Dr Hasan Mohammad

ড. হাসান মোহাম্মদ
সন্দ্বীপের কৃতি সন্তান

“শিক্ষার সর্বজনগ্রাহ্য কোন সংজ্ঞা না থাকলেও ‘ব্যক্তির যোগ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গী সমাজ স্বীকৃত উপায়ে সক্রিয় মুল্যবোধে উন্নীত করার সামগ্রিক সামাজিক প্রক্রিয়ার নাম শিক্ষা এবং এর প্রক্রিয়ালব্ধ ফলও শিক্ষা’ বলে অভিহিত করা হয়। ঠেকে, দেখেও কাগজে কলমে যে জ্ঞান আহরণ করা হয় এবং তাকে পরবর্তীতে কাজে লাগানো, ব্যবহার করার ক্ষমতার্জন কিংবা তার পরিমাপ করা, যার আলোকে আর একটি বিষয়কে সহজীকরণ করে প্রয়োগসিদ্ধ ও ফলপ্রসূ করে তোলার ক্ষমতা লাভই শিক্ষা।

মহাকবি মিল্টনের সংজ্ঞায় শিক্ষা হচ্ছে Education is the harmonious development of body, mine and soul. যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের শিক্ষা আকাক্সক্ষা, চাহিদা ইত্যাদির ও পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের জীবন যত বেশী উন্নত, জটিল ও আধুনিক হয়েছে শিক্ষার বৈচিত্র্য ও প্রয়োজনীয়তা ততো বেশি বেড়েছে। শিক্ষা এখন আর বিশেষ বয়সীমায় সীমাবদ্ধ নয়Ñ জীবনব্যাপী মানুষকে শিখতে হয়। যে মানুষ যতো বেশি শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত সে মানুষ এবং সে জাতি ততো বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনমানের অধিকারী।”

অধ্যাপক ড. হাসান মোহম্মদ ‘শিক্ষা ও উন্নয়ন প্রেক্ষাপট সন্দ্বীপবাসীর জীবন সংগ্রাম শীর্ষক এক প্রবন্ধে উপরে উল্লিখিত কথাগুলো শিক্ষা সম্পর্কে প্রবেন্ধর শুরুতে লিখেছেন।

শিক্ষা সম্পর্কে ড. হাসান মোহম্মদ এর ধারণা খুবই স্বচ্ছ ও নির্মল ছিল। তিনি ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত, দেশপ্রেমিক, সহজ, সরল, চরিত্রবান ব্যক্তিত্ব।

ড. হাসান মোহম্মদ চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলায় সাতঘড়িয়া গ্রামে ১ লা জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মাওলানা সৈয়দ আহমদ একজন আলেম, শিক্ষাবিদ, বাগ্নী ও লেখক ছিলেন। শৈশবই হাসান মোহাম্মদ তাঁর প্রিয় মা শহীদা বেগমকে হারান। শৈশবে মা হারা হাসান মোহম্মদ বাবার আদর যত্নে বড় হয়ে উঠেন। পিতা প্রখ্যাত আলেম হওয়ার সত্তে¡ও তিনি আরবী বা মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। সাতঘরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হয়ে ইংরেজী শিক্ষায় যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে দক্ষিণ সন্দ্বীপ হাইস্কুলে ভর্তি হন। নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। ৬৯-এর গণআন্দোলনে সন্দ্বীপের স্কুল ছাত্র হিসাবে নেতৃত্বে চলে আসেন। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে তখনকার দক্ষিণ সন্দ্বীপ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, আমার প্রিয় প্রধান শিক্ষক আবুল খায়ের মিয়া হাসান মোহাম্মদকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করেন। আমি ১৯৬৮ সালে পূর্ব সন্দ্বীপ হাইস্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে দক্ষিণ সন্দ্বীপ হাইস্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। তখন দক্ষিণ সন্দ্বীপ হাইস্কুলের বেশ সুনাম ছিল। আবুল খায়ের হেড মাস্টার স্যারের পরিচালনায় স্কুলের এসএসসি পরীক্ষায় বেশ ভাল ফলাফল করছিল। আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়ার স্বত্বেও ঐ স্কুলে ভর্তি হলাম। খুবই কষ্ট হচ্ছিল। বাড়ি উত্তর মাগরা থেকে শিবের হাট সাউথ সন্দ্বীপ হাইস্কুলে হেঁটে যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগতো। তখন চলাচলের খুবই অসুবিধা ছিল। গরুর গাড়ি ছিল চলাচলের একমাত্র বাহন। নতুবা পায়ে হেঁটে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হতো।

ছাত্র রাজনীতি তখন কিছুই বুঝতাম না। একই স্কুলের ছাত্র হওয়ার সত্ত্বেও এত কিছু হাসান মোহম্মদ এর জীবনে ঘটে গেল, আমি কিছুই জানতাম না। তাকে প্রধান শিক্ষক স্কুল থেকে বহিষ্কার করেছে, তাও এখন জানলাম। আমরা তখন শুধু লেখাপড়া ছাড়া অন্য কোন কিছুর সঙ্গে জড়িত হতাম না। স্কুলে যেতাম, আর বাড়ি ফিরে আসতাম। মাঝে মাঝে কিছু খেলাধুলা করেছি মাত্র। তাও ফুটবল। দক্ষিণ হাইস্কুলে গিয়ে তাও ফুটবল খেলা খেলতে পারি নাই।

থাকার সমস্যায় পড়ে আমার এক গৃহ শিক্ষকের বাড়ি মাইটভাঙ্গয় থাকতাম। পরবর্তীতে লজিং থেকে স্কুল জীবন কাটাতে হয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণী লজিং থেকে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করে এসএসসি পরীক্ষা চার বিষয়ে লেটার মার্ক নিয়ে সাউথ সন্দ্বীপ হাইস্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে পাস করি। এরই এক বছর পর ১৯৭০ সালে হাসান মোহম্মদ মাইট ভা্গংা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন হাসান মোহম্মদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকার টিএন্ডটি কলেজে প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন। বিসিএস (এডুকেশন) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সন্দ্বীপ এবি কলেজে মাস কয়েক শিক্ষকতা করেন। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। একই বিভাগ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।

ড. হাসান মোহম্মদ একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ ও কর্মী ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নে সংযুক্ত হয়ে ছাত্র রাজনীতি করেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। ভাল বক্তা। আদর্শ লেখক। সমাজ সেবক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি দায়িত্ব পালনসহ নিজ বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন।
জন্মস্থান সন্দ্বীপ নিয়ে ড. হাসান মোহম্মদের আগ্রহ ছিল অসামান্য। সন্দ্বীপ নিয়ে তার জীবন ও চিন্তা ছিল অনেক বেশি। সন্দ্বীপের উন্নতি, উন্নয়ন নিয়ে নানা সংগঠনের সঙ্গে তিনি নিয়মিত কাজ করেছেন। সন্দ্বীপ সমিতি চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা, সন্দ্বীপ শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংস্থার সঙ্গে আজীবন হাসান মোহম্মদ জড়িত ছিলেন। স্কুল জীবন থেকে হাসান মোহম্মদ লেখালেখির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭০ সালে স্কুল জীবনে ‘সন্দ্বীপ’ নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করে সুনাম অর্জন করেন। তার লেখা প্রথম বই ‘কমরেড মোজাফফর আহমদ ও বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। তার সম্পাদিত সন্দ্বীপ (১৯৬৯), সন্দ্বী সমীক্ষা (১৯৯৯), সন্দ্বীপ শিক্ষা সমীক্ষা (২০১২), দ্বীপান্বিত (২০০৯), একেএম রফিক উল্লাহ চৌধুরী জীবন ও কর্ম (২০১২), সন্দ্বীসমগ্র সন্দ্বীপড়িয়া (২০১৭) প্রকাশিত হয়।

‘সন্দ্বী সমগ্র সন্দ্বীপিডিয়া’ হাসান মোহম্মদের এক বিশাল গ্রন্থ। বার শত পৃষ্ঠায় সম্পাদিত এই গ্রন্থে সন্দ্বীপের অসংখ্য লেখক লেখিকার প্রবন্ধ, কবিতা স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটিতে সন্দ্বীপের ইতিহাস ঐতিহ্য, শিক্ষা, নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ের বহু প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।

উক্ত গ্রন্থে হাসান মোহাম্মদ “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: সন্দ্বীপবাসীর ভ‚মিকা” শীর্ষক এক প্রবন্ধের শুরুতে বলেন-
“বিদ্যিায়তনিক পরিভাষায় ভ‚খন্ডগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর ব্যাপক কিংবা সমগ্র জনগণের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকে মুক্তি বলে অভিহিত করা হয়। এ দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করলে একটি জনগোষ্ঠীর ভ‚খন্ডগত স্বাধীনতা অর্জন সংগ্রামের সমাপ্তি গটলেও মুক্তি সংগ্রাম থাকে সুদীর্ঘ কল্যাণব্যাপী অব্যাহত।”

ড: হাসান মোহাম্মদ সব সময় সন্দ্বীপ নিয়ে চিন্তা করতেন, ভাবতেন, লিখতেন। সন্দ্বীপ দেশের মানুষের জন্য একটি উপযোগী দ্বীপ তৈরীতে তার জীবনের পুরো সময় ব্যয় করেন। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি একই প্রবন্ধে আরও বলেন-
“ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক ও স্বভাবগত কারণে সন্দ্বীপবাসী সব সময় রাজনীতি সচেতন ও রাজনীতিপ্রবণ। দিলওয়ার খাঁ, আবু তোরাপ চৌধুরী, চাঁন মিয়া মুনশী, কমরেড মোজাফফর আহমদ, লালমোহন সেন, রাজকুমার চক্রবর্তী, সেকান্দর হোসেন মিয়া, রফিকউল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ হচ্ছেন সন্দ্বীপ রাজনীতির কিংবদন্তী। বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীনতার আন্দোলনে সন্দ্বীবাসীর রয়েছে অনন্য অবদান। এই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে সন্দ্বীপবাসী হয়েছেন সক্রিয়, নিবেদিত।”

ড: হাসান মোহম্মদ একজন শিক্ষক ছিলেন। তার পুরো জীবন তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিয়ে কাটিয়েছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখা ছিল তার আনন্দের বিষয়। তিনিপ্রচুর লিখেছেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞান ছাড়াও সমাজ, সংস্কৃতি বিশেষ করে সন্দ্বীপের উন্নয়ন, ইতিহাস নিয়ে তিনি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত লিখে গিয়েছেন। লেখার অভ্যাস তার স্কুল জীবন থেকে ১৯৬৯ সালে নবম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায় সন্দ্বীপ এডুকেশন সোসাইটি চট্টগ্রামের এক প্রবন্ধ প্রতিযোগীতায় প্রথম পুরষ্কার লাভ করেন। বিষয় ছিল ‘সন্দ্বীপের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত।’

তাই দেখা যায় ২০১৭ সালে প্রকাশিত তার লেখা এক প্রবন্ধে তিনি অতি সুন্দরভাবে সন্দ্বীপের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্মপন্থা উল্লেখ করে যে প্রবন্ধ লিখেছেন, তা সন্দ্বীপের একটি অতি সুন্দর, চমৎকার, সুলিখিত প্রবন্ধ। ইতিহাসে সব সময় এই লেখা পাঠকদের উৎসাহিত ও জ্ঞানী করে তুলতে সহযোগিতা করবে। তার জ্ঞানের গভীরতা জানার জন্য উক্ত প্রবন্ধের শুরুর একটি প্যারা উল্লেখ করছি:
“মানবজাতি কিংবা জনগোষ্ঠী বিশেষের কার্য ও ঘটনার অনুপুঙ্খ সত্যানুসন্ধানকে ইতিহাস বলে। কোন অঞ্চল বিশেষে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর উদ্ভব, বিকাশ ইত্যাদি ধারাবাহিক পর্যালোচনাকেও ইতিহাস বলা হয়। মানবজাতি বা গোষ্ঠীর বিশেষের জীবন, জীবিকা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয়সমূহও ইতিহাসের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। এ কারণেই কার্ল মার্কস বলেছেন, মানুষের কর্ম ও সংগ্রামের বিবরণই হচ্ছে ইতিহাস। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় উপক‚লীয় দ্বীপভ‚মি সন্দ্বীপের উৎপত্তি, বিকাশ, জনগণের জীবনযাপন সংগ্রাম ইত্যাদি হচ্ছে এ ভ‚খন্ডের ইতিহাসের স্বাভাবিক প্রধান উপজীবী বিষয়। ”

তিনি ছিলেন অত্যন্ত একজন আশাবাদী মানুষ। জীবনযুদ্ধে তিনি জয়ী। তিনি সফল। জীবনের সফলতার শেষ পর্যায়ে তিনি সমাজকে অনেক অনেক বেশী দিয়েছেন। তাই তার লেখনি থেকে সব সময় আশাবাদের বাণী দেখতে পাই। প্রবন্ধের শেষে তিনি তাই উল্লেখ করে বলেছেন-
“বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থান সন্দ্বীপবাসীকে কর্মচঞ্চল, কর্মোদ্যোগী ও সংগ্রামী হতে বাধ্য করেছে। সন্দ্বীপবাসীর প্রায় পুরো অর্জনই স্বোপার্জত বলা যায়। দ্বীপবাসীর এ সাধনা ও সংগ্রামের সঙ্গে আরও বেশী করে সরকারী উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা যুক্ত হলে এটি হবে আরও পূর্ণতর। আমরা আশাবাদী, পর্বক্ষেত্রে সন্দ্বীপবাসীর যে পুনর্জাগরণ সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে, রাজনৈতিক হানাহানি মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে সেটি অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে। আমাদের প্রত্যাশা, দুঃখময় নিকট অতীত পেছনে ফেলে আমরা সম্মুখপানে এগিয়ে যাবো।”

ড: হাসান মোহাম্মদ ছাত্র জীবন থেকে খুবই সংগ্রামী, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী ছিলেন। আমার এক সময় ধারণা ছিল হাসান মোহাম্মদ সন্দ্বীপের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করবেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক শিক্ষকতা জীবনই তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তবে নানাভাবে সারাটা জীবন তিনি রাজনীতির পরিমণ্ডলে বিচরণ করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা রাজনীতির একক নেতৃত্ব নীতি দিয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলার একজন সফল বুদ্ধিজীবী হিসাবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি নিজকে সন্দ্বীপের একজন গুরু, উপদেষ্টা ও অভিভাবকের স্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারই উপদেশও পরামর্শে সন্দ্বীপ সংগ্রাম ও ঢাকায় নানা সমাজসেবা, শিক্ষামূলক, চিকিৎসা বিষয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

ড. হাসান মোহাম্মদ বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদ, সন্দ্বীপ এসোসিয়েশন-চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ এডুকেশন সোসাইটি-চট্টগ্রামসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের জীবন সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

সন্দ্বীপ সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে হাসান মোহাম্মদ জড়িত ছিলেন। সাউথ সন্দ্বীপ কলেজ, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ উত্তোলন পাঠাগার, সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টার, সন্দ্বীপ আনন্দ পাঠাগার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ২০০২ সালে আমি যখন সন্দ্বীপে মহিলা শিক্ষাকে আধুনিক, মজবুত ও সুন্দর পরিবেশ মেয়েদের শিক্ষার জন্য আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই, তখন থেকে হাসান মোহাম্মদ নানাভাবে আমাকে সহযোগিতা করেন। আমার মনে পড়ে প্রথম যখন মহিলা কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ দেবো সেই কমিটির সভাপতির দায়িত্বপালন করে ড: হাসান মোহাম্মদ। আর মহিলা কলেজের মূল চালিকাশক্তি তখন ছিলেন এ.ওয়াই. এম সায়েদুল হক, ওরফে আবু মাষ্টার। আবু মাস্টারের সার্বিক সহযোগিতায় তখন আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, এনাম নাহার বালিকা বিদ্যালয়, হারা মিয়া ২০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল, পূর্ব সন্দ্বীপ হাই স্কুল, পূর্ব সন্দ্বীপ পাবলিক হাই স্কুল, সেকান্দর সাফিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা, উত্তর মগধরা জামে মসজিদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান দ্রæত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

হাসান মোহাম্মদের ছোট্ট পরিবার। দুই সন্তান সুশিক্ষিত। দুই সন্তান বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অন্যজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা করছেন। স্ত্রী মিসেস হাসান একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা।

লেখক হিসেবে হাসান সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা, রাজনৈতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব ইত্যাদি হাসান মাহমুদের গবেষণার ও লেখার প্রধান উপজীব্য বিষয়। এই সব বিষয়ে তার দশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি বই এর পান্ডুলিপি তৈরিকরে রেখে গিয়েছেন।

তার গবেষণা মুগ্ধ হয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী তার নির্দেশনায় এম.ফিল ও পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা সমাপ্ত করেছে।
অতি অল্প সময়ে হাসান মোহাম্মদ আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গিয়েছেন। তিনি ইনন্তেকাল করেন১১ এপ্রিল, ২০২১।
নতুন প্রজন্ম হাসানের আদর্শে অনুপ্রেরণা নিয়ে দেশ গড়ায় এগিয়ে আসবে। দেশকে ভালবাসবে। দেশের উন্নয়নে হাসান মাহমুদের মতো করে জীবন যাপন করবে। একজন সৎ, উদ্যোগী, চিন্তাশীল, দেশপ্রেমিক, শিক্ষাবিদ ছিলেন সন্দ্বীপের কৃতি সন্তান ড. হাসান মোহম্মদ।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments