১৯৫০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ শহরে বাস করলেও বর্তমানে এ হার ৫৫ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে তা ৬৬ শতাংশে গিয়ে পৌঁছবে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান শহর গুলোর ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও অতিরিক্ত মানুষের চাপে তা বাসযোগ্য রাখা কোনক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। এ বাস্তবতায় নতুন নতুন শহর গড়ে তোলার কার্যক্রম সময়ের দাবী বললে অত্যুক্তি হবে না। এ প্রেক্ষাপটে আমার গ্রাম, আমার শহর কার্যক্রমকে একটি ব্যতিক্রম ধর্মী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে আমরা মনে করতে পারি।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ২০১৮ সালের অন্যতম প্রতিস্রুতি হচ্ছে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর অর্থাৎ গ্রামে শহরের সকল সুযোগ সুবিধা- পৌঁছানো হবে। এই প্রতিস্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রসংশনীয় ও বাস্তবধর্মী। এই উদ্যোগের আলোকে তৈরি করা হবে ৩০টি গাইড লাইন, ৫১টি সমীক্ষা প্রতিবেদন ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিবিপি)। এছাড়া দেশের ৮৭ হাজার ২৩০টি গ্রাম উন্নয়নের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক ও তৈরি করা হবে। নির্বাচনী এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ‘কারিগরী সহায়তা’ নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩১ কোটি ৬ টাকা। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক তা অনুমোদিত হয়েছে বিগত ২রা নভেম্বর ’২০ অনুমোদনের পর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কাজ বাস্তবায়ন করবে।
সরকারের পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। আগামীতে তৈরি হতে যাওয়া অষ্টম পঞ্চ বার্ষিকী পরিচালনায় এ বিষয়ের প্রতিফলন দেখা যাবে। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের বিষয় হওয়োর কারণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বিষয়টি কার্য তালিকায় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।
কারিগরি সহায়তা সংক্রান্ত এই প্রকল্পের আওতায় ৩০টি গাইড লাইন তৈরি করা হবে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মপরিধি সংক্রান্ত ৭টি বিষয় থাকবে। যেমন: গ্রামীন যোগাযোগ, গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার বা হাটবাজার, গ্রামীন পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিউনিটি স্পেস ও বিনোদন, উপজলো মাষ্টার প্লান, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও অন্য বিষয় সমূহ। এ ছাড়া আরও ৩৬টি সমীক্ষা পরিকল্পনা করা হবে। সেই সঙ্গে ১৫টি পাইলট গ্রামের আলাদা সমীক্ষা করা হবে।
এ সবরে মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জগুলো এবং উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন করা হবে। এছাড়া দেশের ৮টি বিভাগের সমতলের ৮টি গ্রাম এবং ডেলটা প্ল্যানের হট স্পট ও অর্থনৈতিক অঞ্চল সংলগ্ন ১৫টি গ্রামে পাইলট গ্রাম নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রকল্প তৈরি করা হবে। ভিশন ২০৪১ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য পল্লী অঞ্চলে অধিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঞ্চার করা হবে। কর্মসংস্থান তৈরির জন্য দেশের ৮৭ হাজার ২৩০টি গ্রাম উন্নয়নের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক ও তৈরি করা হবে।
প্রকল্প প্রস্তাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আধুনিক ব্যবস্থাপনায় গ্রামাঞ্চলের জনগণের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য গ্রামগুলোর শহরের আদলে রূপান্তর করা বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার। আমার গ্রাম আমার শহর’ নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রস্তুতির জন্য প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরী করা হয়েছে। যেটি প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পটি হাতে নেয়া হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পরামর্শক সেবা খাতে ২২ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিপিপিতে পরামর্শকের প্রয়োজনীয়, ক্যাটাগরি অনুযায়ী নাম, সংখ্যা, জন, মাস, কার্যপরিধি উল্লেখ করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পের বৈিেশক প্রশিক্ষণ খাতে ২ কোটি টাকার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং স্থানীয় সম্পদের সীমাবন্ধতার কারণে এ ব্যয় বাদ দেয়া উচিত। স্থানীয় প্রশিক্ষণ খাতে ৫০ লক্ষ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় ও যুক্তিযুক্তভাবে হ্রাস করা প্রয়োজন রয়েছে। ষ্টেশনারী খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকার। প্রকল্প প্রাইস কন্টিসজেন্সি খাতে খরচ ধরা হয়েছে দেড় কোটি টাকা। প্রকল্পটি চলতি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বরাদ্দহীনভাবে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই। তবে এটি প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি জরুরি বিধায় এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের জন্য উদ্যোগটি খুবই সময় উপযোগী, জরুরি। সরকার ঠিক সময়ে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছেন। সরকারকে এই জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়। ভাল ত্ত প্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়ার জন্য বর্তমান সরকার সকল মহলের প্রশংসা পাবেন। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এখন জরুরি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
১. ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় ভিত্তিক টেকনিকেল কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। উক্ত কমিটি সকল দিক আলোচনা করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে, দেশের চাহিদা অনুযায়ী, দীর্ঘ মেয়াদী, পরিকল্পনার সুপারিশ করবে। তাতে ভুলভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে আমরা বাঁচতে পারবো। প্রয়োজনে বিদেশী সহযোগিতা ও নেয়া যেতে পারে। অভিজ্ঞতা বিনিময় করাÑ খুব ভাল হবে। পৃথিবীর সকল উন্নত দেশ আজ শহর গ্রামের কোন পার্থক্য নাই। তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
২. বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারের বড় ছোট সকল উন্নয়নমূলক প্রকল্পে নানা অনিয়ম ঘটে চলেছে। কিছু কিছু ধরা পড়েছে। বিচার ও চলেছে। কিন্তু অনিয়ম, দুনীর্তি বন্ধ হয় নাই। তবে হ্রাস পাওয়া উচিত। ভাল ভাল অর্জনকে এই সকল অনিয়ম, দুনীর্তি অনেক সময় ¤øান করে দেয়। তাই এই প্রকল্পে শুরু থেকে সকল স্তরের নেতাদের এই সকল অনিয়ম, দুর্নীতি যাতে না ঘটে সেই ব্যাপাপরে সতর্ক থাকতে হবে। এই জন্য এই প্রকল্পের নিয়োজিত সকল কর্মকর্তার অতীব কার্যকলাপ দেখে নিয়োগ দেয়া উচিত। আর কোন রকমের দুনীর্তি যাতে না ঘটতে পারে, তার জন্য একটি ‘দুনীর্তি প্রতিরোধ সেল’ গঠন করে শুরু থেকে কাজকর্মকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যখনি কোথাও কোন অনিয়ম পাওয়া যাবে, তাতে সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. সকল প্রকার টেন্ডার ও ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এই জন্য কর্তা ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত শপথ নেয়া উচিত। এই প্রকল্পে নিয়োজিত সকল কমকর্তার ‘আয়কর হিসাব’ সরকারকে গ্রহণ করে প্রতি বছর মূল্যায়নের ভিত্তিতে তার চাকুরীর পদোন্নতি নিশ্চিত করার নতুন নিয়ম চালু করা প্রয়োজন। তা হলে সকলে সৎ, নিষ্ঠাবান ও সততার সঙ্গে কাজে মনোযোগ দেবে।
৪. আমাদের দেশে করোনার করণে বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে এসেছে। করোনার পূর্বে দেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে ছিল। দরিদ্র মানুষের জন্য ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্প অত্যন্ত মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয়। যখন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে তখন ঐ সকল গ্রামে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান বেড়ে যাবে। দারিদ্র্যতা হ্রাস পাবে। মানুষ কর্মমুখী ও উপার্জনক্ষম হবে। তাতে দেশে দারিদ্র্যতা স্বাভাবিকভাবে কমে আসবে। তাই প্রকল্পটি স্বচ্ছ, দুনীর্তিমুক্ত, অনিয়মমুক্ত হতে হবে। মানুষের কল্যাণে সকলকে কাজ করতে হবে। আত্মকেন্দ্রিক, আত্মচেতনা বাদ দিয়ে মানবিক হতে হবে। মানুষের জন্য মানুষ এ মনোভাব সকলের মধ্যে আসতে হবে, আনতে হবে। তখন স্বাধীনতা পঞ্চাশপুর্তির স্বার্থকতা আসবে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।