ভিক্ষাবৃত্তি দেশজ ও সামাজিক লজ্জা। লজ্জাজনক ও বর্জনীয় কোন কিছু যখন সবার গা সওয়া হয়ে যায় তখন সেটা যা হওয়ার তাই হয়েছে এই ভিক্ষাবৃত্তি। আজ এটি বড় এক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে প্রচুর ভিক্ষুকের দেখা মিলে। দেশের অন্যান্য প্রধান শহরগুলোতেও ইদানিং ভিক্ষুকদের মিছিল ক্রমেই বড় হচ্ছে। রাস্তার মোড়ে, ট্রাফিক জ্যামের মাঝে, মসজিদগুলোর সামনে ভিক্ষুকদের ভিড় খুব বেশি চোখে পড়ে। কেউ কেউ হয়তো একান্ত অনোন্যপায় হয়ে ভিক্ষা করে। কিন্তু অধিকাংশই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে ভিক্ষাবৃত্তিকে। অথচ আমাদের দেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ধর্মের মানুষ থাকলেও অধিকাংশ ভিক্ষুক মুসলিম নামধারী। ধর্মীয় পোষাকে বা বিভিন্ন মায়াভরা বুলি ব্যবহার করে ভিক্ষা পেশাকে জমিয়ে তুলেছে। অথচ ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ঘৃন্য কাজ। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপারে কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যারা সবসময় মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়, কেয়ামতের দিন সে এমনভাবে উপস্থিত হবে যে, তার চেহারায় কোন গোশত থাকবে না’ (বুখারী: ১৪৭৪)।
অন্য এক রেওয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে অভাবের তাড়না ছাড়াই সম্পদ বৃদ্ধির জন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করে বেড়ায়, মূলত: সে আগুনের ফুলকি ভিক্ষা করছে। তাই তার ভেবে দেখা উচিত সে বেশি নেবে না কম নেবে’ (মুসলিম: ২২৮৯)।
প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যে নিজের অভাব অনটনের কথা দশজনের কাছে বলে ভিক্ষা করে, মূলত তার অভাব কখনো দূর হয় না, বরং আরো বৃদ্ধি পায়। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই মানুষের অভাব অনটন দূর করতে পারেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেন, ‘অভাব অনটনের কথা যে আল্লাহ্ তাআলার কাছে পেশ করে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন অবশ্যই তার অভাব অনটন দূর করে দেবেন, দ্রুত না হয় বিলম্বে’ (তিরমিযী: ২৩২৬)।
এ দায় কেউ এড়াতে পারবে না :
ভিক্ষা যে এক ধরনের পেশা হতে পারে এ দেশের সমাজ ব্যবস্থা এটার বড় নজির তৈরি করেছে। বাংলাদেশে ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে একদল অমানুষ, অসাধু বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এরা দিনের পর দিন এ ঘৃণ্য বাণিজ্য করে যাচ্ছে। সামাজিক প্রতিপত্তি বা স্থানীয় প্রভাবের জোরে তারা এই হীন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তারা শারিরীক প্রতিবন্ধী ও শিশুদেরকে হাতিয়ার হিসেবে ভিক্ষার কাজে ব্যবহার করে কোটি কোটি অর্থ উর্পাজন করছে। এসব আর এখন নতুন কোন সংবাদ নয়। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনে একাধিকবার প্রচারিত হয়েছে। এরা সুস্থ মানুষকে কৃত্রিমভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী বানিয়ে অর্থ উপার্জনের একটি ঘৃণ্য উপায় চর্চা করে যাচ্ছে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতিদিন ভিক্ষুকদের আয় ২০ কোটি টাকা। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে মোট ভিক্ষুক সংখ্যা সাড়ে ৪ লক্ষের অধিক। শুধু ঢাকা শহরে ভিক্ষুক সংখ্যা ৬০ হাজার। অবাক কান্ড হচ্ছে গ্রামে তুলনামুলক ভিক্ষুকের দেখা অতোটা মেলে না। গ্রামে সামাজিক ও পারিবারিক পরিচয় সহজে প্রকাশ হয়ে যায় বলে পেশাদার ভিক্ষুকরা গ্রামে সুবিধা করতে না পারায় শহরে এসে ভিড় করছে।
ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার উদ্যোগ:
ভিক্ষুকদের ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার জন্য ২০০৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক সংগ্রামী (ভিক্ষুক) সদস্য ঋন কার্যক্রম চালু করে। বিনা সুদে এই ঋণ দেয়া হয়। উদ্দেশ্য হল ভিক্ষার পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা করে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে। কিস্তিও প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী ঠিক করা হয়। কোন ধরনের বাধ্যবাধকতা ছিল না। ঋণ প্রাপ্ত ভিক্ষুক কোনরকম সাবলম্বী হলে ভিক্ষা পেশা ছেড়ে দেবে এই সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হয়। গ্রামীণ ব্যাংক ৮৩ হাজার ৩৬৩ জন ভিক্ষুককে এই কর্মসূচির অর্ন্তভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এসব ভিক্ষুকদেরকে বিতরণকৃত অর্থের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। ভিক্ষুক সদস্যগণ এ পর্যন্ত ১৬ দশমিক ০৫ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৪১ হাজার ৩৮৩ জন ভিক্ষুক ভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করেছে। এটি খুবই মহৎ উদ্যোগ ছিল। সব মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে গ্রামীন ব্যাংক। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্যে ছিল গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলাগুলোকে ভিক্ষুক মুক্ত করা।
কিছুদিন পূর্বে গ্রামীণ ব্যাংকের জোনাল ম্যানেজার ক্ষুদিরামপাল বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ভিক্ষুক সমস্যা সমাধান করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু বর্তমানে আগ্রহী ভিক্ষুক পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে ভিক্ষুক কোথায় গেল? গ্রামাঞ্চলে ভিক্ষুক না পাওয়াতে সংগ্রামী সদস্য কর্মসূচী বাস্তবায়ন সমস্যা হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংক ভিক্ষুকদেরকে নানা সহযোগিতা করে। শীতে শীতবস্ত্র দেয়। কোভিড-১৯ এর সময় তাদেরকে খাদ্য সহযোগিতা করা হয়। বিশেষ করে এই সকল ভিক্ষুকদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য নিবিড় প্রচেষ্ট অব্যাহত রেখেছে। এতে অনেক ভিক্ষুক ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছে। বলা যায় গ্রামীণ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। এই উদ্যোগকে বেগবান করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সরকারের উদ্যোগ :
প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করছে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। মাথাপিছু আয় আমাদের এখন ২ হাজার ৫০০ ডলারের বেশি। কাজেইএখন ভিক্ষাবৃত্তির মত লজ্জাজনক ও ঘৃণ্য কাজ থেকে আমাদেরকে মুক্ত করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং ভিক্ষাবৃত্তির মতো লজ্জাজনক কাজ থেকে ভিক্ষুকদেরকে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে ভিক্ষুকদের পুনবার্সন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় “ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠির পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান” শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এটি খুবই ভাল উদ্যোগ। বিগত আগস্ট ২০১০ থেকে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছরে কর্মসূচী অনুযায়ী কার্যক্রম কাংখিত মাত্রায় গতিশীল হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূলের ব্যাপারে বেশ আন্তরিক। কিন্তু আমলাগণের দক্ষতা ও স্বতস্ফূর্ততার অভাবে কার্যক্রমটি আশানুরূপ গতি পাচ্ছিল না। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে প্রথমবারের মতো দেশের ৫৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য অর্থ প্রেরণ করে।
২০২০-২১ অর্থ বছরে ঢাকা শহরকে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা ঘোষণা করে ১৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। কোর্টের মাধ্যমে ১৮০ জন ভিক্ষুককে আটক করে। আটকৃত ভিক্ষুক থেকে ৭২ জনকে সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ প্রদান ও পুর্নবাসন করে। বাকি ১০৮ জনকেও পুনবার্সন করা হয়। সরকার দীর্ঘ মেয়াদে ভিক্ষুক নির্মূল ও পুনর্বাসনের কাজটি নিরবচ্ছিন্নভাবে করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এটি সত্যিই বেশ ভাল উদ্যোগ।
কেন ভিক্ষুক সমস্যার সমাধান প্রয়োজন:
দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উন্নয়নের সুফল চারদিকে আলোড়ন তুলছে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রপ্তানি বাড়ছে। দিন দিন বিত্তশালী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ১০ লক্ষ বা এর চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়ে আমরা সারা দুনিয়ায় নজির স্থাপন করেছি। বিশ্বব্যপী আমরা মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। আমাদের যেখানে এতো অর্জন সেখানে সামান্য কয়েক লক্ষ ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করে দেশকে ভিক্ষুকের কলঙ্ক ও লজ্জা থেকে মুক্ত করতে পারবো না? ইনশাআল্লাহ্ পারবো। ইতিমধ্যে সরকার গ্রামাঞ্চলের ভূমিহীনদের আশ্রয় কেন্দ্র তথা বাড়ী তৈরি করে দিয়ে মানবতার অনন্য নজির স্থাপন করেছে। এ হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার বিষয়টি অনেক সহজ ব্যাপার।
বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির স্বার্থে দেশ থেকে ভিক্ষাবৃত্তির মতো ঘৃণ্য প্রবণতা দেশ থেকে সমূলে দূর করা ভীষণ প্রয়োজন। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরকে এই বিষয়ে আরও বেশি কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতেহবে। রাস্তায় রাস্তায়, মসজিদের সমানে অগণিত ভিক্ষুকের সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না আমরা উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য ধারায় আছি। মনে হচ্ছে আমরা দিনদিন গরিব হচ্ছি। এই হতচিহ্ন আমাদের মুছে ফেলতে হবে। আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা দিয়ে কোরআন ও হাদীসের নির্দেশ মেনে সকলকে ভিক্ষাবৃত্তির অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
যাকাত ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধে উত্তম উপায়:
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা নামাযের প্রসঙ্গ যেসব জায়গায় উল্লেখ করেছেন এর প্রায় বেশিরভাগ জায়গাতেই যাকাতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। যাকাত আদায় না করলে ভয়ংকর শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘যরা স্বর্ণ ও রূপা (স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রদা) জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদেরকে কঠোর আযাবের সুসংবাদ দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে সেগুলো (সোনা, রূপা ও অর্থ কড়ি) উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপাল, পাশ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে, (আর বলা হবে,) এগুলো তা যা তোমরা নিজেরদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। এখন তোমরা এর স্বাদ গ্রহণ কর যা তোমরা জমা করে রাখতে তার (সূরা তাওবা: ৩৪, ৩৫)। তিনি বলেছেন বিত্তশালীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে। ইরশাদ করেছেন, ‘যাদের সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের জন্য নির্ধারিত হক রয়েছে (সূরা মা‘রিজ: ২৪, ২৫)।
সূরা বাক্বারার ১১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে,
‘তোমরাসালাত কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর। তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু পূর্বে প্রেরণ করবে আল্লাহর নিকট তা পাবে। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তার দ্রষ্টা।’
অন্য এক সূরায় মহান আল্লাহ যাকাত প্রদানকে রহম বা রহমত বলেছে। তিনি বলেছেন, ‘মুমিনপুরুষ ও মুমিন মহিলাএকে-অপরেরবন্ধু। তারা সৎ কাজের আদেশ দেয়, অসৎ কাজ নিষেধ করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রসুলের আনুগত্য করে। এদের উপর আল্লাহ রহম করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (সূরা তওবা: ৭১)।
পবিত্র কোরআনে সূরা তওবায় যাকাত প্রদানের খাতসমূহ উল্লেখ করে একে বিধান বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং যাকাত প্রদানের আটটি খাতের কথা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন,
‘সাদাকা তো কেবল ফকীর ও মিসকীনদে রজন্য এবং সাদাকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত লোকদেরজন্য, যাদের চিত্তাবর্ষণকরা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণ গ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে যারা রয়েছে তাদের জন্য ও মুসাফিদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বত্ত, প্রজ্ঞাময়। (সূরাতাওবা: ৬০)
কাজেই যাকাত আদায় করা সামষ্টিক কাজ। মুসলমানদের জন্য অবশ্যই পালনীয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই যাকাত আদায় করে উল্লিখিত খাতসমূহে সুষ্ঠভাবে বন্টন করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না।
আমরা ইতিহাসে দেখতে পাচ্ছি যখন যাকাত রাষ্টীয়ভাবে আদায় করা হতো তখন মুসলিম রাষ্ট্রে ভিক্ষুক তো দূরের কথা যাকাত গ্রহণ করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজের (রহ.) সময় রাষ্ট্রে যাকাত দেয়ার মত লোক খোজে পাওয়া যায়নি। আজ আমাদের দেশে যাদের ওপর যাকাত ফরয তাদের সবাই কিন্তু যাকাত আদায় করছেন না। কিন্তু যাকাত গ্রহীতার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় থাকলে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন নির্দেশনা থাকলে যাকাত আদায়কারীর সংখ্যা বাড়তো। রাষ্টীয়ভাবে আদায় হচ্ছে না বলে যাকাতের অর্থ সুষ্ঠভাবে ও পরিকল্পনা মাফিক বন্টিত হচ্ছে না। সরকার ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক যাকাত সংগ্রহের অবস্থা করছে। তা সীমিত আকারে। তেমন কোন প্রচার-প্রসারও ইেন। দেশে যাকাত আদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামূলক নয়। যদি আমাদের দেশে সরকার যাকাত আদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে করেন এবং আইন করে বাধ্য করেন, তবে তা দিয়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠির সংখ্যা ক্রমেই কমে আসবে। দেশে কোন ভিক্ষুকের এতো ভিড় থাকবে না। দরিদ্র, অভাবী মানুষ থাকবে না। দেশ সুন্দর হবে। পরিবেশ সুন্দর হবে। মানুষের জীবনের চলার পথ মার্জিতহবে। মানুষ সুখে জীবন কাটাতে পারবে। অন্যদিকে আল্লাহর নির্দেশ পালনের কারণে পরকালে আমরা সকলে নাজাতপাবো। কঠিনশাস্তি থেকে মহান আল্লাহ আমাদের মুক্তি দেবেন।
ভিক্ষাবৃত্তির মত অপমানজনক পেশা থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যাকাত আদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ নেই।
মহানবী (সাঃ) এর উদ্যোগ :
যাকাত আদায় সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ নবীকরীম (সাঃ) বিধান আকারে জারি করেছেন এবং যাকাত বন্টনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে থেকে জানাযায় যে, জিসান ইবন সালাবা (রাঃ) নবীকরীম (সাঃ) কে বললেন, আপনার প্রতিনিধি বলেছেন যে, আমাদের সম্পদের যাকাত দিতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, সে সত্য বলেছে। তখন ঐ ব্যক্তি বললেন, যে আল্লাহ আপনাকে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন তার শপথ দিয়ে বলছি, আল্লাহ কি আপনাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন? নবীকরীম (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ।
বুখারী ও মুসলিমশরীফে উদ্ধৃত অন্য এক হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘হযরত মুআয ইবন জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামানে পাঠানোর সময় নবীকরীম (সাঃ) তাঁকে বললেন, তুমি আহলে কিতাবদের এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছো। তুমি তাদের‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহুমু হাম্মাদুর রাসুলুলুল্লাহ’ এ সাক্ষ্য দানের জন্য দাওয়াত দিবে। তারা যদি তা মেনে নেয় তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ তাদের উপর দিনরাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি তারা তা মেনে নেয় তাহলে তাদের জানাবে আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। তারা এ কথা মেনে নিলে তাদের ধন-মালের উত্তম অংশ গ্রহণ করা থেকে তুমি সতর্ককতা অবলম্বন করবে। আর মাখলুকের ফরিয়াদকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা তারও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই (হাদীস নং ১৩৯৫)।
সবশেষে :
আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যাকাত রাষ্ট্রীয় আদায় করা ও ব্যয়-বন্টন করা আমাদের জন্য ফরজ কর্ম। কিন্তু আমরা তা করছি না। এই করণীয় না করে আমরা অন্যায় করছি। পাপ করছি। এই জন্য পরকালে অবশ্যই এর জন্য কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। পরম ক্ষমাশীল আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। তাই যাকাত আদায় ও বন্টনের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধের জন্য সরকারী সকল উদ্যোগ আরো বেগবান করার কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে কোন ভিক্ষুক নেই। ভিক্ষা দেয়ার মতও কোন লোক পাওয়া যায় না। আমাদের মত অনুন্নত দেশে গরীব, অভাবী লোকের সংখ্যা বেশী। অন্যদিকে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিক্ষুক বেশী দেখাযায়। অথচ মুসরিমদের মধ্যে কোন ভিক্ষুক থাকার কথা নয়। কেন আমরা ভিক্ষা করছি। কিছু অসৎ ব্যক্তি এটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে ব্যবসা করছে। তা সরকারকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে যাকাত আদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্য করে আইন করলে ভিক্ষুকদের সামাজিক লজ্জা থেকে দেশ মুক্ত হতে পারবে। এমন একদিন আসবে যাকাত নেয়ার বা যাকাত গ্রহণ করার কোন মানুষ দেশে পাওয়া যাবে না। ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূলের এই হচ্ছে সহজ ও সমাধানের পথে আমরা এগিয়ে আসি।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।