ধনী দরিদ্রের ব্যবধান পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে মানুষের মধ্যে রয়েছে। সব সময় সব দেশের সরকার ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমিয়ে দারিদ্র্যের হার কমাতে চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের সরকারও বিগত ১২ বছর ধরে দারিদ্র্যের হার কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধি হারের দিক দিয়ে গত দশ বছরে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে বাংলাদেশ। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১০ বছরে ধনকুবের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ এদের সম্পদের পরিমান ৫০ লক্ষ ডলারের অধিক।
বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স সম্প্রতি গত এক দশকে বিশ্বের ধনী জনগোষ্ঠীর সম্পদ পর্যালোচনা ও সামনের ১০ বছরের সম্পদ বন্টন কেমন হবে, তার ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। আডিকেড অব ওয়েলথ’ শীর্ষক গবেষণায় নানা তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে- এমন দেশগুলোর মধ্যে ছোট বড় অর্থনীতির মিশ্রণ রয়েছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশী দেশ রয়েছে এশিয়ায়। প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ৬টি এশিয়ার। এই তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। উভয় দেশেই তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও আঞ্চলিক উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক প্রসার ঘটেছে।
বাংলাদেশের পরেই রয়েছে ভিয়েতনাম। দেশটিতে ৫০ লক্ষ ডলারের বেশী সম্পদের অধিকারী ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে গত ১০ বছরে গড়ে ১৩ শতাংশ কেনিয়ার ১৩ দশমিক ১ শতাংশ, ফিলিপাইনের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, নিউজিল্যান্ডের ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, পাকিস্তানের সাড়ে ৭ শতাংশ এবং আয়ারল্যান্ডের ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে। ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি খুবই ইতিবাচক দিক। একটি দেশে বৈধভাবে যদি ধনীর সংখ্যা বাড়ে এবং তারা যদি ঠিকভাবে কর দেয় তা হলে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেই হোক, বিনিয়োগ করেন। অর্থাৎ অর্থ যদি থেকেই থাকে, তবে তা খুবই ইতিবাচক। কারণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ছে বলেই মানুষ ধনী হচ্ছে।
তবে আমাদের দেশে এক্ষেত্রে যে সমস্যাটি লক্ষনীয় ধনীর আয় যেভাবে বেড়েছে। দরিদ্রের আয় সেইভাবে বাড়ছে না। তবে আয় ব্যবধান তৈরী হচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের জরিপ আয় বৈষম্য বেড়েছে। দরিদ্রের আয় ধনীর মত পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ দরিদ্র এবং প্রায় ২ কোটি মানুষ অতি দরিদ্র। তাই সরকারকে বিলিবন্টন করতে হবে। ধনীরা ঠিকমত কর দিলে এবং সেই অর্থ জনগণের মধ্যে বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরী করতে হবে। আয় বৈষম্য অধিক থাকলে কোনো দেশ ভারসামপ্যপূর্ণ উন্নয়নের দেশ হতে পারে না।
ওয়েলথ এক্সের গবেষণায় বলা হয়েছে, গত দশকটি ছিল ধনীদের দশক। ২০১০ সাল থেকে বিশ্বে ধনী ব্যক্তি ও তাদের সম্পদের পরিমাণ দুটাই বেড়েছে হু হু করে। শতাংশের দিক থেকে ৫০ শতাংশের বেশী। একটি অব্যাহত উচ্চমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে প্রায় আড়াই কোটিতে পৌঁছেছে। ২০০৫ সালে বিশ্বের মোট ধনীর ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল এশিয়াতে। ২০১৯ সালে এসে তা ২৭ শতাংশে পৌঁছেছে। সামগ্রিকভাবে সম্পদের এই বৃদ্ধির চালিত হয়েছে মূলত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা, পুঁজিবাজারের মান, বিশ্ববাজার এবং প্রতিটি দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে সম্পদের বিতরণ।
ওয়েলথ এক্সের এই গবেষণা দেখা গেছে এশিয়ায় ৫০ লক্ষ ডলারের বেশী সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা তিন গুণ হয়েছে। এক দশকে ১০ শতাংশ বেড়ে ২৭ শতাংশ হয়েছে। যদি আঞ্চলিক ভিত্তিক সম্পদশালীর সংখ্যা উত্তর আমেরিকা আজও আধিপত্য বজায় রাখছে, ৩৯ শতাংশ। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে খুবই শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছে এই অঞ্চল। অন্যদিকে ইউরোপ, ঐতিহ্যগতভাবে সম্পদশালী এই অঞ্চলের অবস্থানে বেশ স্থিতি পতন লক্ষ্য করা গেছে। ২০১০ সালে বিশ্বের মোট সম্পদশালীর ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল ইউরোপের। ২০১০ সালে এসে যা হয়েছে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের ধীরগতি, বয়স্ক জনগোষ্ঠী ও অপেক্ষাকতৃ সংযত আর্থিক বাজার। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চলে ধনী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বরাবরই কম। এই সম্পদশালী জনগোষ্ঠীকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে ওয়েলথ এক্স।
১. ১০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ ডলার সম্পদ অধিকারী ২. ৫০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি ডলার অধিকারী বা ভেরী হাই নেট অর্থ ৩. ৩ কোটি ডলারের ওপর সম্পদশালী বা আলট্রা হাই নেট অর্থ। ওয়েলথ এক্স বলেছে, ২০১৯ সালে এসে ধনী ব্যক্তিরা বিশ্বব্যাপী, ব্যক্তিগত সম্পদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বা প্রায় ১০৪ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০০৫ সালে যা ৫০ ট্রিলিয়ন ডলার ছিল। কোন অঞ্চলে সম্পদশালী বৈরী, তা ও তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এতে দেখা গিয়েছে, গত এক দশক এবং তারও বেশী সময় ধরে চীনে সম্পদশালীর সংখ্যা বিস্ময়কর রকমের বেড়েছে। ধনীর সংখ্যা বেশী এমন ৩০টি অঞ্চলের মধ্যে ৪টি বাদে বাকী ২৬ টিই চীনের। ৪টি যুক্তরাষ্ট্রের। তবে ওয়েলথ এক্সের হিসেবে বিশ্বে সব চেয়ে ৫০ লক্ষ ডলারের মালিক এমন ধনী সব চেয়ে বেশী রয়েছে নিউইয়র্কে, ১ লক্ষ ৬০৫ জন। এর পরেই টোকিওতে, ৮১ হাজার ৬৬৫জন। এরপরই আছে হংকং, ৭৩ হাজার ৪৩০ জন।
ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কিভাবে কমবেঃ
কিভাবে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমানো যাবে এই নিয়ে সরকার বড় চিন্তা করছেন। কিন্তু বিগত ১২ বছর ধরে ঘটনা ঘটেছে উলটো। ধনীদের সম্পদ বেড়ে চলেছে। উক্ত প্রতিবেদন আমাদেরকে আরও নতুন নতুন কৌশল অবলম্বনের চিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছে।
১. সরকারকে কর আদায়ের বিশেষ জোর দিতে হবে। সঠিকভাবে ঠিক পরিমাণ কর আদায় গ্রহণ, সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এই কাজে নিয়োজিত কর কর্মকর্তাদের ট্রেনিং ও স্বচ্ছতা বেশী প্রয়োজন। সৎ ও যোগ্য কর কর্মকর্তা নিয়োগ ছাড়া এই কাজ কোনক্রমেই সম্ভব হবে না। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এমন আমাদের সরকারের সকল স্তরে বেশ অভাব রয়েছে। তা দূর করতে হবে।
২. আমাদের অর্থনৈতিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিচালিত। সুদ ভিত্তিক আমাদের আর্থিকখাত অন্য দিকে সুদ বিহীন ইসলামী শরীয়া মোতাবেক আমাদের দেশে ব্যাংক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মূল মেরুদন্ড হচ্ছে যাকাত।
বস্তুত যাকাত হচ্ছে সম্পদশালীদের সম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত সেই ফরজ অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর রহমত লাভের আশায় নির্ধারিত খাতে ব্যয়বন্টন করার জন্য দেওয়া হয়। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারায় ১১০ আয়াতে বলা হয়েছে “তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর।” তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু পূর্বে প্রেরণ করবে আল্লাহর নিকট তা পাবে। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তার স্রষ্টা।”
ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমানোর জন্য পৃথিবীতে পরিক্ষিত সূত্র হচ্ছে যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও তার সুষম বন্টন। পবিত্র কোরআন পাকে অন্যত্র বলা হয়েছে “আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে, তারা সালাত কায়েক করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে (সূরা আল হাজ্জ ২২:৪১)
দেশ যাতে যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে ধনী দরিদ্রের হার হ্রাস পাবে। তা হলে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশে দ্রæত ধনীর হার এইভাবে বৃদ্ধি পেতো না। অন্য দিকে দরিদ্র সংখ্যা বেড়েই চলেছে। করোনা পরবর্তী দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা আর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
৩. প্রতি বছরের বাজেটে দেশে দারিদ্র হার হ্রাস করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ ও অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে উক্ত পদক্ষেপ সমূহ আরও দৃঢ় ও বঞ্চিত আকারে নিতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে তুলে আনার জন্য বিনা সুদে, দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিতে হবে। হতদরিদ্র, দ্বীপ অঞ্চল, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের জন্য বিশেষ কর্ম পরিকল্পনা নিতে হবে। বিল, চরঅঞ্চল, পার্বত্য এলাকা মানুষের জন্য আলাদা অর্থ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৪. সুশাসন ছাড়া অতি ধনী সৃষ্টির দ্রæত অপকৌশল সমূহ কোনক্রমেই বন্ধ করা যাবে না। সমাজে সর্বত্র সুশাসন কায়েম করতে হবে। আইনের শাসনের পরিবর্তে অন্য কোন উপায়ে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমানো যাবে না। আইনের শাসনের অভাবে আজ আমাদের ব্যাংকিং খাত দৈন্যদশায় পড়েছে। করোনা পরবর্তী ব্যাংকিং খাত আজ বেশী ঝুঁকিতে পড়বে। এই অবস্থায় দরিদ্র দূরীকরণের জন্য র্বাংকিং খাত তেমন বড় ভূমিকা রাখতে হয়তো পারতে না। বিগত ১০ বছরে উচ্চ হারে ধনী হওয়ার ইতিহাসের পিছনে অবৈধ অর্থনৈতিক অর্থ উপার্জন, কুশাসন, অসম অর্থ বন্টনই মূল কারণ। এখন সরকারকে উল্লিখিত প্রতিবেদনের আলোকে ভবিষ্যতে কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে।
৫.মূল্যবোধ, মানবতা, মানুষের প্রতি মমতা, ভালবাসা মৌলিক শিক্ষা থেকে আমরা আহরণ করি। আমাদের মৌলিক শিক্ষায় গলদ রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু মুখস্ত করে পরীক্ষা পাশের চেষ্টা, সার্টিফিকেট অর্জন, তা দেখিয়ে মামার জোরে একটা চাকুরী অর্জনÑ আমাদের অনেক যুবকদের ইচ্ছা/এটা শিক্ষার মূল বিষয় নয়। শিক্ষা মূল বিষয় মূল্যবোধ শিক্ষা, মানবতা শিক্ষা, মমতা ভালবাসা শিক্ষা, মানব কল্যাণ করার মত চরিত্রবান মানুষ তৈরী। এমনই কর ফাঁকি না দিয়ে দেশ সেবায় মন দেবে। এখননি ধনী এত দ্রæত হওয়ার পথ বন্ধ হবে। সব অর্জিত সম্পদের হিসাব দিতে হবে। নিয়মিত সব সম্পদের হিসাব, কর দিতে হবে- এই ব্যবস্থা কার্যকরী হলে দ্রæত ধনী হওয়ার চেষ্টা বন্ধ হবে। দরিদ্রের হার কমবে।
৬. আমাদের নেতাদের চরিত্রের পরিবর্তন আনতে হবে। নেতা সৎ কর্মী, নিষ্টাবান, দেশপ্রেমিক হলে তার কর্মীরা ও অনুরূপ হবে। নেতার সততা না থাকলে কর্মীদের ও কোন সততা তৈরী হবে না। আর সৎ নেতা না হলে সৎ কর্মী হবে না। তাই দ্রæত ধনী হওয়ার সকল অপকৌশল দেশের নেতা যেমন করবেন, তেমনি অন্য সকল কর্মীও করবেন। তাই হচ্ছে বিধায় আমাদের বিগত ১০ বছরে কয়েকগুণ বেশী ধনী ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। অতি দ্রæত ধনী হওয়ার জন্য অন্যায়, অবৈধ পন্থায় আমাদের দেশে যেন একটি অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের থেকে এই উদ্যোগ প্রথমে গ্রহণ করতে হবে।
৭. চরিত্রের পরিবর্তন বা সৎ চরিত্রবান মানুষ তৈরীর জন্য ভাল কারখানা বা কারিগর। তা হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে নতুন করে সাজাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে মূল্যবোধের শিক্ষা ছাড়া, স্ব-স্ব ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া কোনক্রমে ভাল মানুষ, সৎ চরিত্রবান মানুষ তৈরী করা যাবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক শিক্ষা স্ব স্ব ধর্মের শিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। আমাদের নিকট দেশ মালয়েশিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের কোরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক। এমন কি প্রাথমিক স্কুলে কোরআন হেফজ করার ব্যবস্থা পর্যন্ত রয়েছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্য পুস্তক নতুন করে লিখতে হবে। সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। চরিত্রবান মানুষ তৈরীর পর চরিত্রবান জাতি তৈরী হবে। এখনন ধনী দরিদ্রের এই ব্যবধান তৈরীতে মানুষের অপকর্ম কমে যাবে। কর দাতার সংখ্যার বাড়বে। দরিদ্রের হার কমবে। যাকাত দাতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে সমাজে অর্থের চলাচল বৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্যতা হ্রাসে বেশ ভূমিকা রাখবে। দ্রæত স্বল্প সময়ে অতি ধনী হওয়ার পরিবেশ কমে যাবে। জাতি সমৃদ্ধ হবে। সৎ নেতৃত্ব দেশে আসবে। দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, জুলুম নির্যাতন কমে যাবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা তৈরী হবে।
৮. আমাদের দেশে ব্যক্তি আয় করের পরিমান বেশ উচ্চ হার রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায় ৩৫ শতাংশ এবং কর্পোরেট খাতে ৪৭ শতাংশ আয় কর দিতে হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশে ৪৫ শতাংশের বেশী ব্যক্তি আয় কর নাই। আবার ঐ সকল দেশের করের বিনিময়ে মানুষ সেবা পায়। বেকার সময়ে সরকার করদাতাদের খরচের জন্য ভাতাও দেন। এখন করোনা আক্রান্তের পর প্রায় ৮০ শতাংশ হারে ভাতা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে দেয়ার নিয়ম নাই। শুধু নেয়ার নিয়ম। তাই মানুষ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। সরকারকে উন্নত দেশের নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। তখন কর দাতা উৎসাহিত হবে। কর বৃদ্ধি পাবে। তখন ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমানোর জন্য সরকার অনাদায়কৃত কর থেকে দরিদ্র মানুষের কল্যাণে নানা উন্নয়নমূলক প্রকাশ গ্রহণ করতে পারবে।
বিগত ১০ বছরে ধনি বৃদ্ধির অত্যধিক হার আমাদের সকলে ভাবিয়ে তুলছে। এই হার এইভাবে বৃদ্ধি পেলে আগামীতে দারিদ্র্যের হারও আরও বেশী বৃদ্ধি পাবে। আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন শুধু গুটি কয়েক ধনির লোকের জন্য করি নাই। পাকিস্তানী ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে ছিল আমাদের যুদ্ধ। এমন স্বাধীন দেশে ২২ হাজারের চেয়ে বেশী ধনকূবেরের জন্য আমাদের ক্ষুদ্র এই স্বাধীন দেশ আমরা তৈরী করেছি। এটা মোট্ইে আমাদের কাম্য নয়।
৯) সবচেয়ে কম বিগত ১০ বছরে ধনি সংখ্যা বৃদ্ধির হার আয়ারল্যান্ডের। হার হচ্ছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ আমাদের মত একটি অনুন্নত দেশে ধনি বৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক ধনি দ্রæত সৃষ্টি বাংলাদেশে একটি অবাক করার মত। যে দেশে প্রায় ৪০ শতাংশে মানুষ করোনা পূর্বে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। করোনা পরবর্তী এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। অর্থের সুষম বন্টন ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহিত পদক্ষেপ সমূহ কার্যকরী না। অন্য দিকে অবৈধভাবে ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ কিছু সংখ্যক ব্যক্তি লুন্টনের ফলে এই ফলাফল বেরিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য করা বা বৈধ উপায়ে ধনি শ্রেণীর বৃদ্ধি কোন অন্যায় নয় বরং তা দেশের অর্থনীতির জন্য বেশ ভাল। তাদের অর্থ সমাজে সার্কুলেট হওয়ার ফলে গরীবদের হাতেও নানাভাবে অর্থ পৌছবে। তাই দেশে সুষম আইনের সঠিক, সবার জন্য সমান, ন্যায় সঙ্গত প্রয়োগ অর্থনীতিকে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে।
১০) আমাদের আর্থিক খাতকে আইটি ভিত্তিতে স্বচ্ছতায় নিয়ে আসতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম এখনও কম্পিউটারাইজ করা সম্ভব হয় নাই। আমাদের সকল ব্যাংক ও অ-আর্থিক খাতের যাবতীয় কার্যক্রম আইটি মোতাবেক করা সম্ভব হয় নাই। অন্যদিকে আমাদের দেশে সকল মানুষের ‘ডাটা ব্যাজ’ তৈরী হয় নাই। আমাদের দেশে কত নাগরিক, কত কাজে আছে তা সরকারের নিকট নাই। যে কোন ব্যক্তি, যে কোন সময় আমাদের দেশে এসে নাগরিক তালিকাভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই জন্ম সনদ গ্রহণ এখনি আমাদের শত ভাগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বস্তিতে হোক, চর অঞ্চলে হোক, পাহাড়ি অঞ্চলে হোক সকল নাগরিককে তাািলকা ভুক্ত করে নাগরিক সনদ দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। তখনি সরকার সকল নাগরিকের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা সহজ হবে। সকল নাগরিককে উন্নয়ন পরিকল্পনা না আনতে পারলে ধনি সৃষ্টির হার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির লাগাম ধরে রাখা যাবে না।
১১) মানুষ বেশী ধনি হোক, এইটি আমাদের সকলের একান্ত কাম্য। কিন্তু তা হতে হবে সৎভাবে। সততার সঙ্গে অর্থ উপার্জন সম্পূর্ণরূপে বৈধ বিষয়। এইটি একজন নাগরিকের বৈধ অধিকার। কিন্তু অবৈধ, অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এই ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিগত ১০ বছরে ধনির ‘সংখ্যা’ ১৪ গুণের অধিক হয়েছে। আমরা বিশ্ব সেরা হয়েছি। অন্যদিকে দরিদ্র্যের সংখ্যার সেই অনুপাতে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর মূল কারণ জবাবদিহি সম্পন্ন সরকার, স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে, সরকার, প্রকৃত জনগণের সত্যিকার ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার কখনও অবৈধ কার্যক্রম করার তথাকথিত ধনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। সেই পরিবেশের সুযোগ নিয়ে কিছু সংখ্যক ধনাঢ্য ব্যক্তি দিনের পর দিন ধনি থেকে আরও বেশী ধনিতে পরিণত হচ্ছেন। সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের সরকার কায়েম করতে হবে। সব সময় সকলকে জনগণের দরবারে যেতে হবেÑ এ ভীতি থাকতে হবে। সকল সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে মজুত, স্বচ্ছ, জবাবদিহি, স্বাধীন করে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই আইনের শাসন কায়েম হবে। বহুদলীয় গণতন্ত্র মজবুত হবে। একক ব্যক্তির উপর নির্ভর না হয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির নিকট নির্ভর হতে পারলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে এবং ধনি হওয়ার অবৈধ, দ্রæত, অন্যায় পথসমূহ বন্ধ হবে।
আবুল কাসেম হায়দার
সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি ও ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি:, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনি আজীবন সদস্য : এশিয়াটিক সোসাইটী বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম সমিতি, সন্দ্বীপ সমিতি ঢাকা ।
লেখক দৈনিক আজকের আওয়াজ ও সাপ্তাহিক প্যানোরামা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।