নতুন বছর আসছে ১লা জানুয়ারি ২০২১ আনন্দের দিন। বিশ্বজুড়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার মাধ্যমে খৃষ্টান সম্প্রদায় দিনটিকে নানা রঙে রাঙিয়ে প্রতি বছর পালন করে আসছে। আমরাও নতুন ইংরেজি বছরকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। বাংলা নববর্ষ ১লা বৈশাখ যেমন আমরা অতি উৎসাহের সঙ্গে পালন করি ইংরেজি নববর্ষকেও তেমনি মাত্রায় উৎযাপন করা হয়। তবে আরবী নববর্ষকে আমরা তেমন গুরুত্ব দিতে পারি নাই।
বিগত ২০২০ সাল করোনা বর্ষ বলা যায়। বিশ্বজুড়ে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে আমাদের দেশে কোভিড-১৯ ধরা পড়ে। দেশে করোনার আক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিন্তু করোনা ধরা পড়ে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে চীন দেশে। চীন থেকে পুরো বিশ্ব আজও পর্যন্ত ভয়ানক এই মহামারীতে দিশেহারা।
গত ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত আমাদের দেশে ও বিশ্বে^ করোনা রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু সংখ্যা সকলকে মর্মাহত করে। বাংলাদেশ মৃত্যুর সংখ্যা ৭৪২৮ জন মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫০৮০৯৯ জন সুস্থ হওয়ার সংখ্যা ৪৫০৪৮৮ জন।
বিশে^র করোনা রোগীর সংখ্যা ৮ কোটি ৭ লক্ষ জন বিশ্বজুড়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৭ লক্ষ ৬৪ হাজার জন । তাই বিগত ২০২০ সালটি বাংলাদেশসহ সকল দেশের জন্য করোনা বর্ষ। খুবই দুঃখের বর্ষ। আজও আমরা করোনা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি নাই। করোনার প্রতিষেধক আবিস্কার হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। আমরা এখনও টিকা সংগ্রহ করতে পারি নাই। সরকার অগ্রিম বুকিং দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ১৫ই জানুয়ারী ’২১ থেকে দেশে টিকা দেয়া শুরু করতে পারবেন। নানা প্রস্তুতি সরকার নিচ্ছেন।
পুরো বছর করোনায় আক্রান্ত থাকলেও আমাদের জীবন যাপন, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের সমাজ ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রথম দু’মাস লক ডাউন থাকার পর ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু হয়েছে। জনজীবনে ধীরে স্তত্বি ফিরে আসতে শুরু হয়েছে। মানুষ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে।
১. করোনা বর্ষে আমাদের সফলতাঃ নানা সমস্যা ও সীমাবন্ধতার মধ্যে থেকেও সরকার কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাপ মোকাবেলা করেছে। যেখানে অনেকে ভাবছিলেন আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালের মত রাস্তায় রাস্তায় মানুষ করোনায় মরে পড়ে থাকবে। কিন্তু আল্লাহপাকের অনেক রহমত প্রথম ধাপে তেমন কিছু ঘটে নাই। সরকারিও বেসরকারি উদ্যোগে, জনগণের আন্তরিক চেষ্টায় আমরা কিছুটা হলেও সফলতার সঙ্গে করোনা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুনীর্তির মধ্যে থেকেও মানুষ বেঁচে আছে। অর্থনীতির চাকা সচল হয়েছে। বিগত বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন করোনা মোকাবেলা।
সরকার দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ স্বল্প সুদে দিয়েছে। এখনও তা চলমান। বিশেষ কওে সরকারের বড় ধরণের ঋনসহযোগীতায় তৈরি পোশাক শিল্পে খাত বেঁচে আছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়েছে। এখনও দ্বিতীয় বারের জন্য আবারও সরকার ক্ষুদ্রও মাঝারি শিল্পের সহযোগীতার পরিকল্পনা করছে।
২. কৃষিখাতে আমাদের সফলতাঃ দেশের কৃষিখাত আজ অনেকটা আত্মনির্ভরশীল। চাল উৎপাদনে, আমরা পৃথিবীর প্রথম কাতারে রয়েছি। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। দেশে কোন মানুষ খাদ্যের অভাবে মৃত্যু বরণ করে নাই। যদিও করোনার ফলে দেশে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে এসেছে। করোনার পূর্বে দারিদ্র্যসীমার নীচে ছিল মাত্র ২২ শতাংশ মানুষ। চাল ছাড়াও আমরা মাছ, মাংস, ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্য পণ্য উৎপাদনে করোনাকালেও সলতা, দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছি। ছাত্র, শ্রমিক, সাধারণ জনগণ করোনাকালে কৃষকদের ধান কেটে সহযোগীতার মাধ্যমে খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, যুবদল, ছাত্রদল সহ সকল রাজনৈতিক কর্মী বিপদকালে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্বল্প পরিমাণ পেয়াজের সমস্যা ছাড়া মৌলিক কোন খাদ্য পণ্যের সরবরাহে বিঘœ ঘটে নাই। এই দক্ষতার জন্য সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে হয়।
৩. পদ্মা সেতু দৃশ্যমানঃ ২০২০ সাল আমাদের সফলতার বড় মাইলফলক নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়া। যেখানে পদ্মা সেতু না হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সেখানে বিগত সালে ৪১টি স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হলো। ২০০৭ সালে ২ রা আগস্ট প্রথম মাত্র ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা অর্থায়নে ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সেতু এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। আগামীতে আরও ব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে ঋণ সহযোগীতা প্রত্যাহারের ফলে ব্যয় ও সময় বেড়ে যায়। নতুন অভিজ্ঞতা, নানা সমস্যা, সীমাবদ্ধতার পরও আমরা পদ্মাসেতু করতে সক্ষম হচ্ছিÑএটাই আমাদের বড় সফলতা। আমাদের অহংকার। এই অভিজ্ঞতাকে আমরা দেশের ভবিষ্যত উন্নয়নে আরও বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগাতে সক্ষম হবো।
৪. রূপকল্প ২০৪১ তৈরীঃ স্বপ্ন দেখতে হয়। নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য স্বপ্ন দেখা ছাড়া কোন বিকল্প নাই। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে ‘রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপায়ন: বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ এইটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ২০৪১ সালকে সরকার বিশেষ বিবেচনায় নিয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ‘রূপকল্প ২০২১-২০৪১’।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ ডলারের বেশী। জিডিপি গড় ধরা হয়েছে ৯.০২ শতাংশ হারে। ২০৩১ সালে দেশ হবে একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’ কে মূল্যায়ন করেছেন- এ দলিল মূলত ২০৪১ সালের মধ্যে এক সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ অর্জনে সরকারের উন্নয়ন রূপকল্প, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহের একটি কৌশলগত বিবৃতি এবং তা বাস্তবায়নের পথ নকশা হিসেবে। এই ‘পথ-নকশা’র পথ ধরেই ২০৪১ সালে অর্জিত হবে আমাদের ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’।
৫. আইটি খাতের উত্থানঃ করোনা আমাদের বিগত বছরের আইটি নির্ভর জাতিতে পরিণত হওয়ার এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে অন-লাইনে। ঘরে বসে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করছি। ঘরে বসে স্কুল, কলেজও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীগণ পড়াশোনা করছে। বাংলাদেশে বসে লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, জার্মানী, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে। যদিও কিছু কিছু সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করোনাকালিন পড়াশোনা পূর্বের মত চলছে না। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চমানের ইংরেজী মাধ্যম স্কুল সমূহের পুরোদমে ছাত্রভর্তি, ক্লাশ, পরীক্ষা এবং ফলাফল সব কিছুই সমান তালে চলছে। তবে আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ আইটির পূর্ণ ব্যবহার এখনও নিশ্চিত করতে পারে নাই। তবে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ২০২০ সালে আমাদের আইটি খাতের অগ্রগতি বেশ চমৎকার অনুপ্রেরণাদায়ক। ইতিমধ্যে আইটি পার্ক গাজীপুর সহ অন্যান্য জেলায় চালু হওয়ার পথে।
আগস্ট ২০২০ দেশে মোবাইল সংযোগ সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ ২৮ হাজার। ১৭ কোটি দেশে ১৬ কোটির অধিক মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার গত সেপ্টেম্বরে ২০২০ সালে ১০ কোটি ২৪ লক্ষ ৭৮ হাজার। বাংলাদেশের মত একটি দেশে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার অবাক করার মত।
৬. কর্মসংস্থান ও বেকার সমস্যাঃ বর্তমানে দেশে ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে এখনও ৪ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে। এরমধ্যে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৫৬ লক্ষ। ২০১৯ সালের সব কয়টি মাস করোনা কালে অতিবাহিত হয়েছে। তাই সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রায় ছিল না বললে চলে। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো পর্যন্ত করোনা কালে তিন মাস প্রায় বন্ধ থাকে। পরে ধীরে ধীরে চালু হলেও পুরোদমে চলতে সময় লাগছে। নতুন কর্মসংস্থান খুবই কম।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক শিল্পে রফতানি আদেশ হ্রাস পাওয়ার ফলে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে। বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক চাকুরী হারায়। নতুন কর্মসংস্থানও এইখাতে তেমন নাই।
আমাদের সবচেয়ে বেশী কর্মসংস্থান হয়েছে সেবাখাতে। ২০১৯ সালে সেবাখাত সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষুদ্র মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠান এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা হারিয়েছে। হকারসহ সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যবসা এখনও চালু হয নাই। হোটেল, পর্যটন, দোকানী, রেল, সড়ক, বিমান সকল খাতে ২০১৯ সালে বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে। কাজেই নতুন করে কর্মসংস্থান হওয়ার কোন পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয় নাই।
আমাদের সেবাখাতের আর একটি বড় উপখাত হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ। বিগত মার্চ ’২০১৯ থেকে আগামী ১৮ই জানুয়ারী ২০২১ সাল পর্যন্ত সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন। বেসরকারি অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও হাহাকার। চাকুরী হারিয়েছেন হাজার হাজার। বেতন পাচ্ছেন না হাজার হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী। নতুন করে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয় নাই। তাই নতুন কর্মসংস্থান হয় নাই। এই খাতে বেকার হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।
৭. করোনা আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে আজাবঃ আল্লাহপাক পৃথিবীর মানুষকে সৎ, ন্যায় ও সত্য পথে আনার জন্য মাঝে মাঝে এই ধরনের মহামারী দিয়ে সতর্ক করেন। অতীতেও করেছেন। পবিত্র কোরআনপাকে ও হাদীসে এই ধরনের সতর্কতামূলক মহামারীর নজির রয়েছে। ২০২০ সালের কোভিড-১৯ আমাদের সেই শিক্ষা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে মানুষ আরও বেশী আল্লাহমুখী হচ্ছে। তওবা করে ভাল পথে চলার চেষ্টা করছে। আরও বেশী করতে হবে। তবেই আল্লাহপাকা আমাদেরকে যে কোন উসুলায় করোনামুক্ত জীবনে ফিরে আনবেন। সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষ স্রষ্টার পথে এগিয়ে আসার তাগিদ হচ্ছে করোনা মহামারী।
আমাদের প্রত্যাশাঃ
১. করোনামুক্ত বাংলাদেশঃ ২০২১ সালের জন্য আমাদের প্রত্যাশা অনেক। করোনামুক্ত পৃথিবী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও করোনা মুক্ত হবে এই আশা আমরা করি। কিন্তু কিভাবে! এখনও করোনা ভ্যাকসিন পাওয়ার নির্দিষ্ট সময় জানতে পারি নাই। কত সংখ্যক মানুষ এই ভ্যাকসিন, কত দিনে গ্রণ করতে পারবে তারও কোন সুপরিকল্পনা সরকার ঘোষণা করে নাই। দ্রুত এই ব্যাপারে কর্ম পরিকল্পনা সরকার জাতিকে জানাবেন। আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বিশে^র সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। নতুন রূপে করোনা আবার দেশে এসে পড়েছে। দ্রুত ছড়াবার সম্ভাবনা বেশী বলে অনেকে বলছেন। বিগত প্রায় এক বছরে করোনা মোকাবেলার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যখাত দক্ষতার পরিচয় রাখুক- এ কামনা করছি। এই জন্য প্রয়োজন দক্ষ, সৎ, যোগ্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে সরকার দ্রুত কাজে লাগাতে হবে। এই জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নে কোন প্রকার অলসতা, অসতর্কতা প্রদর্শন থেকে সকলকে সরে আসতে হবে।
২. রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নঃ রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে দ্বিতীয় অধ্যায় বলা হয়েছে দেশে প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ করতে হবে। সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং সক্ষমতা অর্জন এই চারটি মৌলিক ভিত্তির উপর রূপকল্প ২০৪১। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগতমান উন্নত করাকে রূপকল্পে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘Why Nations Fail’ গ্রন্থে টেকসই উন্নয়নের জন্য ‘অন্তর্ভুক্তমূলক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
৩. গণতন্ত্রকে সুসংহত করাঃ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। তাই সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠানকে স্ব্ছ, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করতে হবে। ২০২১ সালে গণতন্ত্রকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে সরকারকে এখন থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলাকারী, সকলকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। রূপকল্প ২০৪১ জন্য উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান সমূহের মর্যাদা বৃদ্ধি ছাড়া কোন উপায় নাই। মানুষকে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ভোট প্রদনের আগ্রহ বৃদ্ধি করতে হবে। ভোট কেন্দ্র দখল ও নানা অনিয়ম থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এই জন্য নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন জরুরি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আগামি ২৬শে মার্চ ২০২১ কে তাৎপর্যপূর্ণ করার জন্য গণতন্ত্রকে সুসংহত ছাড়া কোন বিকল্প নাই।
৪. শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারঃ করোনাকালে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে। দীর্ঘ একটি বছর ছাত্রছাত্রীগণ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিশু শ্রম ও বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষাকে সকলের জন্য সহজ ও সহজ লভ্য করতে হবে। প্রতিটি শিশুকে শিক্ষার আলোতে আনতে হবে। এখনও দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ অক্ষত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। এ্ই অবস্থার পরিবর্তন নতুন বছরে আমাদের কাম্য।
মুখস্থ বিদ্যা ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন দ্রুত করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনসটিউটি স্থাপন করে বিদেশগামী শ্রমিককে দক্ষ করে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ দ্রুত কার্যকরী করতে হবে।
৫. দুনীর্তিকে না বলুনঃ করোনাকালে স্বাস্থ্য বিভাগসহ রাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান দুনীর্তি মহা উৎসব দেখা গিয়েছে। তাই দুনীর্তির লাগামকে শক্ত হাতে দমন করার জন্য ২০২১ সালকে বেছে নিতে হবে। স্বাস্থ্যখাতকে সম্পূর্ণ পুনর্গঠন করা দরকার। জাতীয় বাজেটে কমপক্ষে ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ রাখা উচিত। অনুরূপ শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ৬ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। নতুবা ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পৌঁছা আমাদের পক্ষে কঠিন হবে। ২০৪১ সালে রূপকল্পে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে তা কম। আরও বাড়াতে হবে। দুনীর্তিকে ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রত্যেককে নিজে দুনীর্তিমুক্ত থাকবো, অন্যকে দুনীর্তি করতে দেবো না এই শ্লোগানে শপথ নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে দুনীর্তির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ২০২১ সালে উক্ত ব্যবস্থাকে আরও বেশী বেগমান করতে হবে।
৬. সুশাসন ও সবার জন্য সমান আইনঃ ‘সুশাসন ও সবার জন্য সমান আইন’ নিশ্চিত করার জন্য সরকার কাজ করছেন। তাই বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছে। অনেক নতুন নতুন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মামলা বিচারকের অভাবে সময় লেগে যাচ্ছে। দ্রুত বিচার আইনের মাধ্যমে মামলার সংখ্যা কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু মানুষের চাওয়া আরও বেশী। মানুষ আরও বেশী, দ্রুত, স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা দেখতে চায়। সেই চেষ্টা ২০২১ সালে সরকার ও বিচার বিভাগ অব্যাহত রাখুক এই আমাদের প্রত্যাশা। সুশাসন নিশ্চিত না হলে রূপকল্প ২০২১ – ২০৪১ কোন ক্রমেই বাস্তবায়ন করে উন্নত জাতি হিসাবে বিশ্বের দরবারে আমরা আমাদের স্থান করে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
৭. চীনমুখি অর্থনীতি ও নদীর ন্যায্য হিস্যাঃ ভারত আমাদের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু। চীন ও আমাদের বর্তমানে উন্নয়নের অংশীদার। দেশের সকল মেগা প্রকল্পে চীনের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। ভারত আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল সহযোগী শক্তি। ভারতের সহযোগীতা না পেলে আমাদের স্বাধীনতা মাত্র ৯ মাসে অর্জন হয়তো অনেক কঠিন হতো। তাই অকৃত্রিম বন্ধুর নিকট থেকে আমাদের প্রাপ্য আদায় সহজ হবে। বর্তমান সরকার ২০২১ হয়তো তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তিসহ নানা সমস্যার সমাধান বের করে আনবেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার মত ন্যায় সংগত সিদ্ধান্ত ভারতকে নিতে বর্তমান সরকার সফল হবে।
চীন ১৯৭৬ সাল থেকে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর বড় বড় প্রকল্পে সহযোগীতা করে আসছে। বঙ্গবন্ধু চীন মৈত্রী হল আমাদের বন্ধনের বড় স্মৃতি চিহ্ন। পদ্মা সেতু, চীন মৈত্রী সেতু, তিস্তা বহুমুখী প্রকল্প প্রভৃতি চীনের সহযোগীতায় এগিয়ে যাচ্ছে। গভীর সমুদ্র নির্মাণ একমাত্র চীনের সহযোগীতায় করা সম্ভব। এই কাজটির জন্য সরকার নতুন বছরে কয়েকগুণ ক‚টনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করবে।
৮. রোহিঙ্গা সমস্যাঃ আমাদের বুকের মধ্যে পাথরের মত চাপ দিয়ে বসে আছে প্রায় ১১ লক্ষ বার্মার অধিবাসী মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এই বিপদ থেকে চীন ও ভারত আমাদের মুক্তি দিতে পারে। দুই দেশ আমাদের পরম বন্ধু। দুই বন্ধু থেকে কঠিন এই সময় সহযোগীতা প্রয়োজন। তিন বছর অতিক্রম হয়ে গেলো, আজও একটি রোহিঙ্গা বার্মা ফেরত নিলো না। খুবই দুঃখের বিষয়। সরকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে অধিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যদিকে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতকে এগিয়ে আসার জন্য নয়া কৌশল সরকারকে গ্রহণ করা উচিত। ২০২১ সালে হোক আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার আসল সমাধান। ফেরত নিয়ে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় নিজেদের জীবনকে গড়ার সুযোগ লাভ করুক- এ কামনা করি।
৯. আর্থিক খাতে সুশাসনঃবিগত কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংকিং, অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজারে চলেছে নানা অনিয়ম। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ লুট হয়েছে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক সমূহ থেকে বিপুল অর্থ অনিয়মের মাধ্যমে দেশেও বিদেশে পাচার হয়েছে। ব্যাংকগুলোর অবস্থা করোনার ফলে আরও বেশী খারাপ পর্যায় পৌঁছে গিয়েছে। সরকার ডিসেম্বর ২০২০ সাল পর্যন্ত কোন ঋণকে খেলাপী দেখতে বারণ করেছে। এই নিয়ম প্রত্যাহার পর আর্থিক খাতের আসল অবস্থা বুঝা যাবে। আইনের শাসনকে এই খাতে নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয় উভয়কে এই ক্ষেত্রে আরও বেশী স্বচ্ছ, সততা, ও নিয়ম নীতি মানার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। করোনা কালেও আমাদের প্রবৃদ্ধি চাঙ্গা হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাশ। রেমিটেন্স ও বেশ ভাল। রেমিটেন্স বেড়েছে ৪১ দশমিক ৩২ শতাংশ। রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলার।
তবে ব্যাংকের কর্তাদের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের অর্থ লোপাট করা প্রক্রিয়াকে চিরতরে বন্ধ করার জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। যে অন্যায় করবে, তার বিরুদ্ধে আইনের সত্যিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সৎ শাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ২০২১ সালে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সুতৎপরতা আমাদের সকলের নিকট কাম্য। ২০২০ সালে অর্থমন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সহযোগীতার যেমন উত্তম নজির স্থাপন করেছেন, তেমনি ২০২১ সাল হোক অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশোধন ও উন্নয়নের বছর। ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আর্থিক খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরে না আসলে দরিদ্র মানুষের অভাব দূর হবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ না বাড়লে দারিদ্র্যতা ও দূর করা সম্ভব হবে না। উন্নয়নের রোড মডেল বাস্তবে রোড মডেল হোক বাংলাদেশ এই কামনা নতুন বছরে।
১০. একাকী জীবনের অবসান হোকঃ করোনা আজ আমাদের একা করে ফেলেছে। একাকী, বন্ধ ঘরে আমরা বাস করছি। জীবনের আতংকে আমরা সকলের সামাজিক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। করোনায় মৃত্যুর পর জানাজাও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ আমাদের এখন পূর্বের মত নেই। করোনা আমাদের আত্মকেন্দ্রীক করে ফেলেছে। ২০২১ সালে আমরা এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাই। আমরা সকলকে নিয়ে পূর্বের মত বাঁচতে চাই। কিন্তু কি ভাবে? জীবন-যাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়া বিনোদন সকল কিছু থেকে আমরা একাকী। জীবন যেন থেমে গেছে। থেমে যাওয়া জীবন থেকে কর্মময় জীবনে মানুষ ফিরতে চায়। কিন্তু কিভাবে? এক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে পারেন। জীবন যুদ্ধে আমাদের জয় হতে হবে। তবে স্রষ্টার ইচ্ছা ছাড়া কোন উপায় এখনও মানুষ বিশ্ববাসীকে দেখাতে পারেনি। তাই কামনা আমাদের ২০২১ সাল হোক “একাকী” জীবনের শেষ বর্ষ।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।