১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট পেশ করলেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ১১ জুন ২০ জাতীয় সংসদে। এই বাজেট অধিবেশন সংক্ষিপ্ত, নিয়মনীতি মেনে করোনা পরিস্থিতি সামনে রেখে। ২০২০-২০২১ সালের বাজেট হচ্ছে ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে উদ্ধারের জন্য বিশাল ব্যয় বহন করতে হবে। প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ইহা অতি উচ্চ বিলাসী ইচ্ছা। বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
১৯৩০ ও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দায় বিলাসী ও উচ্চ মূল্যের চাহিদা কমে গিয়েছিল, কিন্তু স্বল্প মূল্যের চাহিদা সব সময় ছিল। কিন্তু এবারে করোনা মন্দায় উচ্চমূল্য, স্বল্পমূল্য, বিলাসী পণ্যের কোন চাহিদা বাজারে নেই।
আবার করোনায় শুধু অর্থনীতি বিপর্যস্ত নয়, মানুষের জীবন-জীবিকা ও সঙ্কটে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার। আয়ের পথ সঙ্কোচিত কিন্তু ব্যয়ের পথ প্রশস্ত। অর্থাৎ টাকার সংস্থান নেই, কিন্তু খরচ করতে হবে। আয়ের পথ বন্ধ হলেও ব্যয়ের সকল সব দরজা খোলা।
আগামী অর্থ বছরে রাজস্ব আদায় কম হলেও অর্থমন্ত্রীকে ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতেই হবে।গতানুগতিক ধারা থেকে বের হতে না পারলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রনে না আসলে অর্থনীতিও সচল হবে না। করোনা আক্রমণ রোধ করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নাই।এডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে ১২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগে ১০ হাজার ৫৪ কোটি টাকা স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। শীর্ষ বরাদ্দের ক্ষেত্রে এবার স্বাস্থ্য খাত ৫ম অবস্থানে উঠে এসেছে।দেশের জন্য অন্তত ১৭ কোটি ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে। তাই বাজেট ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে সরকারকে বেশী মনোযোগ দিতে হবে সামাজিক সুরক্ষায়। করোনা কারণে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে দেশে চার কোটি মানুষ দরিদ্র রয়েছেন।
আরও দেড় কোটি ইতিমধ্যে যোগ হবে। বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট থেকে ৩ ডলার ৮০ সেন্টের মধ্যে আয় করা কর্মজীবী মানুষ ৫৫ শতাংশ। তারা এখন ঝুকির মধ্যে আছেন। তাদের অনেকেই নতুনভাবে গরিব হয়েছে, অনেকেই গরিব হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। এ মানুষগুলোর সামাজিক সুরক্ষা প্রয়োজন।
যে সকল বিষয় বেশী নজর দেয়া ঃ করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজেটে অনেক খাতের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। উল্লিখিত খাতসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
১. তৈরী পোশাক শিল্প, বস্ত্রখাত ঃ প্রস্তাবিত বাজেেট তৈরি পোশাক শিল্পখাত, বস্ত্রখাতের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৈরি পোশাক শিল্প প্রধানতম। এখনও ৭৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা তৈরি পোশাক থেকে আসছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে আজ তৈরি পোশাক শিল্পসহ বস্ত্র খাত একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। নতুন কোন রপ্তানি আদেশ আসছে না। স্থানীয় বস্ত্রখাত পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। ক্রয় বিক্রয় বিগত তিন মাস ধরে সবই বন্ধ হয়ে পড়েছে। এই খাতকে রক্ষা করার জন্য এই খাতের অগ্রিম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা জরুরি। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের গ্যাসের ও বিদ্যুতের মূল্য কোনক্রমেই বৃদ্ধি করা না হয় তা আগামী তিন বছরের জন্য নিশ্চয়তা দিতে হবে। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের সকল ঋণের সুদের হার কমপক্ষে ৫ শতাংশে রাখতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া আগামীতে তৈরি পোশাক শিল্পে রপ্তানি আদেশ পাওয়া কঠিন হবে।
বস্ত্রখাতের রক্ষার জন্য ভারত থেকে সুতা আমদানীর উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। কোনক্রমেই ভারতীয় সূতা অবৈধ পথে বাংলাদেশে আসতে না পারেতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। স্থানীয় সুতা ব্যবহারকারীদেরকে বাজেটে নগদ সহায়তা কমপক্ষে ১০ শতাংশ করা প্রয়োজন। তা হলে স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো তাদের উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারবে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের জন্য বস্ত্র খাতকে নীতি সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
২. জনশক্তি রপ্তানি ঃ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে শ্রমশক্তি রপ্তানী। করোনা পরিস্থিতির কারণে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী বিদেশ থেকে ইতিমধ্যে ফেরত এসেছে। একই দিন পর আর ব্যাপক সংখ্যক কর্মজীবি মানুষ দেশে বসে বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। বৈদেশিক আয়ে বড় রকমের ধস নামবে। বাজেটে এই খাতের উন্নয়নে কিছু প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে।
আগামীতে বিদেশে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে বেশী। অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে। তাই দক্ষ শ্রমিক প্রেরণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় ট্রেনিং ইন্সিটিউট স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে বিগত এক নেক বৈঠকে সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। উক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে দ্রæত টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন দ্রæততার সঙ্গে করা প্রয়োজন। আগামী এক বছরের মধ্যে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য বাজেট বরাদ্দকে কাজে লাগাতে হবে।
৩) স্বাস্থ্য খাত ও করোনা থেকে শিক্ষা : এবার স্বাস্থ্য খাত অর্থ বরাদ্দের দিক থেকে ৬ষ্ঠ স্থানে উঠে এসেছে। এই খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা ।
কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের যে বরাদ্দ তা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের দেশে সব চেয়ে কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাজেটের কমপক্ষে ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাজেটে ২ শতাংশের কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই খাতে এবার বাজেট থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে যত বেশী বরাদ্দ থাকুক না কেন, কিন্তু অর্থকে সঠিকভাবে সঠিক সময়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজে লাগানো প্রস্তাবিত বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত বছরগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্নীতি অনিয়ম হয়েছে তা বিশ্ব রেকর্ড। দুর্নীতিকে না বলতে হবে। আইনের শাসনকে সবার জন্য সমানভাবে কার্যকরী করতে হবে। ক্রয় প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতা এই খাতে আনতে হবে। নতুবা ব্যয় হবে উপকার পাবে না জনগণ।
আমাদের ডাক্তার, টেকনিশিয়ান ও নার্সের অভাব রয়েছে। করোনা আমাদের দুর্বলতাগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেÑকি কাজ, কিভাবে করতে হবে। তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরি স্বাস্থ্য খাতের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। দক্ষ ডাক্তার, টেকনিশিয়ান, নার্স তৈরির জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। কমিনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু ডাক্তার নাই। নার্স নাই। যন্ত্রপাতি নাই। যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার মত টেকনিশিয়ান নাই। বছরের পর বছর ধরে অনেক উপজেলায় হাসপাতাল খালি পড়ে রয়েছে। তাই বর্তমান বাজেটে উক্ত সমস্যা সমাধানের সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নাই। আমাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাতকে পুনগঠন করতে হবে। সর্বস্তরে স্বচ্ছ, সৎ, নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করা দরকরার। স্বাস্থ্য খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। ২০২০ সাল নাগাদ সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে পরিবর্তনও কর্ম পরিকল্পনা আনতে হবে।
৪) কৃষি খাত ও কৃষি পণ্য ঃকৃষি খাত এবার সরকার সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। করোনাকালীন ধান কাটা থেকে শুরু করে কৃষি পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কৃষকের ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা সরকার সব সময় দিয়ে আসছেন। করোনাকালীন কৃষি খাতে ৫ শতাংশ সুদে ইতিমধ্যে সরকার ঋণের ব্যবস্থা করছেন। বর্তমান বাজেটে আরও বেশী সুযোগ সুবিধা কৃষি খাতে দেয়া হয়েছে। করোনা পরবর্তী বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কট হতে পারে, দুর্ভিক্ষ দেশে দেশে হতে পারে। তাই সরকার বেশ সতর্ক। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে তার ব্যবস্থা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বাজেটে বরাদ্দের পর বেশ কিছু নীতি সহযোগিতা প্রয়োজন। সেই সম্পর্কে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে।
ক) ধান, চাল, পেয়াজ, রসুন, আদা প্রভৃতি কৃষি পণ্য সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে ক্রয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে কৃষকগণ পণ্যের প্রকৃত, ভাল মূল্য পায়। এখন মিডিয়ার মাধ্যমে ধান, চাল ক্রয় করার কারণে চাষী ন্যায্য মূল্য থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কৃষক থেকে সরকার সরাসরি ধান, চাল, ক্রয় করার নজির রয়েছে।
খ) কৃষকদের কম মূল্যে প্রয়োজনে বিনা মূল্যে বীজ, সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে কৃষি বিভাগ কর্তৃক তার নিশ্চিত করা যায়।
গ) কৃষকদের ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ করতে হবে। তবে কৃষি জাতীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে কৃষকের পক্ষে সম্ভব হবে। ধান কাটা, রো, কিট নাশক প্রয়োগ ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা গেলে উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে।
ঘ) কৃষি পণ্য দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত গোডাউন, প্রক্রিয়াজাত গোডাউন ব্যবস্থা করা দরকার। দেশে কৃষি ভিত্তিক কৃষি পণ্যের পণ্য উৎপাদনমূলক শিল্প স্থাপনে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে সরকার দেশে একশত রপ্তানি অঞ্চলের মধ্যে কিছু কিছু অঞ্চলে বিদেশীদের জন্য কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত করার শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নিতেহবে। যেমন আম, আনারস, কাঁঠাল, পেয়ারা, লেবু ও নানা জাতের সবজি আমরা দীর্ঘদিন রেখে বাজারজাত করার উদ্যোগ নিতে পারি।
ডেইরী, পোল্ট্রি, মৎস্য শিল্পকে সরকার বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে তাদের বাজার প্রক্রিয়াকে আধুনিক করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সুষম খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে নীতি সহযোগিতা জরুরি। কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা করায় এই খাতের অনেক উন্নয়ন ঘটবে।
৫) ব্যাংক ঋণ ও সরকারের ঋণ গ্রহণ ঃ বর্তমান বাজেটে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রস্তাবনা রেখেছেন ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করবেন ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে সরকার কম সুদে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকসমূহের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ সহায়তা ঘোষণা করেছেন। ইতোমধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা ২ শতাংশ সুদে তৈরি পোশাক ও বস্ত্রখাতের শ্রমিকদের বেতন দেয়া হয়েছে। এই সব ব্যাংকের মাধ্যমে করায় ব্যাংক সমূহের ব্যবস্থাপনায় চাপ পড়েছে। পূর্ব থেকে আমাদের ব্যাংক খাত অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের দারুণ অভাব। এরই মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণ ঋণ নিয়ে বাজেটে ভর্তুকি দিলে বেসরকারি খাতের শিল্প উদ্যোক্তাগণ ঋণ পাবেন না। সরকারের নানা ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক ঋণ নেয়া কমিয়ে না আনলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ঋণ বেশী নিয়ে বাজেটের চাহিদা পূরণ করতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে।
অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, ঋণখেলাপী সৃষ্টির পুরানো চর্চা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। আইনের শাসন কায়েম করতে হবে। ঋণখেলাপী কমিয়ে আনতে হবে।
৬) পুজিবাজার : সরকারের নীতি সহযোগিতা ঃআমাদের দেশে পুঁজিবাজার বড় ধরনের বিপদের মধ্যে রয়েছে। দীর্ঘ বছর ধরে পুজি বাজার দিনে দিনে ধসের দিকে চলে গিয়েছে। বর্তমান বাজেটে পুজিবাজারকে চাঙ্গা করার জন্য নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। এখন আমরা বুঝতে পারছি আরও অনেকদিন আমাদেরকে করোনা নিয়ে চলতে হবে। করোনা সঙ্গী করে আমাদের অর্থনীতি চালাতে হবে। তাই পুজি বাজারকে করোনা আক্রমণের ভয়ভীতি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
সরকার ঘোষিত বাজেটে বেশ কিছু উদ্যোগের কথা পুজিবাজার সমৃদ্ধ করার জন্য ঘোষণা করেছেন। বিশেষ করে সরকারি ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শেয়ার পুজি বাজারে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন,তাতে বাজার সমৃদ্ধ হবে। পুজিবাজার কিছুটা হলেও চাঙ্গা হবে। সর্বস্তরে স্বচ্ছতার ঘোষণা দিয়েছেন। সুশাসনের কথা বাজেট বক্তৃতায় আবারও অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ঘোষণা আবারও মাননীয় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। ব্যাংক ও আর্থিক খাত শেয়ার বাজারে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিনিয়োগ করলে বাজার স্থিতিশীল হবে।
সর্বমোট বাজেটে ১ লক্ষ ১১৭ কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দেশের অর্থনীতিকে উদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ দিকে মুল্য স্থিতি ৫.৪ শতাংশ রাখার টার্গেট খুবই ভাল প্রস্তাবনা। রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এইটিও অতি বেশী টার্গেট। বাস্তাবয়ন বড়ই কঠিন হবে।
৭) শিক্ষা খাত ঃ এমপিওভুক্ত : উপকরণ :বর্তমান প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। করোনা পরিস্থিতি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থার চিত্রের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা খাতের দুর্বলতাগুলো অন্তত প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের গবেষণাখাত কতই যে দুর্বল তা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের প্রাইমারী, হাইস্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা সেই পুরাতন সনাতন পদ্ধতিতে চলেছে। তাই করোনায় যখন স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেলো তখন আমাদের সকল শিক্ষার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলো। আইটি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে এই খাতের উন্নয়ন আনা সম্ভব। এমন কি আমাদের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসমূহেও আইটি উন্নয়ন খুবই কম। শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ।
অন্যদিকে ৬ হাজার এর মত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, এমপিও করার অপেক্ষায় রয়েছে। কিছুদিন পূর্বে সরকার মাত্র ১৬ শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও করেছে। কিন্তু পাঠদান অনুমতি দেয়া সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও করা বাজেটে উল্লেখ নাই। বাজেট পাশের পূর্বে এই ব্যাপারে ঘোষণা সকলে আশা করে।
আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় গ্রামগঞ্জে এমনকি কিছু কিছু জেলা শহরে অবকাঠামোগত সমস্যা অনেক বেশী। ক্লাশরুম, লাইব্রেরী, পায়খানা, খেলার মাঠ, ক্যান্টিন প্রভৃতির অপ্রতুলনায় শিক্ষার্থীগণ বেশ সমস্যায় পড়ে রয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজেটে এই ক্ষেত্রে আলাদা বরাদ্দ উল্লেখ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে রিপেয়ার খাতে বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
শুধুমাত্র ডিগ্রি প্রধান ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় না তৈরি করে, জ্ঞান ভিত্তিক হাতে কলমে শিক্ষা বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। এই জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য ভোকেশনাল, পলিটেকনিক্যাল তথা কারিগরি শিক্ষামূলক প্রতিটি উপজেলায় একটি করে প্রতিষ্ঠান তৈরি জন্য পরিকল্পনাকে দ্রæত কার্যকরী করতে হবে। এই বরাদ্দ বিগত বাজেটেও ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া খুবই ধীরগতি।
৮) করোনা মোকাবেলায় ফান্ড ঃআমরা আশা করছিলাম ২০২০-২০২১ সালের বাজেটে একটি নতুনত্ব থাকবে। কিন্তু তেমন তা দেখা গেল না। সাধারণ গতানুগতিক বাজেট হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে করোনা নিয়ে তেমন কোন চমক নেই। আমাদের দেশে যে কোন দুর্যোগ ও প্রয়োজনে জনগণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করা হয়। নিজের বা প্রতিষ্ঠানের প্রচারের জন্য সকলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলে নানা প্রচারে ব্যস্ত হন। প্রধানমন্ত্রী এই তহবিল থেকে নিজস্ব ইচ্ছায় ব্যয় করেন। কিন্তু বর্তমান করোনা দীর্ঘ মেয়াদী হচ্ছে। এই জন্য তার মোকাবেলায় একটি ‘বিশেষ ফান্ড’ দেশি বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দানকৃত অর্থে গঠিত হতে পারে। দাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরবর্তী বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে। যে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ অর্থ উক্ত ফান্ডে অনুদান দেবেন উক্ত অর্থকে করমুক্ত ঘোষণা করা হবে অর্থাৎ কর সুবিধা পাবেন। এবং ফান্ডে দাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ সম্পর্কে কোন উৎস জানানোর প্রয়োজন হবে না। আশা করা যায় প্রস্তাবিত বাজেট পাশের পূর্বে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এই ঘোষণা দিয়ে বিশাল একটি ফান্ড গঠনের যাত্রা শুরু করবেন। এই ফান্ড থেকে স্বাস্থ্য খাতে, গবেষণা খাতে ও শিক্ষা খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। এই তহবিলের হিসাব স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতি বছর অডিট পর দেশবাসীর নিকট পেশ করা হবে।
৯) সুশাসন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ঃদেশে করোনাকালীন দুর্যোগে ত্রাণের চাল, ডাল, তেল পর্যন্ত লুটপাটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কিছু সদস্য অভিযুক্ত হন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে বিদেশে পাচার হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিচার চলেছে। শেয়ার বাজারে অর্থ আত্মসাতের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। তদন্ত চলেছে। কিছু টাকা উদ্ধার হয়েছে। আমেরিকাতে মামলার চেষ্টা চলছে। সবই চলমান কার্যক্রম।
বাজেট বক্তৃতায়মাননীয় অর্থমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। স্বাস্থ্য খাত, সড়ক পরিবহন খাত, রেলখাতসহ সকল খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের বিচারের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বাজেট বাস্তবায়ন আমাদের নিকট সব সময় কঠিন কাজ। উন্নয়ন বাজেট সব সময় অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। পুরো অর্থ খরচ সময় মত করা যায় না। যার কারণ আমাদের সক্ষমতা কম। সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যোগ্য, দক্ষ, সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বড়ই অভাব। সততা নিয়ে কাজ করার সরকারি কর্মকর্তা কম। এদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য স্থানে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য বাজেট বক্তৃতায়মন্ত্রীর এই ক্ষেত্রে কড়া বক্তব্য আমরা আশা করেছিলাম। বাজেট পরবর্তী এ ক্ষেত্রে সুশাসন সবার জন্য সমান আইনের শাসন নিশ্চিতের উদ্যোগ সরকার নেবেন জাতি তা আশা করে।
১০) বন্দর সুবিধা ঃ অবকাঠামো উন্নয়ন ঃদীর্ঘদিন ধরে সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এবার উন্নয়ন বাজেট কমে গিয়েছে। উন্নয়ন বাজেট রাখা হয়েছে মাত্র ২ লক্ষ ৯ হাজার কোটি টাকা। মেগা প্রকল্প সমূহের ব্যয়ও বেশ কিছু কমিয়ে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বমোট ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে।
রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বন্দর উন্নয়ন ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নাই। দেশের অর্থনীতি সিঙ্গাপুরের মত উন্নত করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই দ্রæত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে হবে। করোনা পরবর্তী হয়তো এই সকল মেগা প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলবে। তবে একেবারে বন্ধ রাখা কোনক্রমেই ঠিক হবে না।
আগামীতে নতুন শিল্প স্থাপনের গতি কমে আসবে। তবে স্থাপিত শিল্পসমূহের উৎপাদন করোনা পূর্ব অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সব ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। তাই সরকার বিদ্যুত, গ্যাস ও জ্বালানি উৎপাদনে পূর্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রেখেছেন। আগামী ডিসেম্বর ২০ সাল নাগাদ প্রতি গ্রামে বিদ্যুত পৌছে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। ২০৪১ সালের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আলোকে সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে এগিয়ে যাবেন বলে সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন।
মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেট উপস্থাপনা ডিজিটাল পদ্ধতি খুবই আধুনিক, চমৎকার ও সংক্ষিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ পাকের সাহায্য কামনা, কোরআন পাকের বিভিন্ন আয়াতের পাঠ বাজেট বক্তৃতাকে অতিব প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।