ্যাত কালজয়ী সীরাত গ্রন্থসমূহ মাতৃভাষা বাংলায় অনুবাদ, ও প্রকাশ করার জন্য তিনি ‘মদীনা পাবলিকেশন নামক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের কর্ম জীবনে আরবী, উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত প্রায় ত্রিশ হাজার গ্রন্থ আমার বাবা মাওলানা মহিউদ্দীন খান তার ব্যক্তিগত পাঠাগারের জন্য সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে বিষয়বন্তুর দিক থেকে সত্তর শতাংশ গ্রন্থই হচ্ছে সীরাত বিষয়ক।
তিনি বলতেন এবং বিশ^াস করতেন যে, লেখালেখির ক্ষেত্রে সীরাতে রাসূল (সাঃ) এর চেয়ে উত্তম কোন বিষয় হতে পারে না। ”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান সম্পর্কে বিশিষ্ট্য লেখক, গবেষক শামসুদ্দীন আহমদ এক প্রবন্ধে বলেন, “মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহঃ) ছিলেন একজন মহান দায়ী ও চিন্তক। শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর যে গুরু দায়িত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পণ করা হয়েছে তা পালন, উম্মাহর মন-মানস গঠন, তাদের মধ্যে ‘ঈমানী জাগরণ’ সৃষ্টি ও তাদেরকে নব চেতনায় উদ্দীপ্ত করার ক্ষেত্রে মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহ) এর রয়েছে এক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী এই মনীষী আমৃত্যু দেশ, জাতি ও ইসলামের বহুমুখী খেদমত করে গেছেন। তিনি সব শ্রেণীর আলেমদের নিকট ছিলেন সমাদৃত। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ে ও দেওবন্দী আদর্শের অধিকারী এই মহৎ মানুষটি সর্বমহলের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন।”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান একজন রাজনৈতিক সচেতন ইসলামী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামী রাজনীতির প্রাণ পুরুষ। কিন্তু তিনি কখনো নেতৃত্বের জন্য রাজনীতি করেন নাই। ইসলামের বৃহৎ স্বার্থে তিনি জমিয়ত ছাড়াও বহু সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইসলামী ঐক্যজোটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা, ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার সভাপতি, ভারতীয় নদী আগ্রাসন প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহবায়কসহ আরও অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন মাওলানা মহিউদ্দীন খান। তিনি ময়মনসিংহ জেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি বহুবার জেল খেটেছেন। মসলিম বিরোধী আন্দোলন, বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে আন্দোলন, কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন, ফতোয়া রক্ষার আন্দোলনসহ নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনে তার ভ‚মিকা ছিল অবিস্মরণীয়।
শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ ইসলামী চিন্তানায়ক। তিনি রাবেতা আলম ইসলামীর স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি হুতামার আল আলম আল ইসলামীরও স্থায়ী কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ এক প্রবন্ধে বলেনঃ
“মাওলা মহিউদ্দীন খানের অবদান রয়েছে দেশ-জাতি, ইসলাম-মুসলমান, শিক্ষা সাহিত্য, তাহযীব তামাদ্দুন, আন্দোলন সংগ্রাম, রাজনীতি অর্থনীতি ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায়। তিনি ছিলেন এদেশের রতœ, এ দেশের সম্পদ, সমকালীন বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় ব্যক্তিত্ব, ইসলামী চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তিনি বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের এক সফল রূপকার জীবন্ত মহীরুহ ও কিংবদন্তী পুরুষ হিসাবে সকলের নিকট সমাদৃত। এদেশের মাটি ও মানুষ তার কাছে ঋণী। দেশ ও জাতির খেমতে তার অবদান ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছিলেন অত্যন্ত উচু মাপের আলেম। নিরংহকার এই মানুষটি সাধারণ ও সাদামাটা জীবন যাপনকারী অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তার সম্পর্কে অধ্যক্ষ মুফতী শাঈখ মুহাম্মদ উছমান গণী ‘জ্ঞানের বাতিঘর মাওলানা মুহউদ্দীন খান শিরোনামে লিখেনঃ
“তিনি ছিলেন একাধারে বিদগ্ধ আলেম, সুলেখক, সাংবাদিক, পন্ডিত মনীষী, মুফাসসির, ফকীহ ও সমাজ বিজ্ঞানী। কিংবদন্তির প্রবদ পুরুষ ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, ছিলেন দক্ষ আলেম ও সুবক্তা ছিলেন নির্মোহ গবেষক, লেখক ও দার্শনিক। অত্যন্ত দানশীল ছিলেন তিনি; যা তার কাছের লোকের সকলেই জানতেন, তিনি তার উপার্জনের সিংহভগই ব্যয় করতেন সেবামূলক কাজে। তার বাড়ী দিনের সকলের জন্য ‘আস দস্তরখান’।
সমাজ, সংস্কৃতি ও সমাজের নানা অনিয়ম নিয়ে তিনি সব সময় ভাবতেন। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তিনি নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। সমাজের উন্নতি, ইসলামী মূল্যবোধের বাস্তবায়ন, ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য তার ছিল ধ্যান চিন্তা প্রচেষ্টা ও লেখনি।
বর্তমান সমাজ, চার পাশের পরিবেশ আর অত্যাচার-অনাচারে রূপ-দর্শনে তিনি তার গ্রন্থ ‘জীবনের খেলাঘর’ উল্লেখ করেনঃ
“এখনও স্বঘোষিত বহু মোজাদ্দেদে হামানের প্রাদুর্ভাব অহরহই দেখতে পাই। এদের সাথে আমার মরহুম আব্বা ও তার বন্ধু-বান্ধবের জীবনখাতা, চিন্তা চেতনা, আমল আখলাকের তুলনা করলে শুধু হতাশাই বাড়ে। মনে হয় সিংহের খান্দান ক্রমেই যেন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর তার পরিত্যাক্ত স্থানে এসে ভিড় করছে ফেউ জাতীয় মেরুদন্ডহীন ধূর্ত কিছু ইতর প্রাণী। বাংলার মুসলমান আজ নানামুখী বিজাতীয় আগ্রাসনের করুণ শিকার। কিন্তু এ মহা দুদিনে তাদের পাশে একজন মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বা নিদানপক্ষে একজন মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীও নেই। এটা কিসের আলামত? সম্পূর্ণ ধ্বসের না অন্য কিছু? তা একমাত্র রাব্বুল আলামিনই বলতে পারেন‼”
মাওলানা মহিউদ্দীন খানে লেখার বদৌলতে, বিশেষ করে ‘মাসিক মদীনা’ বাংলাদেশে একটি ইসলামী চিন্তা চেতনার লেখক বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি সমসাময়িক সকল সুলেখকদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতেন। কবি ফররুখ আহমাদ, কবি তালিম হোসেন, কবি বেনজীর আহম্মদ, লেখক আবুল আসাদ, লেখক ও কথা শিল্প ইমদাদুল হক মিলন সহ অগণিত সাহিত্য সেবীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, আড্ডা দিতেন। তার ¯েœহ ভাজন কবি মাহমুদ ফেরদৌসীয়া কাদরী “স্মৃতির আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেনঃ
“যতই দিন যায়, ততই মনে হয়
তুমি যেন আরো বেশী কর্মমূখর!
নেই তুমি এ ধরায়! তবু শুধু মনে হয়!
জ¦ল জ¦ল করে সেই দৃষ্টি প্রখর!”
মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহঃ) আজীবন তার লেখনির মাধ্যমে এ দেশের মুসলমানদের চেতনার জমিনে কোরআন সুন্নাহর অমীয় সুধায় সিক্ত করেছেন।
বাংলা ভাষায় দ্বীনী সাহিত্যকে একটি সমৃদ্ধ অবস্থানে পৌঁছে দেয়ার জন্য এক জীবনে এতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন তিনি তা অতুলনীয়। এই উপমহাদেশে অনুরূপ মাওলা আবদুর রহীম (রাঃ) মাওলানা আখতার ফারুক, মাওলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ও মুসলিম সাহিত্য সংস্কৃতির মূল কাঠামো বিন্যাসে অপরিসীম অবদান রেখে গিয়েছেন।
শেষ জীবনে এসে মাওলানা মহিউদ্দীন খান এই বলে অনুশোচনা করতেন যে, “কোরআন, সীরাত, হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে আরো অনেক কিছু করার পরিকল্পনা আমার ছিল, কিন্তু সময়াভাবে তা আর করা হল না।”
আল্লাহপাক জীবনের অপারে তাঁকে তার কৃতকর্মের পুরস্কার প্রদান করবেন।
হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহঃ) ‘তফসীর মাআরেফুল কোরআন’ অনুবাদও সম্পাদনা বাংলায় করে সউদী সরকার কর্তৃক লক্ষ লক্ষ কপি সারা বিশে^ মানুষের পড়ার উদ্দেশ্যে বিলি ও প্রচার করে দ্বীনের পবিত্র খেদমত করার সুযোগ লাভ করেন। চমৎকার ছাপা ও বাধাই পবিত্র কোরআন শরীফ আমাদের হৃদয়ে বেশ আকৃষ্ট করে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।