COP26 Conference 2021

জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬
কি অর্জিত হলো

জলবায়ু নিয়ে আন্দোলন আজ বিশ্বজুড়ে বেশ সামনের স্থানে গিয়ে পৌছেচে। তরুণ সমাজ জলবায়ু ও এর প্রভাব, মানবজীবন ও জীবন যাপন অবস্থা নিয়ে বিশ্বের তরুণেরা বেশ সোচ্চার। কপ-২৬ সম্মেলনে গ্লাসগোতে কিনা ঘটলো। প্রতিদিন আন্দোলন, প্রতিবাদ, দাবি উচ্চারিত হয়েছে। নতুন নতুন প্রতিবাদ কর্মসুচি সকলের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ধনী দেশ সমূহের নেতাদের বিবেকে কিছুটা হলেও জাগরণ, চিন্তা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আন্দোলনকারী তরুণ দল বিশ্বের বিবেকবান মানুষের নিকট কিছুটা হলেও পানি দিয়ে ভিজানোর চেষ্টা করেছে। আগামীতে হয়তো কপ-২৭ সফলতার দ্বারে উপনীত হবে। মিশরে এই সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্লাসগো ঘোষণা ঐতিহাসিকআপসের দলিল:
জলবায়ু সম্মেলনের গ্লাসগো চুক্তিকে সম্মেলনের (কপ ২৬) সভাপতি ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মা ঐতিহাসিক অভিহিত করলেও তা যে একটি আপসের দলিল, সে কথা বলেছেন খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গ্লাসগোতে কী অর্জিত হয়েছে, তা বলতে গিয়ে অধিবেশনকক্ষেই একজন প্রতিনিধি বলেছেন, ‘আমি আশাবাদী মানুষ হিসেবে গ্লাসটিকে অর্ধেক খালি না বলে অর্ধেক ভরা হিসেবে বর্ণনা করব। বস্তুত সেটাই ঘটেছে।’
কিছু ভালো সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই পাওয়া গেছে, যেগুলোকে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে কেউ কেউ যুগান্তকারী বলে দাবি করছেন। তবে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে যাঁরা চিন্তিত, যাঁরা সত্যিই বিশ্বাস করেন, একটি দিনের বিলম্বও পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে, তাঁদের হতাশা ও ক্ষোভ মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। বিপন্নবোধ করেছে জলবায়ু– ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো। তাদের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে মালদ্বীপের প্রতিনিধির কণ্ঠে যখন তিনি বলেন, মালদ্বীপের জন্য এতে খুব দেরি হয়ে যাবে।
সরকারি প্রতিনিধিরা কূটনৈতিক রীতিনীতির কারণে অনেক কথাই বলতে পারেন না। কিন্তু নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিরা তা বলতে পারেন, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সমাজে। বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর জোট কপ ২৬ কোয়ালিশনের মুখপাত্র আসাদ রেহমান বলেছেন, এই চুক্তি জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। জলবায়ুজনিত জরুরি অবস্থার বিষয়ে ধনী দেশগুলোর ফাঁকা বুলিতে বিজ্ঞান এবং ন্যায়বিচার চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। ধনী দেশগুলো তাদের কারণে সৃষ্ট সমস্যায় সংকটে পড়া দরিদ্র দেশগুলোর অর্থায়নের প্রশ্নে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
সম্মেলন থেকে যেসব পদক্ষেপের ঘোষণা এসেছে, তার মধ্যে আছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমিত রাখার লক্ষ্য অর্জনের প্রতি অঙ্গীকার; অভিযোজন, অর্থাৎ জলবায়ুজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থায়ন দ্বিগুণ করার অঙ্গীকার; জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো যে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণে যে বাড়তি সহায়তা প্রয়োজন, তার স্বীকৃতি এবং প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিতে উৎসাহিত করা। কার্বন গ্যাসের লেনদেনে স্বচ্ছতা ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্যারিস রুল বুক নামে পরিচিত বিধিমালাও চূড়ান্ত হয়েছে গ্লাসগো সম্মেলনে। সর্বোপরি, এখন গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোসহ সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি দেশকে প্রতিবছর তাদের জাতীয় ভ‚মিকার অঙ্গীকার বা এনডিসি হালনাগাদ করতে হবে, যাতে বার্ষিক পর্যালোচনার কারণে বড় দূষণকারীদের ওপর কিছুটা চাপ বাড়বে।
এ ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে আরও কয়েকটি ঘোষণা এসেছে, সেগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে কার্বনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস উদ্গিরণ কমানোর লক্ষ্যে বন উজাড়করণ বন্ধ, মিথেন গ্যাস উদ্গিরণ বন্ধ, নেট জিরো (ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন যতটা হবে, বায়ুমন্ডল থেকে ততটাই অপসারণ করে ভারসাম্য আনা) অর্জনে বেসরকারি অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। গতকাল কপ সভাপতি অলোক শর্মা বিবিসিকে জানিয়েছেন, গ্লাসগো সম্মেলনের আগে নেট জিরোর লক্ষ্য ঘোষণা করেছিল ৩০টি দেশ, যার সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৯০।
গ্লাসগোয় অবশ্য কূটনৈতিক দিক দিয়ে এক চমকপ্রদ অগ্রগতি আছে, যা জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ভবিষ্যতে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলেই সবার ধারণা। প্রায় সব বিষয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেওয়ায় অভ্যস্ত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিস্ময়কর সহযোগিতার ঘোষণা গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো ও বনাঞ্চল রক্ষার ক্ষেত্রে যেমন আশা জাগিয়েছে, তেমনই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে যে সিদ্ধান্তটি, সেটি হলো কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি অবসায়নের প্রস্তাব। শেষ মুহূর্তে ভারতের আনা সংশোধনী পর্যায়ক্রমে অবসায়নের (ফেজ আউট) বদলে পর্যায়ক্রমে কমানো (ফেজ ডাউন) নিয়ে যথেষ্ট নাটকীয়তাও দেখা গেছে। গত ৩০ বছরে অর্থাৎ আগের ২৫টি কপ সম্মেলনে কখনোই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো বা ভর্তুকির ইতি ঘটিয়ে তা নিরুৎসাহিত করার কথা আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় স্থান পায়নি। কিন্তু এবার এগুলোর অন্তর্ভুক্তিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
গ্লাসগো সম্মেলনের খসড়াটি গৃহীত হওয়ার পর জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, এসব পদক্ষেপকে স্বাগত জানাতে হয়, কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। জরুরি অবস্থায় যা করণীয়, তা না করলে নেট জিরোতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শূন্য। তিনি বলেছেন, এই বিবৃতিতে বিভিন্ন স্বার্থ, পরিস্থিতি, দ্ব›দ্ব এবং বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গভীর দ্ব›দ্বগুলো কাটিয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট সম্মিলিত রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব ছিল।
সম্মেলনে যা অর্জিত হয়নি, সেগুলোরও উল্লেখ পাওয়া যায় জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতিতে। এগুলো হলো জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করা, কয়লার অবসান, ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় ১০ হাজার কোটি ডলার অর্থায়নের অঙ্গীকার পূরণ।
শীর্ষ দূষণকারী শিল্পোন্নত দেশগুলো এবং কম দূষণকারী কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট সম্মেলনের পুরোটা সময় জুড়ে শোনা গেছে। ধনী দেশগুলো কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি দেদার ব্যবহার করে জলবায়ুর যে ক্ষতি করেছে, তার ঐতিহাসিক দায় গ্রহণ না করলেও গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে ক্ষতিকর গ্যাস উদ্গিরণ বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি তাই অনিষ্পন্ন থেকে যাচ্ছে।
১৩ নভেম্বর গ্লাসগো চুক্তি হয়েছে। ঠিক ৫১ বছর আগে (১২ ও ১৩ নভেম্বর) বাংলাদেশের উপক‚লে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জোটের (সিভিএফ) নেতৃত্বেও এখন বাংলাদেশ। সিভিএফের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী গত শুক্রবার সম্মেলনে আহ্বান জানিয়েছিলেন যে জলবায়ু সংকটের আশু বিপদ বিবেচনায় নিয়ে সম্মেলনের সিদ্ধান্তকে গ্লাসগো জরুরি চুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হোক। যে প্রত্যাশা থেকে তিনি প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন তা পূরণ হয়েছে কি না, প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি একে চরম হতাশাজনক হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ইউএনএফসিসিসির বিদ্যমান কর্মপদ্ধতিতে আমাদের কতটা সাহসী ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে, এখন সেই প্রশ্ন করার সময় এসেছে। কপ ২৬-এর ফলাফলে বিজ্ঞান যে কার্যক্রম দাবি করে, সেটাও যেমন প্রতিফলিত হয়নি, তেমনি প্রতিফলিত হয়নি আকাক্সক্ষা। সবাই সব বিষয়ে একমত না হওয়া পর্যন্ত কোনো সমঝোতা না হওয়ার নীতির মানে হচ্ছে আপসরফা-ন্যূনতম যতটুকু সম্মত হওয়া যাবে, ততটুকুই অর্জন।
বোঝাই যাচ্ছে এ ধরনের বহুজাতিক কাঠামোয় জরুরি অবস্থা মোকাবিলাও কঠিন সংগ্রামের বিষয়। সে কারণেই সম্মেলনে প্রতিনিধিদের অনেকেই বলেছেন, তাঁরা লড়াইটা আগামী জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৭) মিসরের শারম-আল শেখে নিয়ে যাবেন। আর জাতিসংঘের মহাসচিব এক টুইটে তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন, লড়াইয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে আছেন।

কী আছে জলবায়ু চুক্তিতে:
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ ২৬ শেষ হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহের আলোচনার পর অসন্তোষ থাকলেও, শেষ মুহূর্তে মতৈক্য হয়েছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর। স্থানীয় সময় গত শনিবার রাতে এক চুক্তিতে প্রায় ২০০টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। জিইয়ে রেখেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দ্রæত কমিয়ে আনার প্রত্যাশা।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে কথা:
গ্লাসগো চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেশগুলোকে আগামী বছরের মধ্যে শক্তিশালী পরিকল্পনা প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণের সুনির্দিষ্ট মাত্রা ঠিক করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে গ্লাসগো সম্মেলন।
এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা না গেলে সমুদ্রসীমার উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে খরা, ঝড়, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাও। কপ ২৬-এর চেয়ারম্যান ও ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মা বলেন, ‘আমরা যদি প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারি, তবেই নিজেদের রক্ষা করতে পারব।’

কয়লার ব্যবহার নিয়ে অসন্তোষ:
এবারের জলবায়ু সম্মেলনে প্রথমবারের মতো দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে কয়লার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে জোর দিতে সফল হননি আলোচকেরা। বরং শেষ মুহূর্তে এই বিষয়ে ছাড় দিয়ে কয়লার ব্যবহার কমানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে চূড়ান্ত চুক্তিতে কয়লার ব্যবহার কমানো বা ‘ফেজ ডাউন’ করার ভাষাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগের খসড়ায় তা বন্ধ করা বা ‘ফেজ আউট’ করার কথা ছিল। ভারতের পক্ষ থেকে এ পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এমন পরিবর্তনে অসন্তোষ জানিয়েছে সুইজারল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ।

ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিরোধ:
ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে জলবায়ু তহবিলে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি। ফলে অনেক উন্নয়নশীল ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অভিযোজন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পিছিয়ে রয়েছে। গ্লাসগোর চূড়ান্ত চুক্তিতে ২০২৫ সালের মধ্যে ধনী দেশগুলোকে জলবায়ু তহবিলে বরাদ্দের পরিমাণ অন্তত দ্বিগুণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

কার্বন নিঃসরণের দায়
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। তবে বেশি বেশি কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে এর পেছনে দায়ী ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। চূড়ান্ত চুক্তিতে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ ও কোম্পানিগুলোকে দায় মেটাতে অর্থায়ন করতে বলা হয়েছে। এসব অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোয় বনের ধ্বংস ঠেকানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গৃহীত নানা উদ্যোগের বাস্তবায়নে ব্যয় করা হবে।

আরও নানা চুক্তি:
গ্লাসগোয় মূল সমঝোতার বাইরে আরও কয়েকটি চুক্তি সবার নজর কেড়েছে। এবারের সম্মেলনে জাতিসংঘ ও ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রায় ১০০টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে মিথেন গ্যাসের নির্গমন গত বছরের মাত্রার তুলনায় ৩০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দুটি দেশ-যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে একমত হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা গ্যাসোলিনচালিত গাড়ি উৎপাদন বন্ধ, আকাশপথে ভ্রমণে কার্বন নিঃসরণ কমানো, বন রক্ষার মতো টেকসই উদ্যোগে অর্থ লগ্নি না করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।

‘জলবায়ু বিপর্যয়ের দরজায় কড়া নাড়ছি আমরা’:
আসন্ন জলবায়ু বিপর্যয়সম্পর্কে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, জলবায়ু বিপর্যয় সন্নিকটে। গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, তবে যথেষ্ট নয়।’ অন্যদিকে চুক্তি নিয়ে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ টুইট করে বলেছেন, কপ ২৬ শেষ হলো। এবারের সম্মেলনের সারসংক্ষেপ হলো, বøা, বøা, বøা ।
যাঁরা গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তিতে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁরাও বলেছেন, এখনো এ নিয়ে অনেক কাজ বাকি আছে। গত শনিবার রাতে গ্লাসগো চুক্তির পর এক বিবৃতিতে গুতেরেস চুক্তির ত্রæটিগুলো স্বীকার করেছেন। তিনি টুইট করে বলেছেন, কপ ২৬-এর ফলাফল হলো একটি সমঝোতা, যা আজকের বিশ্বের স্বার্থ, দ্ব›দ্ব এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার অবস্থা প্রতিফলন করে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আরও বলেন, ‘এখন জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার উপযুক্ত সময়। জলবায়ু যুদ্ধ আমাদের জীবন বাঁচানোর লড়াই, যাতে আমাদের অবশ্যই জিততে হবে।’
জাতিসংঘ মহাসচিব সতর্ক করে বলেন, ‘আমাদের নাজুক বিশ্ব সুতার ওপর ঝুলছে। আমরা এখনো জলবায়ু বিপর্যয়ের দরজায়কড়া নাড়ছি।’
সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ জলবায়ু চুক্তি নিয়ে আরও কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁর ভাষ্য, প্রকৃত কাজ হয়েছে সম্মেলনস্থলের বাইরে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কখনো হাল ছাড়ব না।’
সম্মেলন চলাকালে থুনবার্গসহ অন্য পরিবেশকর্মীরা অভিযোগ করেন, বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তব পদক্ষেপের কোনো মিল নেই।
এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জলবায়ু চুক্তিকে একটি ‘বঙপদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।
ইউরোপীয়কমিশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চুক্তিটি ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যগুলোকে বাঁচিয়েরেখেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করার সুযোগ দিয়েছে।
চুক্তিতে শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য আহ্বান জানায় ভারত ও চীন। তারা কয়লার ব্যবহার ‘ফেজ আউট’ করার পরিবর্তে ‘ফেজ ডাউন’ করতে বলে। শেষ পর্যন্ত তা অনুমোদন পেলেও অনেক দেশ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
চুক্তি নিয়ে শনিবার রাতে এবারের সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট অলোক শর্মা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কঠিন কাজ এখন শুরু হলো। আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার লক্ষ্য টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। তবে আমি এখনো বলছি যে ১.৫ ডিগ্রির যে নাড়ি আমরা পাচ্ছি, তা দুর্বল। আমরা যদি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি, তবেই এটি টিকবে।’
চুক্তি নিয়ে মার্কিন জলবায়ু দূত জন কেরি বলেন, প্যারিস ক্ষেত্র তৈরি করেছিল এবং গ্লাসগোর দৌড় সেখান থেকে শুরু হয়েছে। শনিবার রাত থেকে সে দৌড় শুরু হলো।
চীনের আলোচক ঝাও ইংমিন বলেছেন, ‘আমাদের সবচেয়েবড়সাফল্য হল রুলবুক চূড়ান্ত করা।’

আমাদের করণীয় :
উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশ জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ইতিমধ্যে দেশে না দুর্যোগ প্রতি বছর জনগণ জোগার করছে। এ আস্থার পরিবর্তনের জন্য জনগণও সরকারকে অনেক বেশি করণীয় কর্তব্য রয়েছে।
প্রথমত: আমাদের দেশের মানুষকে জানাতে হবে জলবায়ুগত দূষণের ফলে দেশ ও জনগণ কিভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মানুষ সতর্ক করতে হবে। প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণে তৈরি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত: সব কারণে গবেষক, কর্তৃক প্রয়োজনীয় কর্তব্য নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষ ‘সেল’ গঠন করতে হবে। সেই সেল থেকে নিয়মিত সতর্কতা ও করণীয় পরামর্শ সরকার ও দেশবাসীকে দিতে হবে।
তৃতীয়ত: আন্তর্জাতিক বড় বড় শক্তির কার্যকরণে জলবায়ুগত পরিবর্তন দেশে দেশে ঘটছে। তারই প্রভাবে আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, বন্যা প্রভৃতি নিয়মিত হচ্ছে। তাতে দেশের সম্পদ ও মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। সেই ক্ষতি পূরণের জন্য চাহিদাপত্র তৈরি করে আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়মিত উপস্থাপন করে আদায় করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের নিকট তার ক্ষতি অর্থ সহজে, স্বল্প সময়ে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
কপ-২৬ এ গৃহিত পদক্ষেপ সমূহ কিভাবে আমাদের দেশে কার্যকরী হবে, তার ব্যবস্থা এখন থেকে দ্রæত গ্রহণ করা প্রয়োজন। শুধু ধনী দেশসমূহের উপর নির্ভর না করে। নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যরে উপর বিশ্বাস রেখে অগ্রসর হতে হবে।
জলবায়ু সংক্রান্ত নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য আমাদের বনায়নে অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে। প্রতিবছর পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শুধু বৃক্ষ রোপন দিবস পালন করে বসে থাকলে চলবে না, বাস্তবায়নে আরও বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হবে। আমাদের জনসংখ্যা, জমি অনুযায়ী বনায়ন অনেক কম। তাই জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের নানা বিপর্যয় নেমে আসে। অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা প্রভৃতি বনায়নে ভ‚মিকা রাখে।
তাছাড়া নদী এলাকায়, দ্বীপ অঞ্চলের ভাঙ্গন রোধের জন্য বনায়ন ব্যাপক সৃষ্টি জরুরী। সরকার প্রতি বছর ঘটা করে বৃক্ষ রোপন দিবস পালন করে দেশবাসীকে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছে। বৃক্ষরোপনের ফলে দেশের জমি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার কথা বলা চলে। সন্দ্বীপের পশ্চিম ও উত্তর ভাগ দিয়ে শত শত একর জমি মূল ভ‚খন্ডের সঙ্গে ইতিমধ্যে যোগ হয়েছে। সেখানে সরকার রপতানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল করার উদ্যোগ নিয়েছে। অচিরে সন্দ্বীপে একটি আধুনিক রফতানি অঞ্চল সৃষ্টি হচ্ছে। যা সরকারের একশত রফতানি অঞ্চলের একটি হবে।

Abul Quasem Haider
আবুল কাসেম হায়দার

সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।

লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মোঃ মোশাররফ হোসাইন
মোঃ মোশাররফ হোসাইন
2 years ago

স‍্যার, আসসালামু আলাইকুম। আপনার লেখাটি অত‍্যন্ত চমৎকার, বস্তুনিষ্ঠ, তথ‍্যবহুল ও সময়োপযোগী। বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন অধিকাংশই মানবসৃষ্ট। আপনার দেয়া সুপারিশমালা কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি।